ফেলে আসা সেই সব ঈদের গল্প

বাবা–মার সঙ্গে লেখক (পেছনে ডানে) ও তাঁর বড় ভাই
বাবা–মার সঙ্গে লেখক (পেছনে ডানে) ও তাঁর বড় ভাই

দেশ থেকে অত্যুৎসাহী হয়ে যখন কেউ জিজ্ঞেস করেন, ঈদের প্রস্তুতি কেমন, কী কী কিনলাম, ঈদের দিন কী কী করব, সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারি না। আসলে কোনো উত্তর নেই দেওয়ার মতো! এই প্রশ্নের উত্তরে থাকে শুধুই দীর্ঘশ্বাস এবং সঙ্গে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানোর চেষ্টা। সামনেই ঈদুল ফিতর। আমরা বলি রোজার ঈদ। প্রবাসে থেকে ঈদের দিনটা বাকি দিনগুলোর মতোই পানসে মনে হয়।

গতিশীল এই পৃথিবীতে দুরন্ত গতিতে বেড়েছে আমার বয়স। শৈশবের ফেলে আসা ঈদের রঙিন দিনগুলো আজ পরিপূর্ণ বয়সে রং হারিয়ে শুধুই স্মৃতি। হারিয়ে গিয়েছে আমার ঈদের আনন্দ, শৈশবের দুরন্তপনা। সবই এখন মৃত অতীত।
ছেলেবেলায় সব থেকে আনন্দের দিন বলতেই ছিল বছর ঘুরে আসা দুই ঈদ। তবে কোরবানির ঈদ অপেক্ষা রোজার ঈদ ছিল তুলনামূলক বেশি আনন্দের। কারণ সেখানে আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষা, চাঁদ দেখা না দেখার ওপর অনিশ্চয়তা, দুশ্চিন্তা ও আনন্দ মিশে থাকত। অন্যদিন ইফতারের সময় সম্পূর্ণ মনযোগ থাকত মুখরোচক ভাজা পোড়া খাবারে। কিন্তু উনত্রিশ রোজার ইফতারটি ছিল অনেকটা ভিন্ন ধাঁচের। সেদিন আর ইফতারে মন বসত না। কোনো রকমে নাকে মুখে পানি দিয়ে দৌড় দিতাম বাসার বাইরে। ওই মুহূর্তে কারও সাধ্য ছিল না ঘরে আটকে রাখার। বন্ধুদের নিয়ে খেলার মাঠে দৌড়ে চলে যেতাম। চলে যেতাম সেখানে, যেখানে গাছপালার ফাঁকে পশ্চিম আকাশের কার্নিশ দেখা যায়। সবাই মিলে একদৃষ্টিতে পশ্চিমে চেয়ে থাকতাম। চিকন কাঁচির মতো হলুদাভ একটা চাঁদের অপেক্ষায়! কে কার আগে দেখতে পায়। সে কী মজার প্রতিযোগিতা! ওই মুহূর্তে সবার মধ্যে তখন চাপা উত্তেজনা। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আকাশে চাঁদ খুঁজে পাচ্ছি না। চাঁদ দেখতে পেলে আজ রাতে আর ঘুম ঘুম চোখে সাহ্‌রি খেতে হবে না। আর ভোর হতেই ঈদ দরজার সম্মুখে। এটা ভাবতেই চোখ চকচক করত। মাঝে মাঝে চিৎকার করে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে থাকা মা অথবা আপুদের সঙ্গে কথা বলতাম। বিটিভিতে কি চাঁদ দেখা গেছে?
তখন অবশ্য বিটিভিতে চাঁদ দেখার ঘোষণা দেওয়ার আগেই বুঝে যেতাম চাঁদ দেখা গিয়েছে কি না। নারী উপস্থাপিকার মাথার ঘোমটা ফেলে দিলে বুঝতাম কাল ঈদ। ওই সময়ে এটাই ছিল আমাদের কাছে হাসির বিষয়। তখন কোনো সোশ্যাল মিডিয়ার অস্তিত্ব বাংলাদেশে ছিল না।
নিজে চাঁদ দেখার মজাই হতো আলাদা। যদি কেউ চাঁদ দেখতে পেত, সে তখন আমাদের মধ্যে সেলিব্রেটি। সবাই তার কাছে ঝুঁকে পড়তাম। আকাশের ঠিক কোথায় সেই কাঙ্ক্ষিত চাঁদের পজিশন।
চাঁদ দেখে বাসায় ফিরেই আগামীকালের ঈদের আয়োজন চলত। বিটিভিতে তখন কবি নজরুলের বিখ্যাত গানটি চলছে। ফুল সাউন্ডে সেই গান উপভোগ করার সময় কেমন একটা ধাক্কায় শিউরে উঠতাম। গানের প্রতিটা লাইন ও সুরের ধাঁচ বুকের ভেতরে ধাক্কা মারত। কী পবিত্র মনে হতো সেই গানের কথা ও সুর। ‘ও মোর রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’৷ গান শেষ হলেই বিটিভিতে গত ঈদের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান আনন্দমেলা শুরু হয়ে যেত। বাসায় কেউ বসে টিভি দেখত আবার কেউ ক্যাসেট প্লেয়ারে বাংলা বা হিন্দি গান শুনত৷ তবে গান যা হতো সবই হতো ঈদ বা ঈদের চাঁদ সংশ্লিষ্ট গান৷ বিটিভিতে টানা পাঁচ দিনের ঈদের অনুষ্ঠানের তালিকা মাঝে একবার দেখে নিতাম৷ হাসির নাটক বিশেষ করে হ‌ুমায়ূন আহমেদের নাটক ও হানিফ সংকেতের ইত্যাদি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ছিল সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

বড় ভাই ও তাঁর সন্তানের সঙ্গে লেখক (ডানে)
বড় ভাই ও তাঁর সন্তানের সঙ্গে লেখক (ডানে)

এর মধ্যে স্টিলের আলমারি থেকে নতুন জামার প্যাকেট আর বাটা স্যান্ডেলের খাকি রঙের বাক্সটা বের করে পুনরায় একবার দেখে নিতাম। সব ঠিক ঠাক আছে তো? ঈদ না আসা পর্যন্ত প্রতিদিনই নতুন জামার গন্ধ ও ভাঁজগুলো দেখে নেওয়া ছিল রুটিন ওয়ার্ক। নতুন বাটা স্যান্ডেলের গন্ধটা তখন অমৃতের মতো লাগত৷ কোথাও কোনো ময়লা বা ধুলা লেগে থাকলে গায়ের জামা দিয়ে মুছে ফেলতাম৷ জামা না পরেই নিজের সামনে মেলে ধরে আয়নার সামনে ঘুরে ঘুরে দাঁড়াতাম৷ নিজেকে কাল কেমন দেখাবে চোখের আন্দাজ করে ফেলতাম।
মা তখন ডাক ছাড়তেন৷ ঘরের পর্দা আর সোফার কভারগুলো লাগিয়ে ফেলো৷ রোজার যখন পনেরো থেকে বিশটা চলত, মা তখন বাসার সব পর্দা ও সোফার কভার খুলে ধুয়ে দিতেন৷ সেগুলো একদিনের মাথায় শুকিয়ে গেলেও বাসায় তখনো যথাস্থানে লাগানো হতো না৷ জানালাগুলো পর্দাহীন থাকত৷ ফোম বের করা সোফাতেই অব্যবহৃত বিছানার চাদর পেতে কয়েকটা দিন বসে কাটিয়ে দিতাম৷ চাঁদ দেখার জন্য মা অপেক্ষা করতেন৷ মায়ের কথা ছিল, বিন্দুমাত্র নোংরা বা ব্যবহার করা জিনিস চলবে না৷ চাঁদ দেখা গেলে সেই রাতেই সোফার ফোমে কভার লাগানো হতো৷ চিকন স্প্রিংয়ের নীল রঙের পাইপের সঙ্গে পর্দা টানানো হতো৷ ওই সময়ে পর্দা টানানোর জন্য এই চিকন স্প্রিংটা খুব চলত৷ সারা বছরের অন্যতম আনন্দের দিন কালকে অপেক্ষা করছে৷ লাফিয়ে–ঝাঁপিয়ে ঘর সাজাতে উঠে পড়ে লাগতাম৷ ঘরে মাকড়সার ঝুল ঝাড়া থেকে শুরু করে ফুলদানি পরিষ্কার৷ ভেজা কাপড় দিয়ে সব ফার্নিচার পরিষ্কার করতাম৷ ভেঙে যাওয়া ও রং ঝলসে যাওয়া ফার্নিচারগুলো কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখতাম৷ যাতে কোনো মেহমান দেখতে না পায় যে আমাদের ভাঙাচোরা ফার্নিচার আছে৷ মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে এই ঠুনকো মানসম্মান বাঁচানোর প্রতিযোগিতা৷ ঘরে যখন আকর্ষণীয় কিছুই থাকে না তখন ভাঙাচোরা জিনিসগুলোই এদিক সেদিক করে সাজিয়ে রেখে নিছক সম্ভ্রান্ত হওয়ার চেষ্টা।
আপুরা তখন কালকের জন্য নতুন বা ধুয়ে রাখা বিছানার চাদর বের করে রাখত৷ আব্বা ততক্ষণে সব বাজার করে নিয়ে চলে এসেছেন৷ চিনি, পোলাওয়ের চাল, ডালডা, ঘি, সেমাই, কাঁচা বাদাম, ডালডা, জাফরান কিচমিচ ও অন্যান্য সব জিনিসপত্র৷ ঘরে কেমন একটা সুগন্ধি মসলার গন্ধ ছড়িয়ে থাকত।
মায়ের কাজ ছিল শুধুই রান্নার জিনিসপত্র প্রস্তুত করে রাখা৷ আর ঘর গোছানোতে থাকতাম আমি, দাদা (বড় ভাইয়া) ও আপুরা ৷ মা রান্না ঘরে চলে যেতেন সেমাই ভাজার জন্য৷ লম্বা ঝাটার কাঠির মতো মোটা মোটা সেমাইগুলো মা ভেঙে ছোট করে ডালডা ও ঘি দিয়ে ভাজতেন৷ লাচ্ছা সেমাইগুলো ভাজা লাগত না৷ তেল চুপচুপে লাচ্ছা সেমাইয়ের প্যাকেটটা থেকে সুন্দর একটা গন্ধ আসত৷ তখনকার সময় লাচ্ছা সেমাই বলতে শুধুমাত্র আলাউদ্দিনের লাচ্ছা সেমাইই পাওয়া যেত।
সেই রাতে আমি এতটাই উৎফুল্ল থাকতাম, চোখে ঘুম বলে কিছু থাকত না। কালকের জন্য নতুন জামা, পাঞ্জাবি ও টুপি ড্রেসিং টেবিলে সাজিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতাম।
সকালবেলা ঘুম ভাঙত মায়ের ডাকে৷ মা প্রথমেই ভয় ধরিয়ে দিতেন৷ ওঠ...ওঠ দেখ নামাজ শেষ হয়ে গেল৷ সবাই চলে গেছে...তোর আব্বা বেরিয়ে গেল৷ লাফ দিয়ে উঠে দেখতাম মার হাঁকডাক পুরোটাই ধোঁকা৷ আব্বা তখনো বাথরুমে গোসল করছেন৷ নামাজের বাকি এখনো এক ঘণ্টা৷ তখন ঈদ ছিল শীতকালে৷ চরম শীতের সকাল৷ বাসার সামনের পুকুরে চলে যেতাম গোসল করতে৷ কনকনে ঠান্ডায় অনেক সাহস সঞ্চয় করে পুকুরের পানিতে একটা ডুব দিলে আর উত্তর দক্ষিণ বুঝতে পারতাম না। ছেড়ে দে মা কেন্দে বাঁচি অবস্থা৷ যত শীতই হোক যত কষ্টই হোক সানসিল্ক শ্যাম্পু আর কসকো সাবান ঈদের দিন মাখতেই হবে৷ এই দুটো জিনিস ছিল ঈদের আনন্দেরই একটি অংশ।
শীতের সকালের কনকনে বাতাসে গায়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া লোম তখনো সজাগ৷ গামছা দিয়ে মাথা, শরীর মুছেই হোসিয়ারি স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে নতুন কড়কড়ে পাঞ্জাবিটা পরে নতুন বাটা স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে ঘরের মধ্যে হেঁটে বেড়াতাম৷ পারলে একটু বিছানার ওপরেও হাঁটাহাঁটি করতাম।
আব্বা ছোট্ট পিতলের সুরমা দানি থেকে পিতলের কাঠিতে করে সুরমা নিয়ে চোখের নিচে লাগিয়ে দিতেন৷ আমি প্রথমে রাজি হতাম না কারণ তখন বিটিভিতে আলিফ লায়লা চলত৷ আর ওখানে দেখতাম দানবের মতো জিনগুলো চোখের নিচে মোটা সুরমা পড়ত, ওদের বড়ই কিম্ভূতকিমাকার দেখাত।
ঈদের দিনে দুই ধরনের পারফিউম ব্যবহার করতাম৷ একটি হচ্ছে আতর অন্যটাকে আমরা বলতাম সেন্ট৷ আতর থাকত ছোট্ট কাচের শিশিতে সেটা আবার তুলা পেঁচিয়ে ভরে রাখা হতো ছোট্ট প্লাস্টিকের কৌটাতে৷ এটি মাখতাম নামাজের আগে৷ আব্বা কাচের শিশি খুলে সেখান থেকে তুলা পাকিয়ে গোল বানিয়ে তাতে আতর লাগিয়ে আমার ও দাদার পাঞ্জাবির গলায় হাতে কবজির ওপরে ও নাকের নিচে ঘষে দিয়ে তুলাটা কানের মধ্যে গুঁজে দিতেন৷ কেমন যেন কড়া ঝাঁজালো গন্ধ৷ নাকের নিচে দিলে খুব জ্বলত৷ মা ততক্ষণে আমাদের তিনজনের জন্য অল্প করে শুকনা সেমাই ও দুধ সেমাই দিয়ে যেতেন৷ আব্বা বলতেন, ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে অল্প মিষ্টি মুখ করা সুন্নত।
সব থেকে বেশি মিস করি আব্বার হাত ধরে ঈদগাহ ময়দানে যাওয়ার সময়টায় চারপাশটা কেমন যেন পবিত্রতা বিরাজ করত৷ সবার গতিময় পা৷ লক্ষ্য ছিল ঈদের ময়দান৷ সবার কাঁধে জায়নামাজ, বিছানার চাদর, নয়তো শণের মাদুর৷ আমি, আব্বা ও দাদা তিনজনের কাঁধে তিনটা মখমলের জায়নামাজ থাকত৷ আব্বা থাকতেন আগে আমি ও দাদা তার পেছনে পাশাপাশি দুজন৷ ‘আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ৷’ আব্বা জোর গলায় এটা পড়তেন, পেছন থেকে আমি ও দাদা আব্বার সঙ্গে তাল মেলাতাম৷ ঈদের ময়দানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তখন নামাজের সময় প্রায় এগিয়ে আসত৷ লোকে লোকারণ্য চারপাশ৷ কেমন যেন আতরের গন্ধে পুরো এলাকা মাখামাখি৷ সবার মধ্যে পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার পরশ৷ ভিক্ষুকের সারি প্রধান সড়কের দুই ধারে৷ কিম্ভূতকিমাকার সব ভিক্ষুক৷ কিছু কিছু ভিক্ষুকের বীভৎসতা দেখে খুব ভয় লাগত৷ হাত নেই, পা নেই...খুব মায়া লাগত তাদের কষ্টের জীবনের কথা ভেবেই।
ইমাম সাহেব তখন ঈদের তাৎপর্য ও পবিত্রতার গুরুত্ব নিয়ে বয়ান দিতেন৷ ঈদের নামাজে দান করার জন্য একটি লাল কাপড়ের দুই মাথা ধরে দুজন যুবক সামনে দিয়ে আমার নতুন স্যান্ডেল মাড়িয়ে দিয়ে চলে যেত৷ আব্বা তাই আমাদের স্যান্ডেলগুলো কাছে এনে জায়নামাজের সামনের অংশটা গুটিয়ে রাখতেন৷ আব্বা আগে থেকেই আমাদের দুজনের হাতে দুটি করে টাকা দিয়ে রাখতেন ঈদের নামাজে দান করবার জন্য৷
ঈদের নামাজটা অন্য ওয়াক্তের নামাজ থেকে আলাদা হওয়ার দরুন সমস্যা হতো৷ প্রতি ঈদেই নামাজের অঙ্গভঙ্গিগুলো আব্বার থেকে কপি করতাম৷ আড় চোখে আব্বার দিকে তাকিয়ে থাকতাম৷ আবার আশপাশের মানুষের দিকেও নজর থাকত৷ কেউ তাল মেলাতে ভুল করছে দেখলে ফিক করে হেসে দিতাম৷ নামাজ শেষে লম্বা মোনাজাত হতো৷ সবশেষে হতো পরিচিতদের মাঝে কোলাকুলি৷ প্রথম কোলাকুলিটা সব সময় আব্বার সঙ্গে করতাম তারপরে দাদার সঙ্গে।
নামাজ শেষে প্রতি ঈদে আব্বার কাজ ছিল জিলাপি ও মিষ্টি দই কেনা৷ জিলাপি ও দই নিয়ে বাসায় আসার পর সকালের নাশতা করার পালা৷ ঈদের দিন সকালে যে নাশতাটা করি সেটা হচ্ছে জীবনে যা খেয়েছি তার মধ্যে সবচেয়ে সেরা খাবার৷ সেটা ছিল মায়ের হাতের ভুনা খিচুড়ি ও গরুর মাংস ভুনা৷ আমি খুব অবাক হই, মা অন্য দিনেও ভুনা খিচুড়ি করতেন, কিন্তু সেটা মুখরোচক হলেও ঈদের দিনের মতো এমন অমৃত হতো না৷ আজও সেই ভুনা খিচুড়ি ও গরুর মাংসের স্বাদ ভুলতে পারিনি৷ সাধারণত যেকোনো খাবার যতই মুখরোচক হয়, পেট ভরার সঙ্গে সঙ্গে মুখে স্বাদের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু মায়ের হাতের খিচুড়ি ও গরুর মাংস ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম৷ ডাইনিং টেবিলে বসে যখন খেতাম, পেট ভরে যেত, কিন্তু মুখের স্বাদ তখনো মরত না৷ আফসোস করতাম ইস পেটটা যদি আরও একটু বড় হতো৷ পেটটা সত্যিই আজ বড় হয়ে গিয়েছে৷ কিন্তু মায়ের সেই খিচুড়ি আর নেই।
জীবন থেকে আব্বা হারিয়ে গিয়েছেন৷ আব্বার সঙ্গে এই জীবনে আর কোলাকুলি করতে পারব না৷ দাদা থাকেন দেশে আর আমি জার্মানিতে৷ এবারের ঈদে আমার থেকে দাদার কষ্ট সম্ভবত বেশি হবে৷ আমি চার বছর যাবৎ আব্বার সঙ্গে ঈদের নামাজের পর কোলাকুলি করতে পারিনি৷ গত ঈদের আগে আব্বা গত হয়েছেন৷ আমার সুযোগ হয়ে ওঠেনি তার পাশে থাকার৷ গত রোজায় তিনি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গিয়েছেন৷ দাদা একা হয়ে পড়েছেন৷ হয়তো দাদা তার দুই সন্তানের মাঝেই আব্বার অস্তিত্ব খোঁজার চেষ্টা করবেন।
প্রজন্ম পরিবর্তন হয়েছে৷ দাদার দুই ছেলে দাদার পিছে৷ একই পবিত্র ধ্বনি৷ ‘আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ৷’ দাদা সামনে পেছনে তার দুই ছেলে৷ ঠিক যেমন আমরা দুই ভাই৷ আমার এখন সবাই থেকেও কেউ নেই৷ প্রবাসে পরিবার বলতেই আমি ও আমার সহধর্মিণী৷ তাঁকে নিয়েই এবারের ঈদ করতে হবে৷ পরিবারের গণ্ডির বাইরে থেকে সেও তেমন খুশি না। তার পরেও মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা৷ সরকারি ছুটি নেই৷ ঈদ যদি কর্মদিবসে পড়ে তাহলে হয়তো বাৎসরিক ছুটি থেকে একদিন ছুটি নিতে হবে৷ শৈশব থেকে আমি ও দাদা আব্বার হাত ধরে ঈদগাহে যেতাম৷ এবারের ঈদে দাদা তাঁর ছোট দুই সন্তানের হাত ধরে ঈদগাহে যাবেন।
ছেলেবেলায় দেখেছি আব্বার গতি ছিল আমাদের দুই ভাইয়ের থেকে অনেক বেশি৷ দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আব্বার গতি কমতে থাকল আর আমাদের দুই ভাইয়ের গতি তখন বাড়ন্ত৷ ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাত, পাল্টে যেত ক্যালেন্ডারের দৃশ্যপট৷ সঙ্গে যোগ হতো বয়সের ক্রমধারা৷ বছর ঘুরে ঈদ আসত আব্বার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে যেতাম পরিচিত চৌড়হাস ঈদগাহে৷ বছর ঘুরে বাড়ন্ত শরীরের তারতম্য টের পেতাম না, কখন যে এত বড় হয়ে গেলাম! বুঝতেই পারিনি৷ বিদেশে আসার আগে সর্বশেষ আব্বার সঙ্গে ঈদ করেছিলাম ২০১৪ সালে৷ তখন আব্বার মধ্যে আর সেই ছন্দ দেখিনি৷ দাদা আব্বার হাত ধরে আলতো পায়ে এগিয়ে নিয়ে যেতেন ঈদগাহের দিকে৷ সেই ঈদগাহ, সেই রাস্তা, সেই জনপদ সবই আগের মতোই আছে, শুধু মানুষগুলো বদলে গিয়েছে৷ পুরোনো মানুষগুলো চলে গিয়ে নতুন মানুষ যোগ দিয়েছে৷ এভাবেই চলছে কালের ধারা৷ এভাবেই চলছে ঈদ উৎসব।

মাহবুব মানিক: গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি।
ইমেইল: <[email protected]>