জার্মান রাবার সম্মেলন

জার্মান রাবার সম্মেলনে লেকচার দিচ্ছেন লেখক
জার্মান রাবার সম্মেলনে লেকচার দিচ্ছেন লেখক

জার্মান রাবার সম্মেলন পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ আন্তর্জাতিক রাবার সম্মেলন। বিভিন্ন দেশ থেকে নামীদামি সব বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্পকারখানা, প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণাগার ও বিভিন্ন দেশের গবেষণাকেন্দ্রের গবেষকেরা এই সম্মেলনে অংশ নেন। তারা সেখানে তাদের যুগোপযোগী ও আধুনিক গবেষণাপত্র উপস্থাপনের সুযোগ পান৷

এই সম্মেলনে নিজের বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজ উপস্থাপনের জন্য এ বছর জানুয়ারি মাসের শুরুতে আবেদন করেছিলাম। এর আগে আমার অধ্যাপকের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমি তো বাংলাদেশি, আমি কি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারি? তিনি এমনিতে খুব সহজ সরল মানুষ। কবে নীতি-নৈতিকতার বিষয়ে অনড়। আমাকে বুঝিয়েই বললেন এটা অসম্ভব! তোমাকে গবেষণার সুযোগ করে দিয়েছে জার্মানি। মাস শেষে বেতন দিচ্ছে জার্মানি। তুমি যদি বক্তব্য রাখার সুযোগ পাও অবশ্যই জার্মানি তথা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্বই করতে হবে।
আমার অধ্যাপককে আগে এতটা কঠোর কখনো হতে দেখিনি। তিনি যখন দেখলেন তার কথায় আমার মুখটা শুকিয়ে গেছে, তখন আশ্বাস দিয়ে বললেন, তুমি তোমার জীবনবৃত্তান্ত ওখানে পাঠিয়ে দিয়ো। বক্তব্যের শুরুতে গবেষকের জীবনবৃত্তান্ত পড়ে শোনানো হয়। যেহেতু তোমার জন্ম ও পড়াশোনা বাংলাদেশে সুতরাং সেখানে দর্শকের সামনে তোমার বাংলাদেশের নামটা উচ্চারণ করবে। আশা করি এতটুকু শুনেও তোমার ভালো লাগবে। সঙ্গে তিনি এ কথাও যোগ করলেন, তোমাদের দেশে কোনো একজন কৃষক নাকি জার্মানির সবচেয়ে বড় পতাকা বানিয়েছে? টিভিতে দেখলাম। ওই লোক কি অনেক ধনী?
আমি কী করে তাঁকে বলি, ওই কৃষক তাঁর অনেক কিছু বিক্রি করে জার্মানির পতাকা বানিয়েছেন! তবুও বললাম মোটামুটি ধনী। মনের দিক দিয়ে তো তিনি আসলেই ধনী। নইলে পরের জন্য এমন অযাচিত ভালোবাসা হয়? সুতরাং আর যাই হোক মিথ্যা বলা হয়নি। অধ্যাপকের সঙ্গে কথা বলে সব মিলিয়ে আমার শুকনা মুখটা বেশ প্রশস্তই হয়ে গেল।
আন্তর্জাতিক রাবার সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তরুণ বৈজ্ঞানিক ক্যাটাগরিতে গবেষণা প্রদর্শনের জন্য সমগ্র ইউরোপিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৪ জন মনোনীত হয়েছেন৷ আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল সেই তালিকায় আমার নাম থাকতে পারে৷ বিভিন্ন দেশের হোমরাচোমরা মানুষগুলোর সামনে বক্তব্য রাখার সুযোগ পাব। এটা ভেবে খুব উৎফুল্ল ছিলাম৷ এপ্রিলে গিয়ে জানতে পারলাম, সত্যিই আমি সুযোগ পাচ্ছি!
তখন শুরু হলো দুশ্চিন্তা। এত বড় দর্শকসারির সামনে আমার কখনো বক্তব্য রাখার সুযোগ হয়নি। জীবনে এবারই প্রথম। দিন ঘনিয়ে জুলাই মাস চলে এল৷ সহধর্মিণীকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে গেলাম বাভারিয়া অঙ্গরাজ্যের পুরোনো শহর নুরেমবার্গে। অদ্ভুত সুন্দর, সাজানো গোছানো ও পুরোনো এই নুরেমবার্গ শহরে যেন হারিয়ে গেলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অ্যাডলফ হিটলারের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থাপনায়৷ কোথাও আবার সেই হাজার বছর আগের জার্মান রাজা মহারাজাদের যুগে৷ হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী শহর ঘুরেই এক রকম রোমাঞ্চকর অনুভূতি হলো।

জার্মান রাবার সম্মেলন চত্বরে লেখক
জার্মান রাবার সম্মেলন চত্বরে লেখক

জুলাই মাসের দুই থেকে পাঁচ তারিখ পর্যন্ত চলল জার্মান রাবার সম্মেলন৷ পৃথিবীর নামীদামি রাবার ও টায়ার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাদের যুগোপযোগী বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হলো৷ আমন্ত্রিত অতিথির সংখ্যা তিন হাজারের ওপরে৷ পুরো অনুষ্ঠান ছিল দুই ভাগে৷ বৈজ্ঞানিক লেকচার ও বৈজ্ঞানিকভাবে উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতি প্রদর্শনী।
জুলাইয়ের তিন তারিখে ছিল আমার লেকচার৷ আমার গবেষণার বিষয় ছিল নাইট্রাইল রাবারে প্রাকৃতিক প্লাস্টিসাইজার ব্যবহার করে তাকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার উপযোগী করা৷ গবেষণার বিষয়টা পরিবেশবান্ধব। তাই পরিবেশ বিপর্যয়ের এই সময়ে সাড়া পাওয়ার মতোই ব্যাপার৷ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাটাগরিতে কথা বলার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশ থেকে আমি ছাড়া আরও দুজন ভারতীয় গবেষক কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন৷ সম্মেলনে একটি জিনিস লক্ষ্য করেছি৷ ভারতীয়রা রাবার গবেষণায় বেশ এগিয়ে গেছে৷ অনেক ভারতীয় গবেষকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল৷ বেশির ভাগ গবেষকই এসেছেন খড়গপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে৷ অন্য গবেষকদের মধ্যে একজন ইরানি ও জাপানি ছাড়া বাকি সবাই সম্ভবত ইউরোপিয়ান।
তিন তারিখে দুপুর সাড়ে বারোটা পর্যন্ত চলল একের পর এক লেকচার৷ আমার লেকচার শুরু হবে দুটায়৷ মাঝখানে মধ্যাহ্নভোজের বিরতি৷ ভাবতেও ভয় লাগছিল, দর্শকসারিতে সব হেভিওয়েট দর্শক৷ ইউরোপের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, উন্নত সব গবেষণাগারের বৈজ্ঞানিক৷ মধ্যাহ্নে কিছু খেতে পারলাম না৷ গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল৷ পাতলা ডাল-ভাত হলে হয়তো গপাগপ খেতে পারতাম। কিন্তু এই মানসিক পরিস্থিতিতে শুকনা জার্মান রুটি গলাধঃকরণ কিঞ্চিৎ দুরূহ ব্যাপার বটে।
সম্মেলনে সহধর্মিণীর প্রবেশের অনুমতি নেই৷ তাঁকে রেখে এসেছি হোটেলে৷ সহধর্মিণী ফোন দিলেন৷ বললাম নার্ভাস লাগছে, কি করব? তিনি তার মতো করে লেকচার শুরু করলেন৷ পুরোটাই অবৈজ্ঞানিক লেকচার৷ এসব আজেবাজে জায়গায় ভালো উপস্থাপন না হলে কি হবে? মারবে? বকবে? ইত্যাদি বাচ্চা টাইপের সান্ত্বনা৷ যদিও তিনি জানেন, এখানে লেকচারের সুযোগ পাওয়া আমাদের মতো লোকজনের জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ এ সময় মোবাইলের শব্দে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম একটা ইমেইল এসেছে৷ আমার অধ্যাপক সেই ইমেইল করেছেন। তিনি লিখেছেন, বেস্ট অব লাক৷ সত্যি বলতে এই সম্মেলনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব আমিই করছিলাম৷ সুতরাং অধ্যাপকেরও ব্যাপারটা নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল৷
যা হোক, মাহেন্দ্রক্ষণ এগিয়ে এল৷ পৌনে দুইটা বাজে৷ ফাঁকা দর্শকসারি৷ সামনের সারিতে চেয়ারে গিয়ে বসলাম৷ এমনিতে সব লেকচারেই আমি ব্যাক বেঞ্চার৷ স্কুলজীবন থেকেই ব্যাকবেঞ্চার৷ কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের ক্লাসরুমে একেবারে শেষে গিয়ে বসতাম৷ কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে তো বসার সিটই পেতাম না। পাটকাঠির মতো শরীর নিয়ে শেষ বেঞ্চে একে ওকে চাপিয়ে কোনোরকমে বসতাম৷ বিশ্ববিদ্যালয়েও মোটামুটি পেছনের সারিতেই থাকতাম৷
অডিও সহকারী আমার জীবনবৃত্তান্ত ও ছবি দেখে আমাকে আগে থেকেই চিনতে পেরেছিলেন৷ কাছে এসে মুখের সঙ্গে ওয়্যারলেস মাইক্রোফোন গুঁজে দিলেন৷ অ্যামপ্লিফায়ার রেখে দিলেন প্যান্টের পকেটে৷ মনে হলো আমার ফুসফুসটা খুলে পকেটে রাখলেন৷ শ্বাস নেবার গতি বেড়ে গেল৷ আমার ইংরেজি বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকটি ভাষায় রূপান্তর হবে৷ ভিন্ন ভাষাভাষী সকলের বোধগম্যের জন্য এই আধুনিক ব্যবস্থা৷ ততক্ষণে শ্রোতারা মিলনায়তনে এসে চেয়ারে বসে পড়েছেন৷ চেয়ার একটিও ফাঁকা নেই। অল্প কয়েকজন চেয়ার ফাঁকা না পেয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷
উপস্থাপক ছিলেন একজন অধ্যাপক৷ তিনি আমার কানে কানে আমার নামের সঠিক উচ্চারণ কেমন হবে সেটা জেনে গেলেন৷ তিনি আরও একবার নিশ্চিত হয়ে গেলেন আমি বাংলাদেশি ও বাংলাদেশেই জন্ম নিয়েছি কিনা। আবেগেই ছিলাম৷ বাংলাদেশের নামটা বলে আবেগ আরও বাড়িয়ে দিয়ে গেলেন৷ আবেগের গতিতেই তিনবার বলে ফেললাম ইয়েস ইয়েস ইয়েস৷ হালকা-পাতলা মানুষটি এবার ছুটে গেলেন স্টেজে৷ আমি দাঁড়িয়ে রইলাম তার পাশে৷ তিনি আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে শ্রোতাদের জানাচ্ছিলেন আমার জীবনবৃত্তান্ত৷ কবে কোন তারিখে বাংলাদেশের কুষ্টিয়াতে জন্ম নিয়েছি৷ ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর ও মাস্টার্স করেছি৷ জার্মানিতে কবে এসেছি৷ কোথায় কী নিয়ে গবেষণা করছি ইত্যাদি সূচনা বক্তব্য।
সৃষ্টিকর্তায় ইচ্ছায় সব বারের মতোই এবারও আমার সকল স্নায়বিক দুর্বলতা কেটে গেল৷ শুরু করে দিলাম লেকচার৷ সব থেকে বড় সুবিধা হয়েছিল, লেকচার শুরু করতেই হলরুম প্রায় অন্ধকার হয়ে গেল৷ সাধারণত লেকচারের সময় শ্রোতার চেহারা দেখলে বক্তব্য রাখতে সমস্যা হয়৷ এ ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি৷ অন্ধকারে ভালো করে কারও মুখের আকৃতি দেখা যাচ্ছে না৷ আমাকেও ঠাহর না করে দেখা একটু কষ্টসাধ্য বটে৷ দর্শনযোগ্য বস্তু শুধুই উজ্জ্বল প্রজেক্টরের স্ক্রিন৷ যেখানে ঝুলছে আমার গবেষণার কাজ৷ লেকচার শেষে শ্রোতাদের স্বতঃস্ফূর্ত হাততালি সাহস দিল আরও একটু বাড়িয়ে৷ আগ্রহী ব্যক্তিদের কিছু সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরের উত্তর শেষ করে বিদায় নিলাম স্টেজ থেকে৷ গবেষণাময় অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ঢুকিয়ে নিলাম এই মাহেন্দ্রক্ষণ৷ এগিয়ে চলার সময়ে সামান্য হলেও সাহস জোগাবে সেই প্রত্যাশায়৷

মাহবুব মানিক: গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি।
ইমেইল: <[email protected]>