আমরা লজ্জিত

সুইন্ডে উইদারহোল্ড। একটি সাদা গাড়ি থেকে তাঁর ব্যাগটি টান দিয়ে নিয়ে যায়। ছবি: সংগৃহীত
সুইন্ডে উইদারহোল্ড। একটি সাদা গাড়ি থেকে তাঁর ব্যাগটি টান দিয়ে নিয়ে যায়। ছবি: সংগৃহীত

 এইতো কিছুদিন আগে আমার একজন সহকর্মীর ব্যাগ হারিয়ে গেল। জার্মানির হালে শহরের লোকাল ট্রেনে তিনি মনের ভুলে ব্যাগ রেখে নেমে পড়েছিলেন। সেখানে তাঁর ওয়ালেটসহ বিভিন্ন কার্ড ও গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় ডকুমেন্টস ছিল। ট্রেন চলে গেল অনেক দূরে। ব্যাগ উদ্ধার করা তখন তাঁর সাধ্যের বাইরে। তিনি ট্রেন থেকে নেমে টেনশনে পড়ে গেলেন৷ এ ঘটনা সকালের৷ সারা দিন তিনি দুশ্চিন্তা করলেন৷ তবে তিনি ট্রেনস্টেশনের একটি বিশেষ নম্বরে ফোন করে জানিয়ে রাখলেন৷ বিকেলে ট্রেনস্টেশনে গিয়ে খোঁজ করলেন৷ হারিয়ে যাওয়া জিনিস কুড়িয়ে পেলে যেখানে সবকিছু জমা রাখা হয় সেখানে গিয়ে তিনি ব্যাগ পেয়ে গেলেন৷ চোখে মুখে তাঁর রাজ্যের আনন্দ৷ নিজের নাম, পরিচয় ও বিভিন্ন তথ্য মিলিয়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তা তাঁকে তার ব্যাগ ফিরিয়ে দিলেন৷ ব্যাগের যা ছিল তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সব পেয়ে গেলেন৷

এই লেখা লেখার সময় আমার মনে পড়ে গেল, গত বছর দেশে বেড়াতে গেলে, ট্রেনের মধ্যে আমার পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা পকেটমার নিয়ে গিয়েছিল৷ সেই ফোন আর পাইনি। কিছু পার্থক্য বুঝিয়ে বলতে হয় না৷ এমনিতেই বোঝা যায়। আরও কিছুদিন আগের ঘটনা৷ আমার পরিচিত বাংলাদেশি একজন বাসের মধ্যে ভুল করে ফোন ফেলে নেমে পড়েন৷ বাস ততক্ষণে বার্লিনের পথে৷ আমার ফোন ব্যবহার করে তিনি তার নম্বরে ফোন করলেন৷ একজন জার্মান ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করলেন৷ তিনি জানালেন, বাসের মধ্যে সিটের পেছনে আটকানো অবস্থায় ফোনটি ছিল৷ ঘটনা শুনে ফোন কীভাবে তিনি পৌঁছে দেবেন সেই বিষয়ে জানতে চাইলেন৷ যার ফোন তিনি বার্লিনে থাকা তার বন্ধুকে ফোনে বলে দিলেন৷ পরে তার বন্ধু ওই জার্মান ভদ্রলোকের কাছ থেকে ফোন সংগ্রহ করেন৷

লেখক
লেখক

এমন দৃষ্টান্ত জার্মানিতে অহরহ দেখি৷ চোর বাটপার যে জার্মানিতে নেই তা নয়৷ এখানেও এরা আছে। তবে তারা কেউ এ দেশি নন। আমি নিজেও দেখেছি। প্রায় সবই অন্য দেশ থেকে এসেছেন৷ সেই দেশগুলোর নাম না হয় আজ নাই বললাম৷ যাদের পূর্বপুরুষের রক্তে জার্মান শব্দটি মিশে আছে এমন নিখাদ জার্মান চোর সত্যি বলতে কখনো চোখে পড়েনি৷ অনেক নেশাখোর জার্মান পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায় বটে, তবে এদের মধ্যে চুরি বাটপারি কখনো দেখিনি৷ বোতল কুড়িয়ে নেশার টাকা সঞ্চয় করতে দেখেছি৷ তারা অবসর সময়ে কুকুর কোলে নিয়ে আগানে বাগানে টাল হয়ে ঘুমিয়ে থাকে।
আসল প্রসঙ্গে যেতে খুব লজ্জা পাচ্ছি৷ আসলে লজ্জার কথা কীভাবে বলব বা কী করে শুরু করব বুঝতে পারছি না৷ কিছু কিছু অপরাধে পাপের বোঝা শুধু অপরাধীর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে৷ আবার কিছু অপরাধে পাপের বোঝা পুরো জাতিকেই নিতে হয়৷ লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে৷ মুখ আর ভিনদেশি মানুষকে দেখানোর মতো থাকে না৷
কয়েক দিন আগে (১৮ জুন) প্রথম আলো অনলাইনের একটি শিরোনামে আমার চোখ আটকে ছিল। সেই শিরোনাম ছিল—‘কাঁদতে কাঁদতে ঢাকা ছাড়লেন জার্মান তরুণী৷  বাংলাদেশকে ভালোবেসে বেড়াতে এসেছিলেন৷ প্রতিদানে বাংলাদেশ তার আনন্দটুকু কেড়ে নিয়ে বিমানে তুলে জার্মানি পাঠিয়ে দিল৷ ব্যাপারটা এমন, আমাদের বাসায় মেহমান এল, আমরা তাকে মেরে ধরে তার সর্বস্ব লুট করে রাস্তায় ছেড়ে এলাম! দেশের মধ্যে যেকোনো অপরাধ পরিবারের লজ্জা, বড় জোর বংশের লজ্জা৷ দেশের বাইরের অপরাধ পুরো জাতির লজ্জা৷ যখন ভিনদেশি কারও সঙ্গে অন্যায় করা হয়, সে অন্যায় আর জাতীয় পর্যায়ে থাকে না৷ পুরো জাতিকে দায় নিতে হয়৷ দেশের সব থেকে সৎ ও নির্ভেজাল মানুষকেও এই অপরাধের বোঝা বইতে হয়৷
এ খবর প্রথম আলোর মতো বাংলা পত্রিকায় এসেছে৷ এতে করে ঘটনা আমরা বাংলা ভাষাভাষী মানুষ জেনেছি৷ ইংরেজি পত্রিকাতেও নিশ্চয় এ খবর প্রকাশিত হয়েছে৷ আন্তর্জাতিক ও জার্মান পত্রিকাতেও হয়তো এ খবর প্রকাশিত হয়েছে৷ আমার জার্মান সহকর্মীরা যদি এই খবর পড়েন৷ তারা আমার দিকে কীভাবে তাকাবেন? আমিও একজন বাংলাদেশি৷ কিছু দিন আগে তারা আমাকে ভালো গবেষণার জন্য পুরস্কৃত ও সম্মানিত করেছে৷ এখন তারা আমার চেহারার মধ্যে কী ছিনতাইকারীকে দেখবে? যদিও আমাকে তারা খুব লাজুক ও নীরব প্রকৃতির মানুষ বলেই জানে। তারপরেও কী একবার হলেও আমার চেহারার মধ্যে কোনো একজন ছিনতাইকারীর ছায়া খুঁজবে? আসলে আমরা যারা প্রবাসে থাকি প্রত্যেকেই বাংলাদেশের প্রতিনিধি৷ আমরা অন্যায় করলে সেটা পুরো দেশের বদনাম তৈরি করে৷ আমরা ভালো কিছু করলে তা পুরো দেশের সম্মান বয়ে আনে।
কিছু মানুষ অপরাধ করেন অভাবে। আর কিছু মানুষ করেন স্বভাবে৷ বাংলাদেশে মনে হয় স্বভাবগত অপরাধী অনেক বেড়ে গেছে৷ যারা গাড়িতে করে ছিনতাই করে বেড়ান, এদের পেটে ভাত নেই, সেই ভাতের অভাব মেটাতে ছিনতাই করে বেড়ান, এ কথা কি বিশ্বাসযোগ্য? এমন অপরাধ হরহামেশায় ঘটছে৷ প্রতিনিয়ত ঘটছে৷ আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঘটছে৷ ব্যাপারটা আসলে আমরা-আমরাই৷ আমরা তাদের চোর বলি, ছিনতাইকারী বলি, ডাকাত বলি, সেতো আমরাই বলি৷ এসব আমাদের সয়ে গিয়েছে৷ এমন অপরাধ যদি ঘটেই থাকে আমাদের সঙ্গেই ঘটুক৷ ভিনদেশি কোনো মানুষের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটা মানে তার পরিবার জানবে, আশপাশের মানুষ জানবে, সহকর্মী বা বন্ধুরা জানবে৷ এভাবে এক এক করে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে৷ মানে সামান্য দু-একজন মানুষ পুরো দেশের সম্মানহানি করলেন৷ এরা কিন্তু দেশকে ভালো কিছু দিতে পারবেন না৷ ভালো কিছু তো দিতে তো পারলই না বরং সম্মানহানি করে ছাড়ল৷
প্রায় দুই বছর আগের কথা৷ আমার পাশের বড় একটা শহরের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ভারতীয় এক ছেলের পিএইচডি গবেষণার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন৷ তিনি কারণ দেখিয়েছিলেন ভারতে খুব বেশি ধর্ষণ হয়। তাই তার অধীনস্থ নারী গবেষকদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে তার আবেদন গ্রহণ করছেন না৷ খবরটা খুব ভাইরাল হয়েছিল৷ যদিও অধ্যাপক তাঁর আচরণের জন্য পরে ক্ষমা চেয়েছিলেন৷ গুটিকয়েক খারাপ মানুষের অপরাধ ওই শিক্ষিত ছেলেটিকেও নিতে হয়েছিল।
প্রথম আলোর খবরটি পড়ার পর মেয়েটির ফেসবুক প্রোফাইলে ঢুকেছিলাম৷ তিনি ঢাকা বেড়াতে আসছেন শুনে তার বন্ধু বা পরিচিত মানুষগুলো তার ভালো সফরের প্রত্যাশায় মন্তব্য করেছিলেন৷ তারা এখন কি বলবেন? এখন বাংলাদেশকে তারা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? পরবর্তীতে তাদের মধ্য থেকে কেউ যখন বাংলাদেশে বেড়াতে আসতে চাইবে তখন তাদের মুখের চাহনি কেমন হবে? ব্যঙ্গাত্মক, বিদ্রূপাত্মক?
বিশ্বাস করি, দেশের চৌকস পুলিশ বাহিনী মন থেকে চাইলে দেশের জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা তারা করতে পারেন না৷ সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে হলেও তারা এই অপরাধীদের ধরে আদালতের মাধ্যমে এমন শাস্তি নিশ্চিত করবেন, যেন এমন কোনো ঘটনা দ্বিতীয়বার আর না ঘটে। দেশের জন্য ভালো কিছু করার যোগ্যতা বা মেধা না থাকতে পারে, অন্তত বদনাম যেন না হয় সেটুকু লক্ষ্য রাখি৷ কোনো সুস্থ মানুষই দেশের অসম্মান দেখতে চান না।

মাহবুব মানিক: গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি। ইমেইল: <[email protected]>