চলতি পথে ক্ষণিক দেখায়

লেখিকা
লেখিকা

নিউইয়র্কে এখন চারদিকে তাতানো রোদ ও ভয়াবহ গরম। কিন্তু জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরের ভেতরে বসে বাইরের উষ্ণতা সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। কী অদ্ভুত ব্যাপার। বিমানবন্দরের কাচের দেয়ালের ওপাশে শরীর পুড়ে যাওয়া গরম। ভেতরে হাড়কাঁপানো শীত। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে এমনটি আগেই জানতাম। তাই সঙ্গে করে শীতের কাপড় আনতে ভুলিনি।

দীর্ঘ যাত্রাপথের সাথি হিসেবে সঙ্গে আছে কিছু বই। বোর্ডিং কার্ড নিয়ে ওয়েটিং এরিয়ায় অন্য সকল যাত্রীদের সঙ্গে আমিও অপেক্ষায়। কেউ ঝিমোচ্ছেন, কেউবা ফোনের স্ক্রিনে মগ্ন। কেউ বইয়ের মাঝে ডুবে আছেন। আমি শেষের দলে। কিন্তু খুব মনোযোগী হতে পারছিলাম না। পাশেই মধ্যবয়সী নরনারী ফিসফিস করে কথা বলে চলছেন। একে অপরকে আলিঙ্গন করছেন। সম্ভবত একজন অন্যজনকে বিদায় জানাতে এসেছেন।
পড়ছিলাম জীবনানন্দ দাশ।

‘উড়ে উড়ে ঘর ছেড়ে কত দিকে গিয়েছে সে ভেসে
নীড়ের মতন বুকে একবার তার মুখ গুঁজে
ঘুমাতে চেয়েছে, তবু—ব্যথা পেয়ে গেছে ফেঁসে
তখন ভোরের রোদে আকাশে মেঘের ঠোঁট উঠেছিল হেসে!’

—তুমি কি ইতিহাদ এয়ারওয়েজের যাত্রী?
প্রশ্ন শুনে বই থেকে মুখ তুলে ফিরে তাকাই। সেই নারী। সঙ্গের ভদ্রলোক নেই। হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ি।
—তুমি কি আবুধাবি যাচ্ছ?
বই বন্ধ করে ব্যাগে রাখতে রাখতে বলি, হ্যাঁ।
—আমিও সেদিকেই যাচ্ছি।
বললেন বাদামি নয়নের নারী। ঠিক শ্বেতাঙ্গও নয়। দেখতে অনেকটা আইরিশ মনে হচ্ছে।
—ওদিকটায় ভ্যাকেশন কাটাতে যাচ্ছ বুঝি?
প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে উত্তরের অপেক্ষা না করেই জানালেন, তিনি খুব উত্তেজিত। একুশ বছর পর তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডোতে পড়াকালের প্রেমিক। যিনি বাবার অসুস্থতার সংবাদে দেশে গিয়ে ইমিগ্রেশন জটিলতায় আর ফিরে আসতে পারেনি। ফেসবুকের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া এবং সেই সুবাদে দেখা করতে যাওয়া। বিমানবন্দরে তাঁকে বিদায় দিতে সঙ্গে এসেছেন তাঁর স্বামী।
আমার বাঙালি মন। একটু অবাকই হলাম বটে! পুরোনো প্রেমিকের সঙ্গে দীর্ঘদিন বাদে দেখা করতে যাচ্ছেন স্ত্রী। আর তাঁকে প্লেনে তুলে দিতে এসেছেন স্বামী।
এলিস, এলিস বলে অদূরে দুই হাতে দুই কাপ কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্বামীর দিকে তাকান সেই ভদ্রমহিলা। কানে হেডফোন লাগিয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে যেতে যেতে আমায় গুডবাই জানান। একরাশ বিস্ময় নিয়ে আমি তাঁর চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে থাকি। স্পিকারে ঘোষণা ভেসে আসছে। আমারও ওঠার সময় হয়েছে। সিকিউরিটি চেকআপ সেরে বিমানবন্দরের স্বচ্ছ, ঝকঝকে পথ ধরে অপেক্ষমাণ প্লেনের দিকে হাঁটছি। ভাবছি, পৃথিবীতে কিছু মানুষের ভেতরটা হয়তো এমনই ঝকঝকে, স্বচ্ছ ও উদার। কিংবা সত্যিকারের ভালোবাসা মানুষকে মহৎ করে তোলে হয়তো।
সেই কবে স্কুলে পড়াকালে লুকিয়ে পড়েছিলাম, ‘লা নুই বেঙ্গলি’ ও ‘ন হন্যতে’ বই দুটি। বহু বছর বাদে মনে পড়ে গেল সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা গল্প দুটি। গল্পের লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবী যখন বেয়াল্লিশ বছর পর তাঁর এক সময়কার প্রেমিক মির্চা এলিয়াদের সঙ্গে দেখা করতে ভারত থেকে উডল্যান্ড যাচ্ছিলেন, তখনো তাঁর স্বামীই তাঁকে বিমানবন্দরে বিদায় জানিয়েছিলেন। স্বামীর উৎসাহেই তাঁর এই যাত্রা। বিমানবন্দরে আবেগাপ্লুত মৈত্রেয়ী দেবী স্বামীকে বলেছিলেন, ‘সারা জীবন তুমি আমায় এত স্বাধীনতা দিয়েছ।’ জবাবে মৃদু হেসে ঈর্ষা ও সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকা মহান হৃদয়ের সেই স্বামী বলেছিলেন, ‘তোমার স্বাধীনতা কি আমার পকেটে থাকে যে মাঝে মাঝে বের করে দেব? তোমার স্বাধীনতা তোমারই বস্তু।’
কী অদ্ভুত সুন্দর না কথাগুলো?

রিমি রুম্মান: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।