যে দেশে যেমন

লেখিকা
লেখিকা

কথায় বলে, ‘যস্মিন দেশে যদাচার’। অর্থাৎ যে দেশে যেমন রীতি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ চলে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। অসহনীয় গরমে বিদ্যুতের অভাবে কষ্ট পাওয়া, মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে মোমবাতি জ্বালিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া, এমন ‍অভিজ্ঞতা কার না হয়েছে জীবনে।

আমার এখনো মনে পড়ে, সারা সপ্তাহ টিভির সাপ্তাহিক নাটকের জন্য অপেক্ষা করার পর সময়মতো বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কষ্টের কথা। আমি যখনকার কথা বলছি, তখন এত স্যাটেলাইট চ্যানেল আর শত শত মেগা সিরিয়ালের যুগ আসেনি। চ্যানেল বলতে শুধু বিটিভি আর ধারাবাহিক নাটক বলতে সপ্তাহে একটি। দুটি নাটক পাশাপাশি চলার কারণে নাটকের পরবর্তী পর্ব দেখতে অপেক্ষা দুই সপ্তাহের। আর যখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এল, তখনই বিদ্যুৎ চলে গেল। ব্যাস, সবাই হতাশ হয়ে তারা গুনতে থাক আর বিধাতাকে ডাক। যেন বিদ্যুৎ একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। কখনো বিধাতা (নেপথ্যে বিদ্যুৎ অফিস) ফরিয়াদ শুনতে পেতেন কখনো পেতেন না।
বিদ্যুৎ অফিসকে দোষ দিয়েই বা লাভ কী। সারা দেশের চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ঘাটতি সামাল দিতে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং। শুধু কী নাটক, বহুবার লাইভ খেলার মাঝপথে বিদ্যুৎ চলে গেছে। শেষ বাঁশি বাজার আগে হয়তো আসেইনি। এতো গেল বিদ্যুৎ উপাখ্যান। নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহের ক্ষেত্রেও বড় শহরগুলোতে সমস্যা দেখা যায়। ঢাকা শহরে পানি ফুটিয়ে ফিল্টার করে তবে পান করা চলে। অথচ এ পানির আরেক নাম জীবন। পানি সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটতে পারে অথবা পানি ট্যাংকে তোলার জন্য বিদ্যুৎ না থাকতে পারে, এই আশঙ্কায় বাংলাদেশের শহরে বসবাসকারী প্রায় সকলেই জগ, কলসি বা গামলায় পানি সংরক্ষণ করে রাখেন।
গত দশ বছরে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহে বাংলাদেশ ব্যাপক উন্নতি করেছে বলতেই হয়। তবে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহে সংকট লেগেই আছে। কিন্তু আমরা যারা ১১ বছর আগের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রবাসী হয়েছি, তারা এ দেশের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সরবরাহ দেখে শুরুতে বিস্মিত হয়েছি বললে ভুল হবে না। প্রথম দিকে পানি সংরক্ষণ না করার ব্যাপারটি আমাকে ভীষণ অস্বস্তি দিত। ধীরে ধীরে এমন অবস্থা হয়েছে, ঘরে বেশির ভাগ সময় এক জগ পানিও ভরা ধাকে না। যখন দরকার তখন ট্যাপ খুললেই হলো।
কিন্তু সেদিন রাতে পানি পানের জন্য যখন ট্যাপ খুললাম, এর ব্যতিক্রম ঘটল। প্রথমে ভাবলাম বুঝি ট্যাপের সমস্যা। অন্য একটি ট্যাপ খুলে নিশ্চিত হলাম পানি আসছে না। লাইনে জমে থাকা পানিতে কোনো রকমে হাত ধোয়া হলো। কিন্তু খাবারের পানি নেই। আগের রাতে খাবার জন্য বোতল ভরেছিলাম। তাতে অর্ধেকটা ছিল। সেটুকু ভাগাভাগি করে খেলাম।
রাত দশটা বাজে। শপিং সেন্টার বন্ধ হয়ে গেছে। বাইরে ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। পানি কিনতে হলে যেতে হবে পেট্রল পাম্পে। তবে সৌভাগ্যক্রমে গাড়িতে কয়েক বোতল কেনা পানি থাকায় দোকানে যেতে হলো না। বিশ্বকাপ ফুটবল চলছে। রাত জাগলে পানির চাহিদা বেশি হবে। তাই দ্বিতীয় খেলাটি না দেখেই সেদিন ঘুমোতে গেলাম। মনের ভেতর শঙ্কা থেকেই গেল, সকালে উঠে যদি দেখি পানি আসেনি, তখন কী করব।
পরদিন সকালে পানি এসে গেল ঠিক ঠিক। কিন্তু সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্যুৎ চলে গেল। এরপর শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি। প্রথম যেবার ঝড়-বৃষ্টির রাতে ট্রান্সফরমার বার্স্ট হয়ে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল, ঘরে সেদিন একটা মোমবাতিও ছিল না। এরপর থেকে সব সময় টর্চ, মোমবাতি ও লাইটার রাখি। সন্ধ্যা নামার পরে শুরু হলো ছেলের কান্না। তার ভয় করছে। তাকে কারও বাসায় নিয়ে চল, যেখানে বিদ্যুৎ আছে। মোমবাতির আলোতে ওর ভয় যাচ্ছে না। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টির রাতে কোথায় যাব, কাকে জ্বালাব। বিদ্যুৎ না থাকলে গ্যারেজ খুলে গাড়ি বের করাও ঝামেলা। বহু কষ্টে মোবাইলের টর্চ জ্বেলে, গেম খেলে সাড়ে চার ঘণ্টা পার করলাম।
পরে ভাবলাম, যে দেশে যেমন। আমরা দেখে এসেছি লোডশেডিং নিয়মিত ঘটনা। জীবনের অংশ। এর অনেক খারাপ দিক থাকলেও একটি ভালো দিক হলো, আমাদের সব রকম পরিবেশে মানিয়ে নেবার জন্য তৈরি করেছে। তাইতো মাইক্রোওভেন না চললে গ্যাসের চুলোতে খাবার গরম করে খেতে পারছি। আমার ছেলের মতো যারা প্রবাসে জন্মেছে বা বেড়ে উঠেছে, তাদের কাছে বিদ্যুৎ না থাকাটা এতই অস্বাভাবিক যে, সহ্য করতে পারছে না। এ দেশে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের আলাদা করে শেখাতে হচ্ছে ঝড়-বৃষ্টি হলে কীভাবে আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। অর্থাৎ সারভাইবাল টেকনিক।

শর্মিষ্ঠা সাহা: পার্থ, অস্ট্রেলিয়া।