আমরা কবে স্বনির্ভর হব?

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

জার্মানিতে আমি একটি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং টেস্টিং ল্যাবে কাজ করি। ল্যাবে মোট মেশিনের সংখ্যা ১১টি। এই ১১টি মেশিন এগারো ধরনের পরীক্ষা করতে কাজে লাগে। মেশিনগুলো খুব উন্নত ও ব্যয়বহুল। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সবগুলো মেশিনই তৈরি হয়েছে জার্মানিতে। শুধু মেশিন নয়, মেশিনের নাট-বল্টু, কলকবজা সব তৈরি হয়েছে জার্মানিতে। প্রতিটা যন্ত্রাংশে মেড ইন জার্মানি লেখা। শুধু ল্যাবের মেশিনের উদাহরণ না দিয়ে আরও কিছু উদাহরণ দিই। যে চেয়ারে বসে কাজ করি সেটিও জার্মানিতে তৈরি। খাতা, কলম, মার্কার পেন, হাইলাইট পেন, পেনসিল ইত্যাদি সব জার্মানির তৈরি। স্লাইড ক্যালিপার্স, স্কেল, পেপার ক্লিপ, ফাইল বক্স, ছোটখাটো ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভাইস সবই জার্মানির তৈরি। কেমিক্যাল ল্যাবের সব কেমিক্যাল, গ্লাসের তৈরি সরঞ্জাম যেমন কনিক্যাল ফ্লাক্স, বিকার, ওয়াচ গ্লাস, টেস্টটিউব, তরল নাইট্রোজেনের সিলিন্ডার, ব্যুরেট, পিপেট ইত্যাদি সবই জার্মানির তৈরি।

আমি মোটেও বলছি না যে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে ঠিক শতভাগ জার্মানির মতোই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। তবে কতটুকু হচ্ছি? কেমন গতিতে স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি? দৈনন্দিন কাজে আমাদের যা দরকার তা কি নিজেদের দেশে তৈরি করছি নাকি মেড ইন চায়না বা ইন্ডিয়া নির্ভর থাকতে হবে?

আমরা স্যাটেলাইট (বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১) নিয়ে গর্ব করছি। অবশ্য গর্ব করার মতোই বিষয়। কিন্তু এতে আমাদের আর্থিক অবদান ছাড়া আর কি অবদান আছে? টেকনিক্যাল কোনো সাপোর্ট আছে? স্যাটেলাইট তৈরি বা মহাকাশে উড্ডয়নের পেছনে কোনো বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর অবদান আছে? দুঃখজনক হলেও সত্য তেমন কোনো অবদানই নেই। এমন অর্থ খরচ করলে উগান্ডা, সোমালিয়া এমনকি ভুটানও স্যাটেলাইটের মালিক হয়ে যাবে। মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য বলছি, আফ্রিকার কেনিয়ারও একটি স্যাটেলাইট আছে। এ ছাড়া ইউরোপের ছোট্ট দেশ লাটভিয়া ও পূর্ব এশিয়ার লাওসেরও স্যাটেলাইট আছে।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমাদের দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দিন দিন বাড়ছে। দেশে প্রতিবছর হাজার হাজার ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হচ্ছে। দেশের স্বনির্ভরতার জন্য কতটুকু অবদান তারা রাখছেন? নতুন নতুন টেকনিক্যাল জ্ঞান কতটুকু প্রসারিত হচ্ছে? দেশ বা সরকার তাদের কতটুকু সুযোগ করে দিচ্ছে? দেখা যাচ্ছে, পাস করার পর বড় একটা অংশ চলে যাচ্ছে গতানুগতিক চাকরিতে। তারা ঘুম, খাওয়া ও অফিসের উদ্ভাবনহীন কাজে নিয়োজিত। সপ্তাহান্তে চক্রাকারে চলছে। অল্প কিছু শিক্ষার্থী অবশ্য গবেষণার কাজে চলে যাচ্ছেন বিদেশে। যারা আর কোনো দিন দেশে পুরোপুরি ফিরবে বলে বিশ্বাস হয় না। আরও হতাশ হই যখন দেখি, একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার সরকারি প্রশাসন বা ব্যাংকে চাকরি করছেন। চার-পাঁচ বছরে টেকনিক্যাল জ্ঞান অর্জন করে তার পুরোটুকু অপচয়ের এমন দৃষ্টান্ত হয়তো আর নেই।
আমরা নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে অস্ত্র কিনি, যুদ্ধ সরঞ্জাম কিনি। একবারও মনে হয় না আমরাতো নিজেরাই চেষ্টা করলে এগুলো বানাতে পারি। সরকারি বা বেসরকারি বিনিয়োগে গবেষণার ব্যবস্থা করে দিলে তো পাস করা দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের অভাব নেই। বিদেশ থেকে সাবমেরিন কিনি, উড়োজাহাজ কিনি, হেলিকপ্টার কিনি। একবারও কি কোনো সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে যে আমরা একটু চেষ্টা করে দেখিতো এসব বানাতে পারি কিনা। হাজার হাজার কোটি টাকা কত দিকে সরকারের চলে যায়। বড় বড় এমন কোনো প্রকল্প কি করা যায় না? এমন কি মনে হয় না যে দল মতের ঊর্ধ্বে থেকে প্রকৃত মেধাবী খুঁজে তাদের কাজে লাগিয়ে দেখিতো তারা পারে কিনা?
আচ্ছা, আমরা যে প্রভাব বিস্তার করার জন্য এসব সরঞ্জাম বিদেশ থেকে কিনছি। অথচ যাদের কাছ থেকে কিনছি তারা কতটা প্রভাবশালী হতে পারে? তারা তো নিজেরা বানায়। তাহলে যুদ্ধাস্ত্র বাড়ানোর প্রতিযোগিতা ঠিক কার সঙ্গে? দুর্বল দেশের সঙ্গে। তারাও টাকা খরচ করলে একই সরঞ্জাম বিদেশ থেকে কিনতে পারে। বরং জেদ করলে আমাদের থেকে বেশিই কিনতে পারবে। সুতরাং এসবের থেকে ভালো নয় কী, নিজেরাই এসব বানানোর চেষ্টা করা।
সরকারি খরচে বিদেশ থেকে বাস কেনা হয়, ট্রাক কেনা হয়, ট্রেন কেনা হয়। নাট, বোল্ট, কল-কবজা সব কেনা হয়। আমাদের দেশে বুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, চুয়েট থেকে পাস করা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদেরকে কী সুযোগ করে দিলে এসব বানাতে পারে না? তারা অবশ্যই পারে। সবই তো লোহা লক্কড়ের ফাংশন। যা কিনা ক্লাসেই অধ্যয়ন করা হয়। মোদ্দাকথা, যুগোপযোগী গবেষণার ক্ষেত্র নেই দেশে। তা ছাড়া মেধাবীদের সেই সুযোগটাও করে দেওয়া হয় না। তারা নিজেরাও নিরুৎসাহিত হন গবেষণায় মন দিতে। এতে কারও সংসার চলবে না। সমাজে তেমন সম্মানও নেই। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এই সব মেধাবী ছেলেগুলো বিদেশে গিয়ে ঠিকই গবেষণাতে সফলতা অর্জন করছে। কিন্তু ততক্ষণে দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে।
আবারও জার্মানির কিছু উদাহরণ দিই। আসলে এই উদাহরণ দেওয়ার মানে এই নয় যে, দুই দেশের তুলনা করছি। তুলনার সময় এখনো হয়নি। হয়তো সুদূরে ঠিকই হবে। একটা দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে কেমন অনুভূতি হয় সে কথাগুলোই বর্ণনা করছি।
এখানে যে বাসে করে রোজ যাতায়াত করছি সেটি জার্মানির তৈরি। আপনারা বাস তৈরির কোম্পানিগুলো সবাই হয়তো চিনবেন। বিশেষ করে ‘মার্সিডিজ’ ও ‘মান’৷ বাসের ভেতরে বাইরে ডেকোরেশনসহ চাকা, গ্লাস, মিরর, ছোটখাটো তালা, গেট, স্ট্যান্ড, সিট, সিটের কাপড়, নাটবোল্ট সবই জার্মানির তৈরি। যে ট্রেনে যাতায়াত করছি তারও সব কলকবজা জার্মানির তৈরি। পথের ল্যাম্পপোস্ট, সিগন্যাল বাতি, অটোমেটিক টিকিট মেশিন, খাবারের ভেন্ডিং মেশিন, যাত্রীছাউনির খুঁটি, বেঞ্চ, কাচের ছাউনি সবই জার্মানির তৈরি। রাস্তায় কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে। সেখানে কন্সট্রাকশন বাউন্ডারি, কাজে ব্যবহার করা ক্রেন, বুলডোজার, কোদাল, ঝুড়ি, অত্যাধুনিক সরঞ্জাম ইত্যাদি সবই জার্মানির তৈরি। স্বনির্ভরতার লেভেলটা কি পর্যায়ের হতে পারে, দেখেছেন? এগুলো নিশ্চয় দৈবজ্ঞানের মধ্য দিয়ে তারা তৈরি করেনি। সবই নিরলস গবেষণার ফল। শত শত বছরের গবেষণার ফসল তারা ঘরে তুলেছে।

লেখক
লেখক

দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণি পর্যন্ত মানুষগুলো দৈনন্দিন কাজে দেশি পণ্য বেশি ব্যবহার করে। বিশেষ করে কসমেটিকস পণ্যগুলো। কিন্তু উচ্চবিত্তের মানুষ এমনকি উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষেরও ঝোঁক থাকে বিদেশি পণ্যের দিকে। আমাদের বদ্ধমূল ধারণা বিদেশি পণ্য মানেই ভালো আবার সমাজে নিজেদের একটা আলাদা আভিজাত্যও প্রকাশ পায়। কষ্টের বিষয় যে, আমাদের তৈরি পণ্য আমরা মার্কেটিংও করতে পারি না। সামান্য বদনা তৈরি করেও তার গায়ে মেড ইন চায়না লিখে দিই বিক্রি বাড়ানোর জন্য। বিদেশি কোম্পানির কৌটা ব্যবহার করে নিজেদের তৈরি ভেজাল পণ্য সেই কৌটায় ভরে ওই বিদেশি কোম্পানির নামে বিক্রির চেষ্টা করি। অথচ নিজেদের তৈরি ভেজাল পণ্যটি একটু মান উন্নত করে ভালো পণ্য তৈরির চেষ্টা বা নিজেদের নামে স্বতন্ত্র ব্র্যান্ড বানিয়ে বিক্রি করি না। নিজের সৃষ্টির প্রতি বিশ্বাস নেই। আজকে বিদেশি পণ্য নিম্নবিত্ত বা নিম্নবিত্ত মানুষ ব্যবহার করছে না। কারণ হচ্ছে এগুলোর বাজার দর অনেক বেশি। হয়তো দেশি পণ্যের দামে বিদেশি পণ্য পাওয়া গেলে কোনো মানুষই আর দেশি পণ্য ব্যবহার করত না। কারণ ওই যে বলেছি নিজেদের পণ্যের প্রতি বিশ্বাস নেই এবং মার্কেটিং পলিসি আমাদের আকৃষ্ট করতে পারে না।
দেশে এখন চার্জার অটোতে সয়লাব। শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ। সব খানেই চলে এই চার্জার অটো। সব অটো ও এর কলকবজা আসে চায়না থেকে। কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমরা কি পারি না এই সব চার্জার অটো দেশেই তৈরি করতে? আমরা পারি না! এ কথা সত্যিই বিশ্বাস করতে হবে?
কিছু দিন আগে খবর দেখলাম, ঢাকার মহাখালীতে নকল আইফোন তৈরি কারখানায় পুলিশের হানা। আচ্ছা যারা নকল আইফোন তৈরি করছে, তারা কি নিজেদের নামে নতুন ব্র্যান্ড ব্যবহার করে এমন যুগোপযোগী ফোন তৈরি করতে পারে না। এরা কিন্তু মেধাবী। কিন্তু বিপথে যাচ্ছে মেধা। গত বছর দেশে বেড়াতে গিয়ে আমার মোবাইল ফোন পকেটমার নিয়ে গিয়েছিল। থানায় জিডি করে পুলিশের পেছনে ঘোরাঘুরি করেও ফোন উদ্ধার করতে পারিনি। পুলিশের কর্মকর্তার অভিমত ছিল, চোরের সিন্ডিকেট সেই ফোনের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে ফেলেছে। সুতরাং ফোন ট্রেস করা সম্ভব না। জানি না তার অভিযোগ কতটুকু সত্য। সত্যি যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে দেখা যাচ্ছে পুলিশের থেকেও চোরের টেকনিক্যাল জ্ঞান বেশি। মানে তারাও মেধাবী মানুষ। এই মেধা কিন্তু ভালো কাজে লাগানো যেত।
বাংলাদেশে ও বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণাকেন্দ্র আছে। কিন্তু গবেষণায় সাফল্য কতটুকু? কয়টি গবেষণার ফল বাণিজ্যিক সাফল্য লাভ করেছে? বেশি ভাগই নামমাত্র গবেষণাকেন্দ্র ৷ বস্তুত সফলতা খালি চোখে অদৃশ্য।
গবেষণা যুগোপযোগী হলে সফলতা আসবেই। স্বনির্ভরতাও আসবে। সুতরাং আমরা তাদেরকেই গবেষণায় উৎসাহিত বা নিয়োগ করব যারা এসব আসলেই জানে ও বোঝে। তা না হলে গবেষণা বা বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ দিয়ে গল্প, প্রবন্ধ লেখা ছাড়া এর থেকে বেশি কিছুই হবে না। সুতরাং দলমত, স্লোগানের ঊর্ধ্বে থেকে দক্ষ ও মেধাবীদের গবেষণায় সুযোগ করে দিতে হবে। গবেষণার সুন্দর পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। আমরা আজকে ফল না পেলেও আগামী প্রজন্ম নিশ্চয় একটি স্বনির্ভর দেশ পাবে। ঘুম থেকে উঠে সারা দিনের ব্যস্ততায় দৈনন্দিন জিনিস যা ব্যবহার করবে সব হবে বাংলাদেশের তৈরি।

মাহবুব মানিক: গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি।