আলোর ঝরনাধারায়

ভিভিড সিডনি আলোক-উৎসব
ভিভিড সিডনি আলোক-উৎসব

‘আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা।  আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা।’

আজকালকার যান্ত্রিক নগরের চোখ ধাঁধানো আলোক উৎসব দেখলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানটার কথা মনে পড়ে যায়। প্রতিবছরের মতো এ বছরও গত ২৫ মে থেকে সিডনি শহরের প্রাণকেন্দ্রে শুরু হয়েছে ভিভিড সিডনি আলোক-উৎসব। চলবে ১৬ জুন পর্যন্ত। সিডনিকে বলা হয় সিটি অব কালারস। ভিভিড সিডনি আলোক-উৎসব শুরু হলে সত্যিই সিডনিকে রঙের শহর মনে হয়। সিডনির রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে ইমারত, স্থলযান, নৌযান, বিভিন্ন পার্ক এমনকি গাছগুলোকে বিভিন্ন রঙের আলোয় রাঙিয়ে দেওয়া হয়। যার ফলে মনে হয় হঠাৎ করে আপনি বুঝি কল্পনার কোনো রূপকথার রাজ্যে ঢুকে পড়েছেন।

ভিভিড সিডনি আলোক-উৎসব
ভিভিড সিডনি আলোক-উৎসব

উন্নত বিশ্বের যান্ত্রিকজীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবসর সময় বের করে কোথাও যাওয়া মোটামুটি প্রায় অসম্ভব। তাই কয়েক দিন আগে বিকেলে আমার মেয়ের বান্ধবী তাহিয়ার মা বললেন, চলেন আজ ইফতারের পর ভিভিড শো দেখে আসি। আমাদেরও এখন পর্যন্ত সেখানে যাওয়া হয়নি। তাই এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। ইফতার করেই আমরা দুই পরিবারের মোট সাতজন রওনা দিয়ে দিলাম সিডনি সিটির উদ্দেশে। ক্যাম্বেলটাউন এলাকা থেকে সিডনি যেতে ট্রেনে প্রায় ঘণ্টাখানেক লাগে। গ্লেনফিল্ড ষ্টেশন থেকে আমরা ট্রেনে চড়ে বসলাম। ট্রেনে আমরা সবাই আড্ডা দিয়ে সময় পার করে দিলাম।

ভিভিড সিডনি আলোক-উৎসব
ভিভিড সিডনি আলোক-উৎসব

সার্কুলার কিয়ে স্টেশনে নেমে আমরা শুরুতেই অপেরা হাউসের গায়ে আলোর ছোঁয়া দেখতে গেলাম। বিভিন্ন রঙের আলোর ছোঁয়ায় ইট পাথর কংক্রিটের অপেরা হাউস যেন প্রাণ পায়। গতবার আমার মেয়ে তাহিয়া এই রঙের খেলা দেখে বলেছিল, বাবা আমি এই রং ছুঁয়ে দেখতে চাই। আমি লোকজনের ভিড় ঠেলে তাকে অপেরা হাউসের কাছে নিয়ে গেলে সে অপেরা হাউসের দেয়াল স্পর্শ করে বলেছিল, বাবা অপেরা হাউসে তো রং করে নাই তাহলে কীভাবে অপেরা হাউসের গায়ের রং বদলে যাচ্ছে? আসলে এই আলোর খেলাটা প্রত্যেকটা স্থাপনাকে এতই সজীব ও প্রাণবন্ত করে তোলে যে সেগুলোকে জীবন্ত বলেই ভ্রম হয়।

ভিভিড সিডনি আলোক-উৎসব
ভিভিড সিডনি আলোক-উৎসব

অপেরা হাউসের আলোর খেলা চলতে থাকল আর আমরা বোটানিক গার্ডেনের দিকে এগিয়ে চললাম। ছোট্ট জেইনা আর রায়ান সবচেয়ে বেশি খুশি হচ্ছিল আলোর এই খেলা দেখে। তারা এদিক-ওদিকে দৌড়ে ছুঁয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করছিল আসলে এখানে কী ঘটে চলেছে। বোটানিক গার্ডেনে আলোর ছোঁয়ায় সবুজ বর্ণের গাছগুলো বিভিন্ন বর্ণে শোভা পাচ্ছে। এ ছাড়া কৃত্রিম আলোর সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম গাছ। সঙ্গে আছে বেশ কিছু আলোর স্তম্ভ

ভিভিড সিডনি আলোক-উৎসব
ভিভিড সিডনি আলোক-উৎসব

আর স্তম্ভের থিমের সঙ্গে মিল রেখে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। তার মধ্যেই গার্ডেনের লেকের মধ্যে শত শত আলোর সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে একটা স্থাপনা। সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে চলেছে এই থিমের বিষয়বস্তুর ইতিহাস।
এককোনায় একটা উইশিং সার্কেল স্থাপন করা হয়েছে। হাত দিয়ে উইশিং সার্কেলটা ঘুরালে প্রতি পাকেই সে একবার করে একটা ঘণ্টায় আঘাত করে শব্দ তৈরি করছে। পাশে থেকে একজন সাহায্যকারী বলে দিচ্ছেন। তখন আপনাকে একটা উইশ করতে হবে। তাহিয়া ও জেইনা সেখানে গিয়ে উইশ করে খুবই খুশি এবং সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের তাদের উইশের কথা বলে দিতে চাইছিল। আমি তখন বললাম উইশের কথা বলে দিতে নেই, তাহলে আর সেটা পূরণ হয় না। কৃত্রিম আলোক দণ্ডের সাহায্যে তৈরি গাছের সামনে এসে তাহিয়া ও জেইনার ছবি তুলছিলাম দেখে এক যুগল দম্পতি আমাদের বললেন, তোমরা চাইলে আমরা তোমাদের ছবি তুলে দিতে পারি। আমরা তখনই দৌড়ে গিয়ে সবাই ক্যামেরা সামনে হাজির হয়ে গেলাম। এখানে সবাই মোটামুটি গায়ে পড়ে আপনার উপকার করতে চায়। তার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ উপকার হলো এভাবে গায়ে পড়ে অন্যের ছবি তুলে দেওয়া।

আলোক-উৎসবে লেখক ও অন্যরা
আলোক-উৎসবে লেখক ও অন্যরা

আরও বেশ কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর একটা জায়গার মাটির ওপরে খুবই সুন্দর করে বিভিন্ন আকৃতির পাটাতন স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে গিয়ে জেইনা ও তাহিয়া সঙ্গে রায়ানও লাফিয়ে লাফিয়ে চলা শুরু করল আলোর তৈরি সেই পথের ওপর দিয়ে। ওদের দেখাদেখি জেইনার মাও একসময় বাচ্চাদের মতো লাফিয়ে চলা শুরু করে দিল। আসলে যেকোনো সুন্দর সৃষ্টিই একজন মানুষের ভেতরকার শিশুটাকে জাগিয়ে তোলে। বোটানিক গার্ডেনের একেবারে শেষপ্রান্তে গাছের তলায় ঝোপঝাড়ের মধ্যে ছোট ছোট বাতি স্থাপন করে অনিয়মিতভাবে জ্বালানো ও নেভানো হচ্ছে। হঠাৎ দেখলে সেগুলোকে জোনাকি বলে ভুল হবে। আমি জেইনা ও তাহিয়াকে বললাম তোমরাতো নিশ্চয় ফায়ার ফ্লাইসের নাম শুনেছ এগুলো হচ্ছে সেই ফায়ার ফ্লাইস। এটা শুনে ওরা দুজন দেখি বিশ্বাস করে ফেলেছে। তাই একটু পড়ে ভুলটা ভাঙিয়ে দিলাম।

আলোক-উৎসবে লেখক ও অন্যরা
আলোক-উৎসবে লেখক ও অন্যরা

এগুলো ছাড়াও প্রায় প্রত্যেকটা গাছেই বিভিন্ন রঙের আলো ফেলে এক ভৌতিক পরিবেশের সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই আপনি যখন এই আলোর খেলার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাবেন তখন মনের মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করবে। পুরো বোটানিক গার্ডেনের আলোকসজ্জার শেষে আলো দিয়ে একটা লাইন লেখা আছে যেটা আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে। সেটা হলো, হাউ মেনি লাইট বাল্বস ডাজ ইট টেকস টু চেঞ্জ এ পারসন? পুরো বোটানিক গার্ডেনের আলোকসজ্জা দেখে আমাদের অনেক বেশি ক্ষুধা পেয়ে গিয়েছিল। তাই আমরা আবার সার্কুলার কিয়ে স্টেশনের কাছে ফিরে এসে সেখানকার হাংরি জ্যাক থেকে খাবার কিনে একটা গাছের তলায় বসে খাওয়াদাওয়ার পর্ব সেরে নিলাম।
এরপর আমরা রওনা দিলাম বারাংগারুর উদ্দেশে। ভিভিড সিডনির ফেসবুক পেজে বিশাল দৈত্যাকৃতি একটা মূর্তির ছবি দিয়ে বলা ছিল, সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত তিনি আগত অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাবেন। তাই আগে থেকেই আমরা জেইনা ও তাহিয়াকে বলেছিলাম তোমাদেরকে বিশাল একটা উইচ দেখানো হবে। সেটা শুনে ওরা অনেক আগ্রহ প্রকাশ করছিল। তাই এতখানি হাঁটার পরও ওরা আরও হাঁটার জন্য তৈরি হয়ে নিল। আমরা সার্কুলার কিয়ের অন্য প্রান্ত দিয়ে বারাংগারুর দিকে হাঁটা শুরু করলাম। সেখানেও বেশ কিছু স্থাপনা দেখলাম। যার মধ্যে এক হাজার বকের প্রতিকৃতিটা আমাদের মনে দাগ কেটেছে। একসঙ্গে এক হাজার বকের গায়ে আলো জ্বলছে ঘটনাটা সামনাসামনি না দেখলে আসলে বুঝিয়ে বলা অসম্ভব।
হেঁটে হেঁটে আমরা বারাংগারু পৌঁছে বিশাল উইচের খোঁজ শুরু করে দিলাম। অনেক খুঁজেও না পেয়ে সেখানে দায়িত্বরত সিকিউরিটি গার্ডকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনিও কোনো সদুত্তর দিতে পারলেন না। তাই আমরা বিফল মনোরথে ডার্লিং হারবারের দিকে রওনা দিলাম। যাওয়ার পথে একটা থামের গায়ে পোস্টারে সেই বিশালাকৃতি উইচের ছবি দেখে বিবরণ পড়তে গিয়ে জানলাম তিনি আসলে রাত নয়টা পর্যন্ত থাকেন। তখন বুঝলাম ফেসবুকে সামান্য একটু ভুল তথ্য দেওয়া আছে। আসলে রাত নয়টার পর সার্কুলার কিয়ে ছাড়া অন্য আলোকসজ্জাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ ডার্লিং হারবারেও আমরা কোনো আলোকসজ্জা দেখতে পেলাম না রাত একটু বেশি হয়ে যাওয়াতে।
তাই আমরা পরিকল্পনা করছি আরও একদিন যাব উইচের সঙ্গে দেখা করতে। আসলে পুরো ভিভিড শো উপভোগ করতে চাইলে আপনাকে বেশ কয়েক দিন যেতে হবে। তাহলে আপনি এর সৌন্দর্য পুরোপুরি বুঝতে পারবেন না। ভিভিড সৌন্দর্যের আরও একটা অংশ হচ্ছে ভিভিড ফেরি শো। এবার আমরা সেটাতেও চড়তে পারিনি। তা ছাড়াও সিডনি শহর লাগোয়া তরংগা জুতেও ভিভিড শো হচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন প্রাণীর আকৃতি বানানো হয়েছে আলোর সাহায্যে এবং তারা নড়াচড়াও করে।
এই ভিভিড শো দেখার জন্য সিডনি তথা অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ সিডনি চলে আসেন। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও এখন মানুষ আসেন এটা দেখতে। তাই আপনিও একদিন সপরিবারে চলে যেতে পারেন সিডনির প্রাণকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এই আলোক-উৎসব দেখতে। তবে মনে রাখতে হবে ১৬ জুন এই শো শেষ হয়ে যাবে এই বছরের মতো। তাই যেতে চাইলে আপনাকে এর মধ্যেই যেতে হবে।

মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি. অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>