আসছে ঈদে দেখা হবে বাবার সঙ্গে

লেখকের মেয়ে
লেখকের মেয়ে

আমার একমাত্র মেয়ে নাফিসা আফরিন প্রিমা। ২০১৪ সালে আমি যখন মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিই তখন তার বয়স ছিল চার বছর। জন্মের পর থেকে বাবার সংস্পর্শেই বড় হয়েছে। জীবিকার তাগিদে চার বছরের মেয়েকে তার মায়ের কাছে রেখেই আসতে হলো মালয়েশিয়ায়। কোনো উপায় না পেয়ে চার বছরের ছোট্ট শিশুকে রেখে আসতে যদিও অনেক কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু পরিবার ও মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা চিন্তা এবং মেয়ের ভালোবাসাকে উপেক্ষিত করে চলে আসতে হয়েছিল সেদিন।

আসার আগে যখন লাগেজে কাপড়চোপড় ভরছিলাম তখনই মেয়ে প্রশ্ন করে বসেছিল, বাবা তুমি কোথায় যাচ্ছ? তার উত্তরে আমি বললাম অফিসের কাজে একটু বাইরে যাব। ফিরতে হয়তো দু-এক দিন লেগে যেতে পারে। তাই এসব কাপড়চোপড় নেওয়া। সেদিন মেয়েকে মিথ্যে বলে আসলেও তার বিশ্বাস ছিল বাবা তার কাছে ফিরে যাবেই যাবে। কিন্তু ভাগ্যের এমন পরিহাস, কাজের পারমিট নিয়ে মালয়েশিয়ায় এসেছি ঠিকই কিন্তু ভিসা জটিলতা আর মধ্যস্বত্বভোগীদের বেড়াজালে পড়ে আমার জীবন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। স্ত্রীকে আসার সময় কথা দিয়েছিলাম, প্রতিবছরে একবার করে হলেও বাংলাদেশ এসে তোমাদের দেখে যাব। কিন্তু আজ অবধি তা হয়ে ওঠেনি।

ঈদ আসে ঈদ যায়, কিন্তু মেয়ে আর তার বাবাকে কাছে পায় না। একটু একটু করে যখন মেয়েটি বুঝে গেল বাবা তাকে ছেড়ে দূর প্রবাসে চলে গেছে তখন থেকেই বাবার স্মৃতিকে আলিঙ্গন করে থাকত। বাবার রেখে আসা স্মৃতিগুলোকে আগলে রেখে এখনো বাবার অপেক্ষায় বসে আছে। বাবার রেখে আসা ছবিগুলোর দিকে চেয়ে চেয়ে কথা বলে এখনো। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে দূরে থাকা মানুষগুলোকে কাছে রাখলেও আমার বেলায় তা হয়ে ওঠেনি। কারণ মেয়েটিকে যখন ভিডিও কলে দেখি তখন আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। মনকে শক্ত করার উপায় থাকে না। কাজেও তখন মনোযোগ দিতে পারি না। তাই যোগাযোগটাও ছিল সীমিত। মেয়ের প্রতিটা ফোন কলে প্রশ্ন থাকত বাবা তুমি কবে আসবা দেশে? তখন উত্তরে বলতাম, এইতো সামনেই আসতেছি। এই সামনে মাসের কথা বলে বলে এত দিন সান্ত্বনা দিয়ে এলেও এখন আর সেই সান্ত্বনা দিতে পারি না।

মেয়ের সঙ্গে লেখক
মেয়ের সঙ্গে লেখক

কারণ প্রিমার বয়স এখন আট পেরিয়ে নয় বছরে পড়েছে। তাই কোন কথাটা সত্য আর কোনটা মিথ্যে সে বুঝে পেলে। এখন আর তাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে বুঝ দেওয়া যায় না।
এইতো ঈদের আগের দিন রাতে যখন মেয়ের সঙ্গে কথা হয়, তখন সে আমাকে বলে, আমাদের ক্লাসের অনেকের বাবা তো দেশের বাইরে থাকে। ঈদ আসলে তারা তো দেশে ফেরে, কিন্তু তুমি ফিরছ না কেন?
উত্তরে মেয়েকে যখন সদ্য ভিসা পাওয়ার কথা জানালাম এবং আসছে কোরবানি ঈদে দেশে যাওয়ার কথা শোনালাম তখন সে খুশিতে চিৎকার করে উঠল। এখন যেই তার কাছে জানতে চায় বাবা কবে আসবে, তার একটাই উত্তর—‘আসছে ঈদে দেখা হবে বাবার সঙ্গে’। মেয়ে আমার এখন ভেজায় খুশি এ জন্য। সে হিসাব করে গত চার বছরে যেসব উপহার সামগ্রী পায়নি বাবার কাছ থেকে তার সব কয়টার নাম উল্লেখ করে আমাকে কয়েক দিনের মধ্যে পাঠাবে। এখন আমিও অধীর আগ্রহে বসে আছি মেয়ের পাঠানো লিস্টের জন্য। তার সব কয়টা উপহারসামগ্রী কিনেই তবে এবার ফাইনালি দেশে ফিরছি।

মো. আবদুল কাদের: কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া।