প্রবাসে জামানদের জীবন

এম আর ফারজানা।
এম আর ফারজানা।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে প্রবাসে এসেছিল জামান। বাপ-দাদার ভিটেমাটি বিক্রি করে। তাকে নিয়ে পরিবারেরও অনেক স্বপ্ন। একদিন সংসারে সচ্ছলতা আসবে। দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে তারা। পরিবারের মানুষগুলো তাদের স্বপ্নের অনেকখানি ছুঁতে পেরেছে। জামান তাদের সে আশা পূরণ করেছে। কিন্তু জামানের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সুখ নামের পাখিটা।

জামান কাজ করতে করতে ইফতারের কথা ভুলে গিয়েছিল। কাজের এত চাপ তার ওপর মালিকের কড়া নির্দেশ, আগে দোকানের কাস্টমার তারপর ইফতার। কিন্তু কাস্টমারের এত লাইন থাকে যে জামানের আর ইফতার করা হয় না, ইফতারের সময় শুধু এক গ্লাস পানি খায় বিসমিল্লাহ বলে। বহু কষ্টে রেস্টুরেন্টে এই কাজটা জুটিয়েছে জামান। প্রতিদিন প্রায় ১০ ঘণ্টার মতো কাজ করে রোজা রেখেই। কী করবে? মালিকের কথা না শুনলে যে এ কাজটা হারাতে হবে। তাহলে দেশে পরিবারের মানুষগুলোর কী হবে? নিজে কীভাবে চলবে? তাই মালিকের কথা মতোই তাকে চলতে হয়।

আর বাসা? ছয়জন মিলে একটা রুমে থাকে তাও আবার কিচেন, বাথরুম অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে হয়। এভাবেই চলে জীবন। কাজ থেকে ফিরে যে একটু শান্তিমতো খাবে, ঘুমাবে তারও কোনো উপায় নেই। ক্লান্ত হয়ে, শান্তিমতো বিশ্রাম নেবে সেটা আর হয় না। রুমের একেকটা বদের হাড্ডি। দুটি স্প্যানিশ, একটা তো মাতাল হয়ে পড়ে থাকে। আরেকটা পাকিস্তানি এটার গায়ে খবিশের গন্ধ। আরেকটা আফগানিস্তানের, আরেকটা স্থানীয়। সারা দিন রোজা রেখে কাজ আর ইফতার করা হয় না ব্যস্ততার কারণে, শুধু ওই এক গ্লাস পানি। তাই বাসায় এসে একেবারে খায় জামান। এটাই ইফতার, এটাই রাতের খাবার তার কাছে। রান্না করা, বাজার করা, কাপড় ধোঁয়া—এগুলো জামানই বেশি করে। সবচেয়ে বড় কথা জামান যে নিজের মতো করে থাকবে তার কোনো উপায় নেই। কষ্ট পেলেও যে কাঁদবে সে জায়গাটুকু তার নেই।

জামানের মনে পড়ে তার মায়ের কথা। রোজা এলে ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠতে চাইত না। মায়ের সে কি বকা, ওই জাহান্নামে যাবি ওঠ, ওঠ। এত বড় ছেলে কি আইলসা? জামান বলত, হ্যাঁ আমি আইলসা বংশের পোলা। খামু না ভাত, থাকুম না রোজা। এ কথা শুনে মা কপাল চাপড়াইত। হায় হায় কয় কি? আরে দোজখের আগুনে পুড়ে মরবি। ওঠ, ওঠ। সকাল তো হইয়া যাইব। আয় তাড়াতাড়ি আয়। শেষ পর্যন্ত জামান ভাত খেত, রোজা ও রাখত।

ইফতারের সময় কত-না আনন্দে কেটেছে ভাইবোনদের সঙ্গে। একজন শরবত বানায় তো আরেকজন খেজুর আর বেগুনি ঠিক করে। আরেকজন মুড়ি নেয় আর শসা কাটে। আর পাশের বাসার হাসি, ও তো প্রায় সময় ইফতার ও দিয়ে যেত।

হাসি যে জামানকে ভালোবাসত সেটা প্রকাশ না করলেও জামান বুঝতে পারত। আচ্ছা হাসি কি জামানকে এখনো ভালোবাসে? নাকি ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছে?
আর রাতে খাবারের সময় জামান দেখত তার পছন্দের খাবারগুলো আছে কি না?
না থাকলে নাই কেন? সেকি রাগ।
বাবা বলত, আজ খেয়ে নে, কাল নিয়ে আসব। কাল আবার সেই একই কথা। কি বিরক্ত হতো। কখনোই জানতে চায়নি বাবা কি করে এত ভাইবোন সংসারের খরচ জোগায় করে ছোট একটা চাকরি করে? জানার প্রয়োজন মনে করেনি। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর সংসারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে তার ওপর।
চোখে শুধু অন্ধকার দেখে। কী করবে ভেবে পায় না। লেখাপড়াও বেশি করেনি। বিএ পাস করেছে মাত্র। শেষ পর্যন্ত এক বন্ধুর মাধ্যমে দালাল ধরে বিদেশ পাড়ি জমায়। কিন্তু কে জানত বিদেশে এত কষ্টের জীবন।

গতকাল তার মায়ের সঙ্গে কথা হলো, বলল তার বোনের বিয়ের কথা চলছে যদি পারে...। জামান বুঝে যায় মা কী বলতে চায়। মাকে আর বলা হয় না তার কষ্টের কথা। বরং পরিবারের মানুষগুলো সুখে আছে, এটা ভাবলেই সে নিজের কষ্টটাকে আর কষ্ট মনে করে না।

জামান শুধু একটা উদাহরণ মাত্র। এ রকম হাজার হাজার প্রবাসী আছে, যারা অনেক কষ্ট করে জীবন পার করছে শুধু পরিবারের কথা ভেবে। তাদের স্বপ্ন একটাই দেশে আপনজনেরা সুখে থাকুক, ভালো থাকুক।

সবাই যে জামানের মতো এত কষ্ট করে তাও নয়, অনেকে পরিবার নিয়ে আছে। তবে এদের সংখ্যা জামানদের চেয়ে কম। অনেকে ভালো চাকরি করে, কিংবা অনেকে ছোট খাট ব্যবসা ও করে কিন্তু নিয়মের মধ্যে চলা যান্ত্রিক জীবনে হাঁপিয়ে উঠে। ব্যস্ততা আর নিয়মের মধ্যে পড়ে একসময় হারিয়ে যায় সুখের অনুভূতিগুলো। চলতে থাকে যন্ত্রের মতো। একসময় সেটা অভ্যাস হয়ে যায়।

*এম আর ফারজানা, নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্র থেকে