দেশে অনেকেই জানেন না এই কঠিন শ্রমের কথা

ব্ল্যাকবেরি ও রাশবেরির বাগান
ব্ল্যাকবেরি ও রাশবেরির বাগান

গাঙচিলেরা জেগে উঠছে আড়মোড়া ভেঙে। চারপাশে তখনো আঁধার। সাদা মাইক্রোবাসটায় ঠাসাঠাসি একদল ঘুমচোখো শ্রমিক। নানা জায়গা থেকে এসে একত্র হয়ে এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিল বাসস্টপে। অন্ধকারে ঘাসে ঘাসে কুয়াশার আঁচড়। হিম বাতাসে কাঁপছে আটলান্টিক মহাসাগর। বড় বড় ঢেউ। শরীর জেগে গেছে মানুষগুলোর। কিন্তু চোখ চাইছে আরও ঘুম। গাড়ি চলে আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে। পর্তুগালের দক্ষিণে জাম্বুজিরা সমুদ্র সৈকতের পাড় ঘেঁষে।

যন্ত্র গাড়ির পেটে একগাদা রক্ত মাংসের শরীর। মুখের দিকে তাকালে মায়া হয়। তাতে বিষাদের ছায়া। ধকলের ছাপ। যেন এই বুঝি জেল খেটে বেরিয়েছে। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সবাই। মাইক্রোবাসটা যেতে যেতে আরও কিছু পথ যায়। তারপর কোথাও কেউ নেই। উন্মুক্ত প্রান্তর পেরিয়ে একসময় দেখা মেলে সুবিশাল বেরির ফার্ম। সারি সারি ব্ল্যাকবেরি ও রাশবেরির গাছ। যত্ন করে গোছানো বেরিদের ঘরবাড়ি। গ্রিন হাউস।
গাড়ি থামে। একটা, দুটো, তিনটা। এভাবে বেশ কটা গাড়ি। ততক্ষণে ঘুমের রেশ কেটে গেছে ভেতরের মানুষগুলোর। হুড়মুড় করে নেমে বাঁশের ছোট ঘরে অপেক্ষা। সুপারভাইজার আসে। দলে দলে ভাগ হয়। তারপর বাসা থেকে নিয়ে আসা খাবারের পুঁটলি হাতে এগোয়। মাটির রাস্তা ধরে মূল খেতের দিকে। দল বেঁধে হাঁটে। পায়ে-পায়ে হেঁটে যায় পরিশ্রমী পিঁপড়ের দল। ভাগ্যাহত যুবকের প্রবাসী ভোরের দীর্ঘশ্বাস মিশে যায় তখন খেতের আলে।
এই ফাঁকে সূর্য উঠে যায় ওদিকে। আলোয় ভরে ওঠে চারপাশ। রাশবেরি গাছের পাতার ফাঁক গলে সে আলো ঠিকরে পড়ে রহিমের মুখে। তরুণ রহিমের বাড়ি বাংলাদেশে। তার পাশে মারিয়া, নাছির ও ক্রিস্টিনা। আরেকটু দূরে হানিফ, সুফিয়া, সুবাহসিং ও কল্পনা। মারিয়ার বাড়ি বুলগেরিয়ায়। নাছিরের বাড়ি বাংলাদেশে। সুবাহসিং ভারত, হানিফের পাকিস্তান, ক্রিস্টিনার ব্রাজিল আর কল্পনার বাড়ি নেপাল। রহিমের পাশাপাশি ততক্ষণে সূর্যের আলো গিয়ে পড়েছে বাকিদের মুখেও।
রোদের তেজ বাড়ে। সবাই ফল ছেঁড়ায় মগ্ন। হাতের গতি দ্রুত হয়। অন্যথায় পেছনে সুপারভাইজারের চিৎকার। ভা-মুস রা-পিদো। দ্রুত করো। চিৎকারের ওপর আছে টেনশন। নির্দিষ্টসংখ্যক বক্স ভালো ফল দিয়ে ভরতে হবে। টার্গেট পূরণ না হলে চাকরিও নাই হয়ে যায়। কোমরের দুপাশে দুটি বালতি। একটায় ভালো ফল। অন্যটায় খারাপ ও পচাগুলো। কষ্ট যতই হোক, চাকরি টিকিয়ে রাখতে হবে। বহু অপেক্ষা, বহু তদবির ও দৌড়ঝাঁপের ফসল এই চাকরি। এখন আরেকটা জোটানো এই মুহূর্তে দুঃস্বপ্ন। তাই মানুষগুলো রূপ নেয় যন্ত্রে। সে যন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ দুটো হাত। ফল পাড়তে থাকে।
সারি সারি রাশবেরি গাছ। ব্ল্যাকবেরি গাছ। সে সারির এপারে একজন, ওপারে একজন। ফল পাড়ে, সেই সঙ্গে কথা বলে তারা। ‘বুঝলেন ভাই, আমার ছেলেমেয়ে দুটোর কথা মনে পড়লে এসব কষ্ট আর গায়ে লাগে না। দুটোই স্কুলে পড়ছে দেশে। প্রচুর খরচ। ঈদে তো আর এবারও যেতে পারছি না!’ গাফফার মিয়ার কথা শেষ না হতেই অন্যপাশ থেকে মহিউদ্দিন বলে ওঠেন, ‘আমার মেয়েটা ভার্সিটিতে পড়ছে। এই জমানায় সবার ল্যাপটপ আছে, কিন্তু তারে একটা ল্যাপটপ কিনে দিতে পারিনি এখনো!’
গাছের সারির এপারে-ওপারে তাদের কথামালা ভেসে একাকার হয়ে যায়। কথা বলে বাকিরাও। এ দেশ-ওদেশ মিলে এখানে গড়ে ওঠে নতুন এক দেশ। না, দেশ নয়, প্রকৃত অর্থে এ বিশ্বলয় ছাপিয়ে এটা অন্য এক স্বর্গ। এখানে আদম ও ইভ হয়তো আসেন না ফলের গল্প নিয়ে, কিন্তু এদের মনের ভেতর, ভর দুপুরের খাঁ খাঁ করা রোদের ভেতর ঠিক চলে আসে অসুস্থ বাবাটা, বৃদ্ধা মাটা। ভেসে ওঠে বউটার মুখ, বাচ্চাগুলোর ডাক কানে বাজে, ভাইবোনগুলোর একেকটা আবদার আর দীর্ঘ হতে থাকে সংসারের খরচাপাতির লিস্ট।
প্লাস্টিকে মোড়ানো গ্রিন হাউস, বালু-মাটিতে ক্ষিপ্র গরম ও সুপারভাইজারের কড়া নজরদারির মাঝেও এই ফল পাড়া শ্রমিকেরা নিজেদের মাঝে গড়ে তোলেন একটা পারিবারিক বন্ধন। সে বন্ধনের শেকড় গিয়ে মিলে যায় এক স্থানে। যেখানে সবাই জীবনযুদ্ধের একেকটা সৈনিক। সবার দুঃখের গল্প শেষতক এক। সম্মান নেই। দয়া নেই। অনেকটা ঠিক এই সভ্য সমাজের আধুনিক দাস যেন তারা। সূর্য ওঠার আগে ঘর ছাড়ে। সূর্য ডুবলে ঘরে ফেরেন। মজুরি কম। কিন্তু পাশবিক খাটুনি। তবু সে অল্প মজুরি দিয়েই বেঁচে থাকেন তারা এ পৃথিবীতে। বেঁচে থাকে তাদের পরিবার। কষ্ট ও বেদনার ভাষা একত্র হয়ে মাঝে মাঝে প্রকাশ পায় তাদের চোখে ও দীর্ঘশ্বাসে। ফল ছিঁড়তে ছিঁড়তে একে অপরকে বলতে থাকে জীবনের নানা গল্প।
দুপুরে খাবারের ছুটি। সবাই বসে পড়েন মাটিতে। ঘাসের স্তূপে। পুঁটলি বের করে খান। অনেক দেশের শ্রমিকের মাঝে বাংলাদেশির সংখ্যা নেহাত কম নয়। কাজের একটা সুনামও আছে তাদের। বাংলাদেশিদের অধিকাংশই রোজা। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে এই ভিনদেশে এত লম্বা সময় রোজা রাখাটা অবাক করে বৈকি! ঈদের প্ল্যান জানতে চাইলে সেলিম বললেন, আমাদের ঈদ হয় মোবাইলে আর এই খেতের মাঝে। ডে অফ থাকলে কেউ কেউ একসঙ্গে কোথাও গিয়ে ঈদ উদ্‌যাপন করে। কিন্তু বেশির ভাগেরই ঈদ মানে কান্না। এখানে পরিবার পরিজন ছাড়া বছরের পর বছর ঈদ চলে যায়। অনেক সময় টেরও পাওয়া যায় না।

ব্ল্যাকবেরি ও রাশবেরি বাগানের একজন শ্রমিক
ব্ল্যাকবেরি ও রাশবেরি বাগানের একজন শ্রমিক

ছবি তুলতে চাই। ফিল্ম করতে চাই। কেউই রাজি হন না। অনেকের কথা, অনার্স-মাস্টার্স পড়ে এসে এখন খেতে কাজ করছি। কাজ তো কাজই। হালাল ইনকাম। এখানে লেগে থাকলে ইউরোপের বৈধ কাগজপত্র, পাসপোর্ট হয়ে যাবে। কষ্ট সহ্য করে আছি। কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এই ছবি দেশে দেখলে অনেকে হাসবে।
কিছুক্ষণ ভাবলাম, হুম! ওদের সংকোচ যৌক্তিক। সত্যিই তো! চুরি-ডাকাতি, লুটপাটে আমাদের দেশে লজ্জা নেই, যত লজ্জা সব কাজ করে খাওয়ায়। হায়রে আমাদের মনোভাব!
কথা বলতে বলতে বুঝতে পারলাম, তাদের অনেকের পরিবারও জানেন না, এই কঠিন শ্রমের কথা। অথচ তাদের টাকাটা সুবাতাস দেয় দেশের অর্থনীতির পালে। তারা একেকটা ফল পাড়েন, আর ওই দিকে বহু দূরে, পৃথিবীর অন্য প্রান্তে একটা দেশ একটু একটু করে সমৃদ্ধ হয়। একটা পরিবার চলে। একটা সমাজ চলে।
মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে কথা হয় আরও। বেশির ভাগ গল্প কান্না ও বেদনার। সংগ্রাম ও কঠিন পরিশ্রমের। কিন্তু প্রত্যয় মাখা কণ্ঠ। ধৈর্য ও পরিকল্পনায় ভরা মাথা। তপ্ত দুপুরে ঘামে ভিজে, অমানুষিক যন্ত্রণায়, না খেয়ে, না ধেয়ে তারা বুঝে গেছেন জীবনের মানে কী। শেষ পর্যন্ত আশা ও স্বপ্ন তাদের বাঁচিয়ে রাখে।

লেখক
লেখক

বেরি ফার্মের নিকটবর্তী সমুদ্র সৈকতে পর্যটকের উপচে পড়া ভিড়। সেখানে চোখ ধাঁধানো রিসোর্ট, রেস্ট হাউস, সার্ফ ক্যাম্প, হোটেল ও স্থানীয় পর্তুগিজদের ঘরবাড়ি। না, ময়লা কাপড় ও ঘামের গন্ধভরা অভিবাসী শ্রমিকদের ফার্মের কাছাকাছি কোনো জায়গা নেই থাকার। কাজ শেষ হলে তাদের আবার ঘণ্টা দেড়েকের জার্নি।
জাম্বুজিরা সৈকতের পাশে হাটি কিছুক্ষণ। আটলান্টিক দেখি। কী বিশাল জলের বিছানা। তার ওপর সূর্যের লাল হলুদ আভার আলপনা। যত দূর চোখ যায় কেবল দেখা মেলে নীল জলরাশি। হয়তো কোথাও গিয়ে আকাশ আর জল মিশে গেছে। ঢেউ প্রকাণ্ড হয়। ফুলে-ফেঁপে ওঠে সমুদ্র। তীব্র গর্জন। কেন জানি মনে হলো এ গর্জন সমুদ্রের নয়, এটা ফল পাড়িয়ে শ্রমিকদের বুকের ভেতরে লুকানো উথাল-পাতাল কান্না। ফলের বাগান থেকে সমুদ্রে এসে প্রকাশিত হচ্ছে। এদিক-ওদিক হাঁটি কিছুক্ষণ। তারপর এক সুপার মার্কেটে গিয়ে দেখি, ব্ল্যাকবেরির ছোট্ট বক্স হাতে সাদা রঙের এক ভদ্রমহিলা। ওই মার্কেট থেকেই কিনেছেন। কিন্তু আমি এই বক্সগুলোয় ফল ভরতে দেখেছি একটু আগে। কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রই। ভাবি, এই মহিলা কি জানেন এই ছোট্ট ফলের বক্সের ভেতর লুকিয়ে আছে গাফফার মিয়ার ছেলেমেয়ের খরচ, মহিউদ্দিনের মেয়ের ল্যাপটপ, রহিম, নাছির ও সেলিমসহ হাজারো শ্রমিকের আশা, শ্রম ও স্বপ্ন!
সেই ভোরের গাদাগাদি করা মাইক্রোবাসটি চলছে আবার। সূর্য ডুবে যায়। রহিম ও নাছিরসহ সব ফল পাড়িয়েরা বিভিন্ন মাইক্রোবাসে চেপে বসেন। ক্লান্ত শরীরের চোখদুটোয় ঘুম নামে আবার। বাস চলতে থাকে। পাহাড়ি রাস্তায় মৃদু ধাক্কায় ঘুম ভাঙে। চোখ খুলে দেখেন সামনে বড় পাহাড়। বাড়ি আরও দূরে। সন্ধ্যার আলো জ্বলতে শুরু করেছে। গাড়িটা ধীরে ধীরে পাহাড় ডিঙিয়ে যায়। কিন্তু কেউ জানেন না, জীবনের সামনে যে বিশাল অদৃশ্য পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে, তা কীভাবে ডিঙাবেন। কে জানে আরও কত দূর পথ তাদের বাড়ি।

সোহেল রহমান: চলচ্চিত্র নির্মাতা। পর্তুগালপ্রবাসী। ইমেইল: <[email protected]>