প্রবাসে পরিবারহীন আরেকটি ঈদ

ঈদের নামাজ শেষে বাংলাদেশিদের সঙ্গে লেখক
ঈদের নামাজ শেষে বাংলাদেশিদের সঙ্গে লেখক

আরও একটি ঈদ উদ্‌যাপন করছি পরিবার পরিজন ছাড়া। তাদের ছাড়া একাকী ঈদ উদ্‌যাপন করা যে কতটা বেদনাদায়ক তা লিখে প্রকাশ করার মতো না। আমার কয়েকজন বন্ধু মালয়েশিয়া থাকেন। তাই এবার বন্ধুদের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপনের জন্য গতকাল মালয়েশিয়া এসেছি। সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়া আসতে দুই ঘণ্টা সময় লাগে।

মালয়েশিয়া আসার পর গতকাল বাড়িতে ফোন দেওয়ার পর ছেলে বলেছিল, আব্বু তুমি বাড়ি আসো না কেন? তোমার সঙ্গে আমি ঈদের নামাজ পড়তে যাব। তার কথা শুনে আমি প্রতি-উত্তরে কিছু বলতে পারিনি। খুব ইচ্ছে ছিল এবার পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন করব। কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে পরিবারের সকলের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন করা হলো না।
ছেলের কথা শোনার পর গতকাল ঘুমহীন ও বিভীষিকাময় ভয়াবহ রাত কাটিয়েছি। রাতে ঘুমাতে গিয়ে মনে হয়েছিল অনন্তকাল ধরে ঘুমাচ্ছি। কিন্তু চোখ খুলে দেখি কয়েক মিনিট ঘুমিয়েছি মাত্র। চোখ বন্ধ করলে দেয়াল ঘড়ির সেকেন্ডের কাটার ঠক ঠক শব্দ কানে বাজে। মনে হয়েছিল অনন্তকাল ধরে এই শব্দ বাজছে আর আমি শুনছি ঠক ঠক।
আশ্চর্য, শব্দটার সঙ্গে আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ঘড়ির ব্যাটারি খুলে রাখার পর কেমন জানি শূন্যতা অনুভব করেছি। আবারও ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা। এভাবেই আধো ঘুম, আধো জাগরণে সারা রাত কেটে গিয়েছে। এভাবেই হয়তো লাখ লাখ প্রবাসী গতকাল নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন।
আজ ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে সকালে একজন পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে দেখা। তিনি বাংলাদেশে নিজের ব্যবসা নিয়ে সুখেই জীবনযাপন করতেন। তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আমি গতকাল এখানে এসেছি, আর আজ আপনাকে দেখলাম? পরিচিত ভাই মলিন হাসি হেসে বললেন, ভাই আমাকে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে হয়। পুলিশ আমাকে প্রকাশ্যে দেখলে জেলে নিয়ে যাবে কিংবা দেশে পাঠিয়ে দেবে।
আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তার মানে আপনি এখানে অবৈধ?
—হুম আমি অবৈধভাবে মালয়েশিয়া প্রবেশ করেছি।
—আপনি শিক্ষিত মানুষ হয়ে অবৈধভাবে প্রবেশ করলেন কেন?
তিনি বিরস কণ্ঠে বললেন, এ ছাড়া উপায় ছিল না। নিজের ব্যবসায় লোকসান খেয়ে পুঁজি হারিয়ে বসেছিলাম। তাই উপায়হীন হয়ে বিদেশে এসেছি। প্রথম কাতার যাওয়ার জন্য একজনের কাছে তিন লাখ টাকা জমা দিয়েছিলাম। তিনি আমাকে কাতার পাঠাতে পারেননি তাই বাধ্য হয়ে সে টাকা তুলে সৌদি আরব যাওয়ার জন্য জমা দিই। সেখানেও এক বছর টাকা পড়ে থাকে। বাধ্য হয়ে তার কাছ থেকেও টাকা তুলে ফেলি। বেকার ছিলাম তাই বসে বসে সেই টাকা প্রায় খরচ করেছিলাম। অবশেষে উপায়হীন হয়ে একজনের পরামর্শে দুই লাখ আশি হাজার টাকা দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া প্রবেশ করি। জানেন ভাই এখানে আসার পর প্রথম এক মাস বনজঙ্গলে পালিয়ে ছিলাম। আপনাকে কী করে বোঝাব কত ভয়াবহ আমার দিনগুলি ছিল। পরে একজন বাংলাদেশির সহায়তায় এই ওয়ার্কশপে কাজ নেই। তবুও মনে শান্তি নেই। গত এক বছর যাবৎ পলাতক জীবনযাপন করছি। মনে হচ্ছে বনবাসে আছি।
তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না।

ঈদের নামাজে সমবেত বাংলাদেশিরা
ঈদের নামাজে সমবেত বাংলাদেশিরা

তার দুই চোখে অশ্রুধারা দেখে বললাম, থাক ভাই মন খারাপ করবেন না। সবই নসিবের লেখন।
আমার কথা শুনে ভাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, ওমর ভাই শৈশবে যখন কোনো মুভি কিংবা গল্পে কারও বনবাসের কথা শুনতাম তখন বুকটা কান্নায় কুঁকড়ে উঠত। রহিম রূপবান সিনেমায় রহিম-রূপবানকে বারো বছরের বনবাসে পাঠালে আমি অঝোরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম। তারা কীভাবে এত দিন পরিবার পরিজন ছেড়ে থাকবে। পরিবার পরিজন ছাড়া তো আমি একদিনও দূরে থাকার কথা চিন্তা করতে পারতাম না। আর এখন পরিবার পরিজন ছাড়া ঈদ করতে যাচ্ছি একা নির্জনে। সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি কখন না জানি পুলিশ এসে গ্রেপ্তার করে। আশ্চর্য কথা কি জানেন ওমর ভাই, যে আমি সিনেমার নায়ক-নায়িকাকে বনবাসে পাঠালে কান্নায় ভেঙে পড়তাম, সেই আমি আজ এক বছর যাবৎ পরিবার ছেড়ে প্রবাসে আছি। এত একপ্রকার বনবাসই কি বলেন?
আমি আর কথা বাড়াইনি। শুধু তিনি নন তার মতো হাজার হাজার প্রবাসী বিভিন্ন দেশে লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জলে ঈদ উদ্‌যাপন করছেন।
আর কথা না বাড়িয়ে আমরা ঈদের নামাজে পড়তে পড়তে বের হলাম। কিছু বন্ধুবান্ধব আর অপরিচিত হাজারখানিক বাংলাদেশিদের সঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে আশপাশে তাকিয়ে দেখি অধিকাংশ মুসল্লিই বাংলাদেশি। এ যেন মালয়েশিয়া নয় বাংলাদেশের একটি অংশ।
দেশ বিদেশে অবস্থানরত সকল বাংলাদেশিকে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে জানাই ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।

এম ওমর ফারুকী শিপন: সিঙ্গাপুরপ্রবাসী।