ঈদ মানে আলিঙ্গন

বাবা-মার সঙ্গে রোজার ঈদে সন্তানসহ লেখিকা
বাবা-মার সঙ্গে রোজার ঈদে সন্তানসহ লেখিকা

অস্ট্রেলিয়ায় আজ বাদে কাল ঈদ। ঈদ যেন শুধু নামের ঈদ। আবেগ ও অনুভূতিতে তার কোনো রেশ নেই। নেই বাড়ি যাওয়ার জন্য টিকিট কাটার মাতামাতি। নেই সবার জন্য ঈদের কেনাকাটা করার হুড়োহুড়ি। তা ছাড়া, বাড়ি যাওয়ার সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রাফিক জ্যামে বসে থাকার সেই তিক্ত সময়টাকেও আজ বড় মনে পড়ছে।

তখনো আমি বিরক্ত হতাম আর একই সঙ্গে বলতাম, ঈদে বাড়ি যাওয়ার সময় এটুকু বিড়ম্বনা যদি না-ই হয়, তাহলে কী আর মনে হয় ঈদ করতে যাচ্ছি। আজ যখন নয় হাজার মাইল দূরে বসে আমি এসব লিখছি, তখন একে একে সব স্মৃতিগুলো কেমন আছড়ে পড়ছে আমার মনের আঙিনায়।
আব্বা যে কতবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, এখন কোথায়। আর আমি ততবার বলতাম আমি যাচ্ছি শ্বশুরবাড়ি, আমার কত দুর যাওয়ার খোঁজ নিয়ে তোমার কি লাভ বল তো। তবু কে শোনে কার কথা। একটু পর পর তার ফোন এসেই যেত। ভালোই হয়েছে, আব্বা এবার ফোন করার দায় থেকে বেঁচে গেছেন। বেঁচে গেছেন ঈদের পরদিন সকাল থেকে পনেরো মিনিট অন্তর অন্তর আমাকে মনে করিয়ে দেওয়া, দেরি হয়ে যাচ্ছে তোমার, এখনো বের হওনি।
কে তাঁকে বোঝাবেন, আমি বাড়ির বড় বউ শুধু নই মেয়েও বটে। তাই তাদের বাড়ি থেকে চলে গেলে তাদেরও মন খারাপ হয়। সুতরাং, তাদেরও বুঝিয়ে সুজিয়ে আমাকে বাড়ির পানে ছুটতে হয়। শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলো নিতান্ত ভালো বলে রক্ষা। তাই আব্বার ব্যাকুলতা অনুভব করে সাতসকালে আমাকে দুমুঠো নাকেমুখে খাইয়ে বাবার বাড়ির উদ্দেশে পাঠিয়ে দেন।
এ বেলাতেও আব্বা স্থির থাকেন না। একটু সময় বাদে বাদে ফোন। এমনও হয়েছে, আব্বা হাবাসপুর ঘাটে এসে বসে থেকেছেন আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। নিপামনিও এবার আমার জন্য অপেক্ষা করবে না। বলবে না, ও বাড়িতে তো খুব ঘুরেছ, এবার আমাকে নিয়ে ঘুরতে চলো। আজ এসব কথা ভাবছি আর চোখ দুটো কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে।
জীবনের গতিময়তায় ঈদের আনন্দ আয়োজনে আমূল পরিবর্তন এসেছিল বিয়ের পরেই। প্রথম প্রথম আমি ভাবতাম শ্বশুরবাড়ি মানেই হয়তো ঈদের আনন্দ দ্বিগুণ। শ্বশুরবাড়ির চাঁদ রাতের মেহেদি উৎসব এ আনন্দকে আরও বহু গুন বাড়িয়ে দিত। পাড়ার ছোটবড় যত ছেলেমেয়ে আছে সবাই দল বেঁধে শামিমের জন্য অপেক্ষা করত। এমন সুন্দর করে মেহেদি দিত শামিম, যে কারণে গভীর রাত পর্যন্ত চলত এই মেহেদি উৎসব। সংসারের শামিমের নিপুণ কর্ম শৈলী চোখে পড়ার মতো। আমার যে ননদ নাই, শামিমের কারণে আজ অবধি সেটা বুঝতে পারিনি।

ঈদে শ্বশুরবাড়িতে লেখিকাসহ অন্যরা। দুই বছর আগে এক ঈদে তোলা ছবি
ঈদে শ্বশুরবাড়িতে লেখিকাসহ অন্যরা। দুই বছর আগে এক ঈদে তোলা ছবি

ঈদের দিনের সকাল শুরু হতো ভোর ছয়টায় পাঁচ পদের মিষ্টি রান্নার মধ্য দিয়ে। প্রতি ঈদে আমার রান্না সেমাই পায়েস খেয়ে আব্বা (শ্বশুর), আমার বর তথা দেবরেরা নামাজে যেতেন। এটা দীর্ঘ দিনের রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল। জানি না, আমার শূন্যতায় তাদের ঈদটা এবার কেমন হবে। নতুন ঘর তোলার কারণে আধাখোলা রান্না ঘরটা ভাঙা পড়েছে। তা না হলে আমার আনাড়ি হাতের কাঠ খড়ির জালে জ্বলা চুলোটা নিশ্চয় নীরবে-নিভৃতে আমার জন্য কাঁদত। যতই প্রাণ না থাক আমার পদধূলি তো ঠিকই টের পেত ঘরটা। রান্না করার সময় চুলোর সামনে দাঁড়িয়ে সেলিম, সোহেল ভাইয়ের বাহারি কথা আমার চুলোর আঁচে পোড়া তিন চার ঘণ্টার সমস্ত ক্লান্তি দূর করে দিত। সব ভুলে আমাদের সকলের তৃপ্তির হাসি বাড়ি মুখর করে তুলত।
সময় বদলেছে, বদলেছে মানুষগুলোও। এবার হয়তো সবাই একসঙ্গে ঈদ করার সুযোগই পাবে না। আমার আর্মি দেবরগুলো এক ঈদে ছুটি পায় তো আরেক ঈদে পায় না। কালেভদ্রে কপাল গুণে সবাই একসঙ্গে হয়েছি। এ ছাড়া ঈদের দিনের সবচেয়ে উপভোগ্য ছিল নামাজে যাওয়ার সময় আমাদের সবাইকে আব্বার দেওয়া বিশ টাকার সালামি। বিশ টাকাও যে কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে সেটা ঈদ আসলে বুঝি।
ঈদ মানে আমার কাছে শুধু ঈদ নয়। ঈদ মানে আমার কাছে কতগুলো সহজ সরল মানুষের উষ্ণ আলিঙ্গন পাওয়া। এই আলিঙ্গনকে শুধু আলিঙ্গন বললে ভুল হবে। এই আলিঙ্গন হলো, আমাকে কাছে পাওয়ার আনন্দে তাদের চোখে বর্ষা বাদল বয়ে যাওয়া। রেণু ফুপু, বিলকিস ফুপু, ঝরনা ফুপু, তাসলির মা খালা, সবাই কেমন আটপৌরে জীবনে কাঁদা মাটি, গরু ছাগল আর ঘরকন্নার কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেন। তবু, এদের গায়ের মাটির গন্ধের আলিঙ্গনের মধ্যে যে সুখ আমি পেয়েছি, তা কেন নামীদামি মানুষগুলোর আলিঙ্গনে পাই না। এ প্রশ্নের উত্তর আমি আজও পাইনি। তাই, ঘুরে ফিরে বারবার শুধু এই সাদা মনের মানুষগুলোর আলিঙ্গন পাওয়ার জন্যই আমার অবুঝ মনটা ব্যাকুল হয়ে থাকে। এই অতি সাধারণ মানুষগুলোর ভালোবাসা পেয়ে আমার একটা কথাই মনে হয়েছে, সেটা হলো, পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ কাজ হলো কাউকে ভালোবাসা। অথচ এই সহজ কাজটা করতেই আমরা সবচেয়ে বেশি কার্পণ্য বোধ করি।
আসন্ন ঈদে সুদূর পরবাসে বসে একটা কথাই বলতে চাই, ভালোবাসায় ভরপুর হোক আমাদের সকলের জীবন। ঈদ মোবারক।

লাভলী ইয়াসমীন: গজফোর্ড, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া।