জৈব প্লাস্টিক ব্যাগ প্রচলন ও প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা

পাটজাত পলিথিন ‘সোনালি ব্যাগ’-এর মালিকানা স্বত্ব বাংলাদেশের করে রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া এবং বাণিজ্যিকভাবে এটি বাজারজাত করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনের সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। প্রথম আলো ফাইল ছবি
পাটজাত পলিথিন ‘সোনালি ব্যাগ’-এর মালিকানা স্বত্ব বাংলাদেশের করে রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া এবং বাণিজ্যিকভাবে এটি বাজারজাত করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনের সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। প্রথম আলো ফাইল ছবি

বছরের শুরুতে একটি খবর পরিবেশ গবেষক ও পরিবেশবাদী তথা সব পরিবেশ সচেতন মানুষকে আশাবাদী করেছে। খবরটি হলো পাট থেকে জৈব প্লাস্টিক বা পলিথিন উৎপাদনের প্রক্রিয়া আবিষ্কার। কাজটি করেছেন ড. মোবারক আহমদ খান; যিনি বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা (প্রথম আলো, এপ্রিল ০৭)। নিঃসন্দেহে চমৎকার একটি খবর। বাজারের প্রচলিত প্লাস্টিক বা পলিথিন যা শপিং ব্যাগ তৈরির প্রধান উপকরণ, তা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

এর কারণ একটি কিন্তু ক্ষতি দুটি। প্রথম কারণ হলো পলিথিন বা পলিইথিলিন সাধারণত নষ্ট হয় না। অর্থাৎ সাধারণ কোনো ব্যাকটেরিয়া একে হজম করতে পারে না। ফলাফল মাটিতে, নর্দমায়, খালে, নদীতে পরে থাকা পলিথিন নষ্ট না হয়ে দীর্ঘদিন থেকে যায় এবং জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। বস্তুত একটু বৃষ্টিতে ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতার পেছনে এই জমে থাকা পলিথিনের বড় ভূমিকা রয়েছে। জমে থাকা পলিথিন পরিবেশের অপর যে ক্ষতি করে, তা একটু সূক্ষ্ম। আমাদের পরিবেশ অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চক্রের সমষ্টি এবং এই প্রত্যেক চক্র একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। মূলত এই চক্রগুলোর মধ্যে বাধাহীন বিনিময় সুন্দর পরিবেশের পূর্বশর্ত। এর মধ্যে যেমন অতি ক্ষুদ্র অণুজীব রয়েছে তেমনি রয়েছে বড় উদ্ভিদ ও প্রাণী। মাটি ও পানিতে পলিথিনের উপস্থিতি পরিবেশের জৈব ও অজৈব উপাদানের মধ্যে বাধা তৈরি করে এবং স্বাভাবিক বাস্তুসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও মাছের অস্তিত্ব হ্রাস পাওয়ার বড় কারণ পানিতে বিপুল পরিমাণ পলিথিনের উপস্থিতি। কিন্তু পাট থেকে উৎপাদিত প্লাস্টিক জৈব পদার্থ এবং ধীরে ধীরে পচে যায়।

এত দিন এ বিষয়ে প্রচুর কথা, সেমিনার, টকশো এবং রাষ্ট্রীয় নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও সফলতা এসেছে সামান্যই। বাজার থেকে পলিথিনের শপিং ব্যাগ তো দূর হয়নিই উল্টো বাজার ছেয়ে গেছে প্লাস্টিকের তৈরি পানীয় বোতল এবং আসবাবপত্রে। কারণ দুটি, পলিথিন বা প্লাস্টিক খুব সস্তা এবং অত্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী। বাংলাদেশে পলিথিন বিশেষ করে পলিথিনের শপিং ব্যাগের ব্যবহার দূরীকরণে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০০২ এ বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে আইনগতভাবেই পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন বন্ধ করে। এর আগে ও পরে নানা সামাজিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে (বিবিসি নিউজ, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৩)। কোনোটাই ফলপ্রসূ হয়নি এবং তার কারণ বোঝার জন্য মহাকাশ বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ একটিই, তা হলো পলিথিনের উপযুক্ত বিকল্পের অভাব। যদি বাজারে চাহিদা থাকে, তা হলে উপযুক্ত বিকল্প ছাড়া কোনো পণ্যের সরবরাহ যে বন্ধ করা অসম্ভব তা আমাদের নীতিনির্ধারকেরা বুঝতে চান না।

এত কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই। এর আগে পলিথিন ব্যবহার বন্ধে নেওয়া প্রায় সব উদ্যোগ ব্যর্থ হলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। ড. মোবারক আহমদ খানের আবিষ্কার প্রথমবারের মতো আমাদের হাতে পলিথিনের উপযুক্ত বিকল্প তুলে দিয়েছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটি প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপমাত্র। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন ছাড়া এ উদ্যোগ সফল করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া আরও মাথায় রাখতে হবে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ আইন প্রণয়ন এ ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসবে না। জৈব পলিথিন প্রচলিত করতে হলে নির্ভর করে হবে বাজার ব্যবস্থার ওপরেই এবং বাজার ব্যবস্থা শুধু উপযুক্ত পণ্যই গ্রহণ করে।
জৈব প্লাস্টিকের প্রচলন পরিকল্পনায় নীতিনির্ধারকদের জন্য কয়েকটি সুপারিশ—
ডেমরার লতিফ বাওয়ানী জুট মিলের পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়েছে এপ্রিলে। ধারণা করা যায়, উৎপাদন প্রক্রিয়া ঠিক করতে (প্রসেস অপটিমাইজেশন) আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে। এরপর একটি দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদন ও সরবরাহ পরিকল্পনা করা দরকার। এতে সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে ব্যবসায়ী, ব্যাংক এবং অন্য বিনিয়োগকারীদের যুক্ত করতে পারলে ভালো হয়। বাজারব্যবস্থায় কোনো পণ্য প্রচলন করতে হলে বাজারকে সঙ্গে নিয়ে করাই ভালো।

পরবর্তী পদক্ষেপের উৎপাদন কৌশল নিয়ে। প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে, পাট থেকে উৎপাদিত প্লাস্টিক ব্যাগের খরচ প্রচলিত প্লাস্টিক ব্যাগের চেয়ে কিছুটা বেশি। কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে এ খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব (ইকোনমি অ্যাট স্কেল)। এখানেই উৎপাদন কৌশলের বিষয়টি সামনে চলে আসে। এর উৎপাদন কৌশল জটিল হলে শুধু কয়েকটি বিশেষায়িত মিলের উৎপাদন করা উচিত। বেশি উৎপাদনের খরচ কমাতেও সাহায্য করবে। তখন গুরুত্ব দিতে হবে এর সরবরাহে (সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট)। মনে রাখতে হবে এ সমস্যা শুধু ঢাকার নয় পুরো দেশের। ফলে এ জৈব প্লাস্টিক ব্যাগ প্রচলন করতে হবে সারা দেশে। এ ক্ষেত্রে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতি অনুসরণে কোনো লজ্জা নেই। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে সুপেয় পানির উৎস নেই সেখানেও আপনি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান উৎপাদিত কোমল পানীয় পাবেন। তা না হলে টিসিবির ট্রাকে করে চাল বিক্রির নীতি অনুসরণ করে এ পণ্য প্রচলন করা যাবে না।

যদি এর উৎপাদনপ্রক্রিয়া সহজ হয়, তবে যেসব অঞ্চলে পাট ভালো হয়, সেসব অঞ্চলেই এর উৎপাদনের ব্যবস্থা করা ভালো (ডিসেন্ট্রালাইজড প্রোডাকশন)। মনে রাখতে হবে, প্লাস্টিক ব্যাগের ভোক্তারা সারা দেশে ছড়ানো। অঞ্চলভিত্তিক উৎপাদনে যদিও প্রাথমিক খরচ বেশি হবে, তবে পরবর্তী সময়ে পাট সংগ্রহ ও উৎপাদিত পণ্য বাজারে সরবরাহের খরচ কম হওয়ায় অতিরিক্ত প্রাথমিক খরচ পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক প্রণোদনার বিষয়টি সামনে চলে আসে। যদি অঞ্চলভিত্তিক উৎপাদনে যেতে হয়, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র থেকে উদ্যোক্তার জন্য আর্থিক প্রণোদনা থাকতেই হবে। তা হতে পারে সহজ শর্তে ঋণ কিংবা কারিগরি সহায়তা। যেটাই করা হোক হিসাবে রাখতে হবে খোলা বাজারে এ পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ। ভোক্তা পর্যায়ে জৈব প্লাস্টিক ব্যাগের দাম প্রচলিত ব্যাগের চেয়ে বেশি হলে কোনো উদ্যোগই কার্যকর হবে না। উৎপাদন ও সরবরাহের ঠিক কোনো পর্যায়ে প্রণোদনা দিলে তা মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর হবে তা ঠিক করতে হবে। এর আগে কৃষিতে বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে দেখা গেছে, তা সাধারণ ক্রেতার কাজে আসে না, লাভ চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে।

ওপরের সুপারিশগুলো নীতিনির্ধারকদের জন্য চিন্তার খোরাক মাত্র। তবে একটি কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, উপযুক্ত পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন ছাড়া জৈব প্লাস্টিক ব্যাগের বাজার দখল সম্ভব নয়। বিশেষ করে যখন একে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে প্রচলিত পলিথিনের সঙ্গে, সাধারণ ভোক্তাদের কাছে যার গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক। ফলে সব অংশীদারদের নিয়ে একটি বাজার ভিত্তিক পরিকল্পনা করা হলে তার সফলতার সম্ভাবনা অনেক বেশি হবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

দ্বিগ্বিজয় দে: পরিবেশ ব্যবস্থাপনা শিক্ষার্থী, টোএন্টে বিশ্ববিদ্যালয়, নেদারল্যান্ডস