সূর্যোদয়ের সময়ে

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

তখনো আঁধার আছে।

সাহ্‌রি শেষ করে ফজর পড়ে ফেলেছি। প্রতিদিন শুয়ে পড়ি এ সময়। আরেকটু ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টা আর কি! সেদিন আর বিছানায় যাওয়ার সময় নেই। বেরিয়ে পড়তে হবে তখনই। দূরে যেতে হবে, চার ঘণ্টার ড্রাইভ—সেজউইক। ছোট্ট একটি শহর। আচানক কারবার হচ্ছে, দিনে দিনে আরও ছোট হচ্ছে শহরটি। জনসংখ্যা বাড়ার বদলে কমছে। আশ্চর্য! ২০০৬ সালের আদমশুমারি মতে ৮৯১ জন অধিবাসী ছিলেন এই শহরে। ২০১১ বলে, কমে হয়েছে ৮৫৭। আর ২০১৬ তে আরও কমে ৮১১ জন এখন। তবুও কী নেই শহরটিতে? একটা জাদুঘরও আছে।

রমজান মাস শুরু হয়েছে সপ্তাহ তিনেক আগে। মাসের মাঝামাঝি চলে এসেছি আমরা। স্বল্পদৈর্ঘ্য রাত আর লম্বা দিনের সুবাদে ক্ষুধা-তৃষ্ণা যতটা তার চেয়ে বেশি করে পীড়া দেয় ঘুমের স্বল্পতা। প্রতিদিনই ঘুম বকেয়া হয়ে যাচ্ছে। অনাদায়ি ঘুম হিসাবের খাতায় ক্রমশ বাড়ছে। সেদিন ওই অ্যাকাউন্টে বাড়তি কিছু বকেয়া ঘুম জমল। ভাবছি, রোজার পরে লম্বা লম্বা ঘুম দিয়ে বকেয়া উশুল করতে হবে। অবশ্য কাজটাতে আমি খুব একটা দক্ষ না। আমার স্ত্রী আবার এ কাজে ওস্তাদ রকমের পারদর্শী। বন্ধের দিনগুলোতে রাতের ঘুম টানতে টানতে সকাল পেরিয়ে দুপুরে নিয়ে ফেলে। পারেও, বাব্বা!

চোখ ডলতে ডলতে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এসবই ভাবছি। রাস্তাঘাট সুনসান, ফাঁকা। কোন পাগলে এত সকালে বের হবে? তবে প্রকৃতিতে শরীর জুড়ানো আবহ। এবারের লম্বা শীতের পর চট করেই দুঃসহ গ্রীষ্ম চলে এসেছে। রোদের তেজ গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। রাতটা সে তুলনায় অনেক ভালো। শীতল আমেজ চারদিকে। শরীরের গভীরে ভালো লাগা খুনসুটি করে তখন।
ক্যালগেরি থেকে সোজা পুব দিকে গাড়ি চলছে। ফুল ভলিউমে গানও বাজছে—‘চাঁদনি পসরে কে আমারে স্মরণ করে।’ এই মানুষটার সব গান আমার মোবাইলে ভরা আছে। গাড়িতে উঠলেই বাজতে শুরু করে—‘ও আমার উড়ালপঙ্খী রে যা যা তুই উড়াল দিয়া যা।’ বড় ভালো লাগে। একটার পর একটা। ‘যমুনার জল দেখতে কালো’। মোবাইল ভর্তি আছে ওনার গান। শুনতেই থাকি।

গানতো এখন মোবাইলেই থাকে, তাই না? মনে পড়ছে সেই গানের যন্ত্রটার কথা। প্রথম নিজের টাকায় কেনা সবচেয়ে দামি বস্তু। আহা! কী আনন্দ! ক্যাসেটের ফিতা পরিষ্কার করে কত যত্ন করে সাধের প্লেয়ারে ভরে গান শুনতাম। সেই টেপ রেকর্ডার গেল, কানে হেডফোন লাগিয়ে শোনা ওয়াকম্যানও গেল—মোবাইল সব দখলে নিল। মোবাইল কত কিছু গ্রাস করছে! অ্যানালগ-ডিজিটাল সব ক্যামেরাই হারিয়ে যাওয়ার পথে। শুনছি নিকট ভবিষ্যতে টিভিও নাকি অতলে ডুবে যাবে। মানবজীবনের এই সামান্য সময়েই কত কিছু দেখে ফেললাম। আরও কত চমক অপেক্ষা করছে কে জানে?

গাড়ি শহর ছেড়ে ফাঁকা জায়গায় চলে এসেছে। প্রেইরি বুক চিড়ে চলে যাওয়া সুতোর মতো রাস্তা। দুই ধারে মহাশূন্যসম বিস্তীর্ণ ধরণি। ভূপেনের গঙ্গার বিস্তীর্ণ দুই পাড়। মাইলের পর মাইল দৃষ্টি চলে যায়। কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই। থেকে থেকে দু–চারটা বাড়িঘর অবশ্য চোখে পড়ে। তবে এই থেকে থেকের হিসাবের ব্যবধানটা স্বাভাবিকের চাইতে যোজন যোজন বেশি। স্বাভাবিক মানে আমার দেশের কথা বলছি। রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে পাশ দিয়ে দু–একটা লরি চলে যাচ্ছে বিকট শব্দ করে। বেশ বড় লরিগুলো—রেলগাড়ির মতো বগি লাগানো আছে দুটো করে। সড়কপথের রেলগাড়ি, হা হা হা।

মামুজানের উঁকি-ঝুঁকি ঠিক তখনই। আচ্ছা, ভদ্রলোক আমার মামা কেমনে হলেন? ভেবে কোনো কূল-কিনারা করতে পারছি না। বাপ-মা-ভাইবোন-চাচা-চাচি কিছুই না। অথচ সব্বের মামা তিনি। স্বয়ং কাজীদা রগ ফুলিয়ে বলে গেছেন, ‘সূয্যি মামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে।’ অগত্যা মেনেই নিয়েছি, না মেনে উপায় আছে? চাঁদকে তো মামা ডেকেছি নাক দিয়ে সর্দি পড়ার বয়স থেকেই, ‘আয় আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা।’ তবে নজরুলের মতো আজকে কিন্তু মামুজানের আগেই আমার পৃথিবী লোকন। অথচ পৃথিবীর এতে কিছুই আসে যায় না। আমি উঠলাম, বের হলাম, পৃথিবী কিছুই বলল না। কোনো আড়ম্বরই ছিল না তখন। এদিকে যেই না গোলাকার-মামা চোখ মেলল, ধরিত্রী কেমন যেন করে উঠল। শরীর ঝাঁকিয়ে উন্মুখ হয়ে গেয়ে উঠে বসুন্ধরা—

‘এখানে সূর্য ছড়ায় অকৃপণ
দুহাতে তীব্র সোনার মতন মদ,
যে সোনার মদ পান ক’রে ধান খেত
দিকে দিকে তার গড়ে তোলে জনপদ।’

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

এই মোক্ষম সময়টাকেই তো উষা বলে, তাই না? গোধূলি নিয়ে বিস্তর লেখালেখি আছে, এন্তার সাহিত্য। তুলনায় উষা বোধ হয় ততটা স্থান পায়নি। পাবেইবা কীভাবে? কার খেয়েদেয়ে কাজ আছে মামার আগে ঘুম থেকে ওঠে। বিখ্যাত লেখকদের তো আরও সময় নেই। লিখতে লিখতে যখন শেষ রাত তখনই তাঁরা ঘুমাতে যান। আবার কারও কারও যদি রং পানি পানের দোহদ থাকে তাহলেতো কথাই নেই। আমার স্ত্রীর মতো এক ঘুমে দুপুর ছুঁই ছুঁই করে ওঠেন নিশ্চয়। কেউবা আরও পরে। সুরা পানে আসক্ত থাকুক বা না থাকুক নজরুল সাহেব সূয্যি মামা ওঠার আগেই উঠে দেখেছেন, ‘উষার ললাট-সিন্দুর-টিপ সিঁথিতে উড়াল পবনে।’

এই যে সিন্দুর টিপ, মাথার মধ্যে গেঁথে গেল সহসাই। ঠিক নাক বরাবর মামার ছড়িয়ে দেওয়া সিন্দুরের আবির। পূর্বাকাশ ঝলমল করে মাখিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। আমি বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছি। কীভাবে এর বর্ণনা দেব? প্রেইরির বাধাহীন দৃষ্টি লালের শেষবিন্দু পর্যন্ত চেখে নিচ্ছে। এ লালের উৎস না হয় বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্য। ধুলোবালির সঙ্গে মিশে তা কমলার আভা দিচ্ছে। তারপরও কোথায় কী যেন আছে? লাল-কমলার সাদামাটা বর্ণনার বাইরে বহু কিছু ঘটে যাচ্ছে এখন। কেমন যেন রঙের নাচন প্রকৃতিতে। রঙের প্রলয়ংকরী নাচন, তার সঙ্গে নিস্তব্ধতার গভীর মিতালি। মাগো! পাগল-করা অনুভূতি। জানি না শেষ কবে এভাবে সূর্যোদয় দেখেছি।

না, পারব না। এ মায়া থেকে চোখ ফেরাতে পারব না আমি। রোডসাইড টার্নআউটে গাড়ি থামিয়ে দিই আচমকা। চোখে জগতের ক্ষুধা নিয়ে তাকিয়ে থাকি একটু একটু করে জেগে ওঠা ওই লোহিত গোলকের দিকে। প্রথমে সামান্য একটু-বক্ররেখাসম। এরপর সে রেখা বড় হতে থাকে, বৃত্ত হয়ে যায় একসময়। আর সেই বৃত্ত ভর্তি আগুনের লেলিহান শিখার ওপরের অংশ। সেই শিখা এসে লাগছে আমার কপোলেও। নিশ্চয় সেই বনলতা সেন দেখার আলো এটাই। সেই সোনালি রূপ, ‘চেয়ে দ্যাখে; সোনার বলের মতো সূর্য/রুপার ডিবের মতো চাঁদের বিখ্যাত মুখ দেখা।’ অবশ্য সে ছিল গোধূলির সময়। উষা, তারই যে সতিন!

বড় অভাগা মনে হয় নিজেকে, ভীষণ কষ্ট লাগছে। ওপরওয়ালা কত কিছু করেছেন! মূষিক থেকে শুরু করে পর্বত বানিয়ে দিয়েছেন। অথচ এই অভাজনের অন্তরে দুছত্র বাংলা দিয়ে দেননি। প্রকৃতি নববধূর মতো অবগুণ্ঠনে সেজে রয়েছে। রঙের আবির মেখে সূর্য ততক্ষণে হোলি খেলা শুরু করে দিয়েছে। বিস্তীর্ণ প্রেইরি ব্যাকগ্রাউন্ডের মতো সঙ্গীহীন-সাথিহীন নিশ্চুপ। একবিন্দু কালো তিলের মতো টয়োটা ফোর-রানারের সিটে বসে আছি আমি। স্টিয়ারিংয়ে নিথর দুই হাত। প্লট তৈরি হয়ে আছে। দুই লাইন লিখে ফেলার এখনই যে শ্রেষ্ঠ সময়। হায়! এ যে হওয়ার নয়।

চারদিক ভাসিয়ে উষা আসবে। তাতো জানাই ছিল। ‘তিমির রাতের তোরণে তোরণে উষার পূর্বাভাস’ ছিল। আমি কেন চুপ ছিলাম? আমি কেন জসীমউদদীনের মতো গাইতে পারলাম না, ‘সোনালি উষার সোনামুখে তার আমার নয়ন ভরি।’ আমি নাদান ভ্যাবলার মতো বসে আছি। হাতরে-পাতরে খুঁজছি কোনো কবির কল্পনা। রঙের শিল্পের দিকে তাকিয়ে ভাবছি কোনো গানের কলি। চিত্ত মোর দুলছে, ফররুখ আহমেদের মতো—

‘নামল খোদার রহমত-ই-গাস ধূলির ধরার কলে,
নতুন উষায়, ভোরের হাওয়ায় ইনসানিয়াৎ দোলে।।’

ততক্ষণে সূর্যমামা সম্পূর্ণ চোখ মেলে দিয়েছে। পূর্ণ দৃষ্টিতে সে জগৎ ছুঁয়েছে। প্রণামে তখন কত-না মানবসন্তান ত্রস্ত-ব্যস্ত। হবেই তো, সূর্য দেবতা যে! আঁধার কেটে যে চারিদিক আলোকিত করতে পারে তাকে পুজো না করে উপায় আছে? চারদিকে আলো ছড়িয়ে প্রাণীকুলকে বাঁচিয়ে রাখে যে, দেবতা সদৃশ মান্য তাকেই মানায়। কত-না পুজো, কত-না আরাধনা তাই তাকে ঘিরে।

সূর্য অনেকেরই প্রধানতম দেবতা। মিসরীয়রা তাই জানত প্রাচীনকালে। তখনকার সূর্য-দেবতার নাম ছিল ‘রা’। অদ্ভুত ছিল তার শারীরিক গঠন। বাজপাখির মতো মুখ। মাথার ওপরে চাকতির মতন সূর্য। তারা বিশ্বাস করত আকাশের দেবী ‘নাট’ প্রতিরাতে ‘রা’–কে গিলে খায়। আবার সকালে তাঁর পুনর্জন্ম হয়। বিশ্বাসতো বিশ্বাসই, তাই না? কারও কারও ধারণা ছিল, ‘রা’ রাতের বেলা পৃথিবীর নিচ দিয়ে হেঁটে যেত। আবার সকালে ওপরে উঠে আসত। এদের ‘রা’ কিন্তু ছিল ভেড়ার মুখের মতো!

প্রাচীন মেক্সিকানদের আবার বেশ কয়েকটি সূর্য-দেবতা ছিল। কিম্ভূতকিমাকার সব নাম তাদের। গ্রিকদের ছিল বিখ্যাত অ্যাপোলো-সেই সূর্যের দেবতা। সঙ্গে আলো, সংগীত আর ভবিষ্যদ্বাণীর দেবতাও সে। সূর্য নিয়মমাফিক ওঠে, আবার নামে। তাই এর সঙ্গে নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী জড়িয়ে আছে। সূর্য আবার ধ্রুব সত্যও। তাই গ্রিকদের কাছে অ্যাপোলো সত্যেরও দেবতা। রোমানদেরও সূর্য-দেবতা ছিল-নাম, সল। ল্যাটিন ভাষায় সল শব্দের অর্থই সূর্য। তবে রোমানদের উষার দেবতা ছিল একজন-অরোরা। কী সুন্দর নামটা!

মহাগ্রন্থ রামায়ণ আর মহাভারতে উল্লেখ আছে, সূর্যের বাবা কশ্যপ, আর মা অদিতি। অদিতির সতিনের সন্তানেরা ছিল সব দৈত্য-দানব। এরা দেবতাদের নানাভাবে নিপীড়ন করতে থাকে। তখন অদিতি সূর্যের কাছে প্রার্থনা করে তাঁর সন্তান হয়ে জন্মাতে। যাতে সূর্য ভাই হয়ে জন্মে অন্য দেবতা-ভাইদের দানবদের কাছ থেকে রক্ষা করতে পারে। সূর্য সে প্রার্থনা মঞ্জুর করে সৌষুন্ন কিরণ প্রেরণ করলে অদিতি গর্ভবতী হয়। মাতা মেরিওতো এ রকমই অলৌকিক গর্ভধারণ করেছিলেন?

অদিতি-কশ্যপের পুত্র সূর্য যৌবনপ্রাপ্ত হলে বিশ্বকর্মার কন্যা সংজ্ঞার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। সংজ্ঞার গর্ভে সূর্যের তিন সন্তান আছে—বৈবস্বত মনু, যম ও যমুনা। সূর্যের তেজ বড় বেশি। তাঁর স্ত্রী সংজ্ঞা এই তেজ বেশিদিন সহ্য করতে পারে না। একদা সে নিজের অনুরূপ ছায়া সৃষ্টি করে সূর্যের কাছে রাখে। আর নিজে অশ্বির রূপ ধারণ করে উত্তর কুরুতে পালিয়ে যায়। আশ্চর্য! সেই ছায়ার গর্ভেই সূর্যের আরও তিনটি সন্তান হয়—সাবর্ণি মনু ও শনি নামে দুই পুত্র এবং তপতী নামে এক কন্যা। একসময় সূর্য সংজ্ঞার চুতুরতা বুঝতে পারে। তখন সে অশ্ব রূপ ধারণ করে সেই উত্তর করুতে গিয়ে সংজ্ঞার সঙ্গে মিলিত হয়।

লেখক
লেখক

সূর্যের যে স্ত্রী-পুত্রকন্যা আছে, পরিবার-পরিজনও আছে তা আমার জানা ছিল না। আমি ভাবতাম সূর্য বুঝি একাই। জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মতনই একা। তবে একটা প্রশ্ন সব সময়ই মনে বাজে, সূর্যকে কেন পুজো করা হতো? পুরাকালে এত এত মানুষ সূর্য-প্রণামে নিবেদিত ছিল, কারণ কী? পুরোনো শাসকদের চারধারে শহুরে নাগরিকের সন্নিবেশ ছিল। তাদের দর্শনে রাজা, রাজ্যশাসন ছিল পবিত্র কাজ। সূর্য হলো মর্ত আর পাতালের কর্তা। তাই সূর্যের প্রতিকৃতি তাদের কাছে পবিত্র শাসকের প্রতিরূপে ধরা পড়ে।

সাদা চোখে মহাকাশে সূর্যই হচ্ছে আলো আর জীবনের উৎস। ন্যায় বিচারের উৎপাদিকা। সমস্ত জ্ঞানের উৎস। সূর্য স্বাধীন, ন্যায়ায়ক, জ্ঞানী। আবার এসব গুণ শহুরে এলিট ধার্মিক শ্রেণির কেন্দ্রীয় চরিত্রও। ফলে যুগে যুগে বিভিন্ন সভ্যতার অভ্যন্তরে উন্নত সূর্য-দর্শন গড়ে ওঠে। সম্রাট-রাজারা সূর্যের শক্তি অনুসরণে শাসন করতে থাকেন। তারা দাবি করেন নিজেদের সূর্যের উত্তরসূরি হিসেবে। সূর্য-দেবতাকে পুজো, বিধাতাকে সূর্যরূপে দেখা, সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে কালক্রমে। তাই প্রধানতম দেবতা হিসেবে সূর্যের অবস্থান অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। চাওয়া-পাওয়ার আঁধার হয়ে ওঠে সে। তাইতো সুকান্ত শীতার্ত মানুষের জন্য এই সূর্য-দেবতার করুণাপ্রার্থী, ‘আজ কিন্তু আমরা তোমার অকৃপণ উত্তাপের প্রার্থী।’

ধুর! সাত সকালে কীসব দেবতা-টেবতা নিয়ে ভাবছি। তার চেয়ে বরং রোডসাইড টার্নআউটে গাড়ি থেকে বের হয়ে সোনালি গোলকের প্রথম কিরণ গায়ে মাখি। শরীরে নরম-কোমল পশমের মৃদু পরশ বুলিয়ে সূর্য-কিরণ ভালো লাগায় ভরিয়ে দিচ্ছে। আবেশিত হয়ে যাই দিনের প্রথম সূর্য-স্নানে। কোত্থেকে একঝাঁক বালিহাঁস বাতাসে রাগিণী তুলে পার হয়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। আরে! এ সময় এটিই যে হওয়ার ছিল। এই দৃশ্যপটের আবহ সংগীতরূপে বালিহাঁসের আগমন প্রকৃতিরই তৈরি। দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে পাখির শব্দ। তবুও কানে বাজছে ওদের রেখে যাওয়া শব্দতরঙ্গ। ‘জগতের মুখে আজি এ কী হাস্য হেরি! আনন্দ তরঙ্গ নাচে চন্দ্র সূর্য ঘেরি।’

ততক্ষণে মামুজান গনগনে রূপে আগ বাড়াচ্ছেন। সূর্যের তেজে শুধু সংজ্ঞা কেন সকলেই দিশেহারা। বিশেষ করে, ক্রান্তীয় থেকে বিষুবরেখার দেশে। অবশ্য যেখানেই থাকুক, সরাসরি সূর্যের দিকে তাকাতে পারে না কেউ। তাই ছোটবেলায় গ্রহণ দেখতাম কাঁসার থালায় পানি রেখে তার মধ্যে। মহাকাশে ছায়াগ্রহ রাহু ঘুরতে ঘুরতে একসময় সূর্যকে গিলে খেত। আবার সূর্য রাহুর কাটা মুণ্ডু থেকে বেরিয়েও আসত। বড় আগ্রহ নিয়ে দেখতাম তখন। এখনো মাঝেমধ্যে জলের তলে সূর্যের অবয়ব প্রত্যক্ষ করি রবীন্দ্রনাথের মতো—

‘ঝরনা, তোমার স্ফটিক জলের
স্বচ্ছ ধারা-
তাহারি মাঝারে দেখে আপনারে
সূর্য তারা।’

তখনো পুরো গনগনে হয়ে ওঠেনি সূর্য। আমি তাকিয়ে আছি স্থির দৃষ্টিতে। কোত্থেকে এক বিদঘুটে প্রেইরি ডগ এসে এদিক-ওদিক করতে থাকে। উফ! মহান শিল্প মাঝে বিদঘুটে ছুঁচো যেন। যেন শৈল্পিক ভাষার মধ্যে বিদঘুটে ব্যাকরণের বা-হাত ঢোকানো। আদতেই ব্যাকরণ সব সময় বিদঘুটে। সে বাংলা বা ইংরেজি যেই হোক। অবশ্য এ দুটির বাইরে অন্য কোনো ব্যাকরণ দেখা হয়নি। ইংরেজি ব্যাকরণে নিত্য সত্য হলো প্রেজেন্ট ইনডেফিনিট টেন্স। সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হয়, পশ্চিমে অস্ত যায়। এসব নিত্য সত্য বলে ধরে নেওয়া হতো। সূর্য কি আসলেই উদিত হয় বা অস্ত যায়? গুণ দাতো তা বলেন না,

‘সূর্য তো অস্ত যায় না,
পৃথিবী ফিরিয়ে নেয় মুখ।’

সূর্য উদয়-অস্ত না হলেও সব সময় থাকে না কিন্তু। হঠাৎ হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়। সেবার যেমন হয়েছিল। পুরো আড়াই মাস। আমি একলা একলা থাকি, সূর্য আমার কাছে নেই। তাকে ছাড়া এত দিন কেমনে থাকি? শূন্য শূন্য লাগে সব। যেন কোথাও কেউ নেই। তারপর কোনো এক প্রত্যুষে চারিদিক আলো করে তিনি চোখ মেললেন মেলবোর্ন টুলাম্যারিন এয়ারপোর্টের ইন্টারন্যাশনাল অ্যারাইভেলে। সকলেই গেয়ে উঠল তখন—

‘আজ সকালে সূর্য ওঠা সফল হলো মম
ঘরে এলে ফিরে পরবাসী প্রিয়তম।।’

সূর্য এরই মধ্যে কোমলতা-স্নিগ্ধতা ঝেড়ে কর্কশ-উষ্ণ হতে শুরু করেছে। নরমের আবহ শেষ করে গরমের ফুৎকার ছাড়ছে। ছোটবেলায় দেখা একটা বাংলা মুভির কথা মনে পড়ছে, ‘আমিওতো নারী। আমারওতো মন আছে। আমিওতো হতে পারি নরম থেকে গরম।’ গরমের আগমনে আবার গাড়িতে গিয়ে উঠি। ছেড়ে দিই টয়োটা ফোর-রানার, ঠিক নাক বরাবর পুব দিকে। গন্তব্য এখনো অনেক দূর। সূর্য দেখার আর সময় নেই।
— — —

আবু সাইদ লিপু: ক্যালগেরি, কানাডা।