সম্প্রসারিত পরিবার এক

মনোজ কান্তি ও তাঁর পরিবার
মনোজ কান্তি ও তাঁর পরিবার

মনোজ কান্তি পাল ভালোবাসার কথা বললেন। এ ভালোবাসা তাঁর ভাইবোনের প্রতি। এ অনুভব আত্মীয়স্বজন হয়ে তাঁর সহগামী যাঁরা, তাঁদের উদ্দেশ্যে। তাঁদের ধরে যত তাঁর কর্মকাণ্ড। এ কারণে বারবার তাঁদের স্মরণ করেন। সুযোগ হলে তাঁদের নিয়ে বসেন। সেদিনও তিনি একটি আসর বসিয়েছেন। উপলক্ষ তাঁর ভাইবোন।

এই আয়োজনেই কথা বলছি। প্রকৌশলী সুব্রত মজুমদার কানাডার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। ফ্রান্সের এক বৃদ্ধ মাতা। দেখা তাঁর বাইরে কোনো একটি খোলা জায়গায়। কথা জমিয়ে তোলেন। তোমাদের ছেলেমেয়ে কোথায়? তোমরা মা-বাবা? তাঁরা কি এখনো তোমাদের সঙ্গে আছেন? কী এক আকুলতা! আমার কথায় গভীর বিস্ময় তাঁর! বলেন, তোমাদের ভারতীয়দের বেলাতেই এমনটি সম্ভব। তিনি দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়েন। সুব্রত ভারতের নন, বাংলাদেশের চাঁদপুর তাঁর জন্মস্থান। তবে উৎসের উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই বন্ধনটি বাঙালিদের মধ্যে এখনো শক্তিশালী। হৃদয় থেকে বেজে ওঠে গান। ‘ভাইয়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ, ওমা তোমার চরণ দুটি, বক্ষে আমার ধরি, আমার এই দেশেতে জন্ম, যেন এই দেশেতে মরি।’
একই টেবিলে আরও আছেন প্রকৌশলী হিরেন্দ্রনাথ দেব ও প্রকৌশলী বিজয় কৃষ্ণ মণ্ডল। তাঁরা দুবাই থেকে এসেছেন। আলোচনা জমে ওঠে। এ ক্ষেত্রে আমি বিদগ্ধ শ্রোতার মোড়কটি ভাঙতে চাইনি।

আয়োজনে কিশোরীরা
আয়োজনে কিশোরীরা

মনোজকান্তি প্রকৌশলীদের নিয়ে বসেন, গল্প করেন। তাঁদের জীবন জগৎ সম্পর্কে জানার কৌতূহল তাঁর। এই টেবিলে আজও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। আপনারা কে জ্যেষ্ঠ, কে কনিষ্ঠ, জানতে উৎসুক তিনি। উত্তরটি মিলে যায় সহজে। প্রথম তিনজন যার যার সময়ে আহসান উল্লাহ হলের ছাত্র। কনিষ্ঠজন সোহরাওয়ার্দী হলের। ভর্তি পরীক্ষার প্রসঙ্গটি এল। একজন বললেন, চলছে আগের মতোই। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসেছেন এঁরা। আর একজনের মন্তব্যটি বড়ই মধুর! পরিচ্ছন্ন একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় বলেই ওই প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ হয়েছে। মনোজ চমৎকৃত হন। আলোচনা বসে থাকে না। প্রকৌশলীরা তাঁর প্রাণের ভোমর। তাঁদের প্রশংসায় তিনি পঞ্চমুখ। সে প্রকাশ যেন তাঁরই খোলা পাতার পঙ্‌ক্তিমালা। তিনি লেখেন। তাঁর চিন্তাভাবনা ব্যতিক্রমধর্মী। আগে পরে বিজয় বলেন, কথাগুলো।
স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বড় হতে পারে না। তাঁর স্বপ্ন ছিল। তিনি স্বপ্ন নিয়ে আসেন এই দেশে। কিন্তু সে পথ মসৃণ ছিল না। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি জয়ী। মনোজ তাঁর এই জয় বার্তা তুলে ধরতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রকৌশলীসহ একঝাঁক পরিশ্রমী মানুষের প্রতি। প্রকৌশলী হিরেন্দ্রনাথ দেব আছেন তাঁর কোম্পানিতে। এ প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, বারো বছর হলো। নিজের পরিবারকে এখন ওই পরিবারের অংশ ছাড়া আর ভাবতে পারি না।
আবুধাবি থেকে অনেক পেয়েছি আমি, বলেন মনোজ। এখানেই বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে তাঁর মতবিনিময় হয়। প্রকৌশলীরা এখানে তাঁকে দিয়েছেন অভাবনীয় সমর্থন। দেশ-বিদেশের মানুষের সঙ্গে বসবার সুযোগ হয়েছে তাঁর। ভিন্ন জেলা বা অন্য এলাকার মানুষের সঙ্গে সহ-অবস্থানকে আনন্দদায়ক বলে বর্ণনা করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে আত্মীয়রা
অনুষ্ঠানে আত্মীয়রা

মনোজ বলেন, কঠিন বাস্তবতা ছিল সামনে। তবে দুঃসময়ে দেশ থেকে তাঁর ভাইবোনদের কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন মানসিক শক্তি। তাঁরা কোনো কিছুর জন্য কখনো চাপে রাখেননি। এখন সামনে এসেছে ভাগনেরা। তাঁরাও প্রকৌশলী। প্রকৌশলী সুজন পাল ও প্রকৌশলী রাজীব পাল সে নাম। এ কাতারে আছেন কানাডার রায়ারসন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক প্রকৌশলী প্রিতম পাল।
তিনি কর্মে বিশ্বাস করেন। একটি ধর্মীয় পরিচয় আছে তাঁর। বলেন, বিপদে পড়লে কেবল ঈশ্বর নয়। ঈশ্বরকে স্মরণ করতে হয় কাজ করার মধ্য দিয়ে। কাজ কর, উন্নতি করবে, যেতে পারবে যে কোনো উচ্চতায়, ঈশ্বর সন্তুষ্ট হবেন। এটাই ধর্ম, বলেন তিনি।
আষাঢ়ের ঢল চিত্র প্রতিফলিত তাঁর কথায়। ধান জলে ডুবে গেছে। কাঁচি নিয়ে গেছেন জমিতে। সেই ধান সেদ্ধ করে শুকিয়ে বের করা হয়েছে চাল। তাতে পুরো পরিবারের উদরপূর্তি হয়েছে একই দিনে। বলেন, বাঁশের ঘর ছিল তাঁদের। হয়তো একটু বিনয় থেকে দিয়েছেন তথ্যগুলো। তবে এক ধরনের পরিবর্তন চাইতেন তিনি। তাইতো কর্মের হাত থেমে থাকেনি। স্নাতক পর্ব শেষ করে চাকরি নিয়েছিলেন দেশে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের হাতছানি তাঁকে সুস্থির থাকতে দেয়নি। বাস্তবতা এমনই যে, এসে পড়লেন বিপাকে। বালির শহর। শুষ্কতা চতুর্দিকে। তারপর প্রযুক্তির ওপর কোনো লেখাপড়া নেই। মাথায় আসে ঠিকাদারি করবেন। কিন্তু টাকা! কোনো কায়দায় একজনের কাছ থেকে কিছু দিরহাম নিয়ে খলিফা সিটিতে একটি কাজ নিলেন। এক পাশ থেকে অন্য পাশে মাটি ফেলতে হবে। এই তাঁর শুরু। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি।

অনুষ্ঠানে আত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ীরা
অনুষ্ঠানে আত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ীরা

তিনি তাঁর ছাত্র জীবনের অনটনের চিত্রটি তুলে ধরেন। অনেকের জীবনেই এই সত্যটির চেহারা এক। কেউ বলেন, কেউ বলেন না। মনোজ বলার পক্ষের একজন। পরীক্ষার ফি দিতে বেগ পেতে হয় তাঁকে। সে এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা, বলেন তিনি। পরক্ষণেই তিনি জানান সুখের বার্তা। ১৯৮০ সালে এসেছেন এই দেশে। প্রথম দুই তিন মাস দেখতে দেখতে চলে যায়। তারপর অবশ্য ঠিকাদারিতে মাস দুই পরে তাঁর হাতে কিছু টাকা আসে। বলেন, তখন পরিবারের জন্য বাংলাদেশি মুদ্রায় পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন, সঙ্গে পাঁচ গজ কাপড়। এর মধ্যে ছিল স্বজনদের প্রতি ভালোবাসা। তিনি তাঁর সুখস্মৃতি গভীর আবেগে উপভোগ করেন।
পৃথিবীতে যতগুলো মধুর সম্পর্ক আছে, এর মাঝে ভাই বোন সম্পর্কটি স্বর্গীয়। তুচ্ছ কারণে ঝগড়া মারামারি, খুনসুটিতে কেটে যায় সারা দিন। এ ঝগড়া ভালোবাসার। বোন ছোট হলে তো কথাই নেই। এই পিচ্চি চৌকিটা টেনে আনত, একটু বসি। এই পুঁচকে বইগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, গুছিয়ে রাখিস! ওই মুটকু, দুদিন বাদে চলে যাবি শ্বশুরবাড়ি, তখন চাইলেও কিছু করার থাকবে না। ওমা, এ যেন তার কল্যাণে মনে করিয়ে দেওয়া! একেবারে সুনির্দিষ্ট বয়ান। লুঙ্গিটা ধুয়ে দিস তো! এই পল্লির এই ভালোবাসার বোনরাও অন্য রকম। কোনো কিছুতেই না নেই। সবকিছু করে দেয়। গভীর ভালোবাসে বলেই এটা সম্ভব হয়। বড় ভাইয়ের বিয়ে হলে নতুন বউয়ের জন্য তাকে কিছু সময় দিতে হয়। বোনেরা প্রথমই মেনে নিতে চায় না। কিন্তু তাদেরও বুঝতে হবে। নতুন ভ্রাতৃবধূ সেও একটা নারী। তারও অধিকার আছে। এ সময় প্রয়োজন একটু সহিষ্ণুতা।

অনুষ্ঠানে আত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ীরা
অনুষ্ঠানে আত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ীরা

বয়স বাড়লে যার যার জগৎ আলাদা হয়ে যায়। প্রত্যেকে তার স্বামী সন্তান নিয়ে সাজায় অন্য ভুবন। এ বয়সেও সতর্কতার প্রয়োজন। হ্যাঁ, অনেক কিছু ঘটে, তবে তার মীমাংসাও হয়ে যায়। এটাই ভাই-বোন। এটাই মধুরতম সম্পর্ক। এই পর্যায়ে সময় হয় না তবে অনুষ্ঠানে সবার সঙ্গে দেখা হওয়া নিশ্চিত করতে হয়। একজন আরেকজনের কাছে আসতে হয়। মেলে ধরতে হয় বাস্তবতাকে। এর মধ্য দিয়ে সম্পর্কের নবায়ন ঘটে। মনোজ কান্তি আজকে সেই কাজটিই করলেন। কী চমৎকার একটা সময়ই না উপহার দিলেন! সবাই এক সঙ্গে মঞ্চে এলেন। একঝাঁক ক্যামেরা জ্বলে উঠল।

অনুষ্ঠানে নারীরা
অনুষ্ঠানে নারীরা

অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ১৪ জুলাই শুক্রবার। আবুধাবির ফুড ল্যান্ড রেস্টুরেন্টের তিন নম্বর হলে। আয়োজনে একটি আলোচনা পর্ব যুক্ত করা হয়। এতে অতিথিরা মনোজ পরিবারের মঙ্গল কামনা করেন। পর্বটি পরিচালনা করেন আশিস বড়ুয়া।
তাঁর চার বোন। দুই বোন সংসার নিয়ে দীর্ঘদিন এখানে থাকার পর এখন তাঁরা কানাডাবাসী। দুই বোনের দুই বর চাকরি করেছেন তাঁরই কোম্পানিতে। সহোদর ডা. বিকাশ পাল। তিনি বাংলাদেশে চাকরি করেন। তবে প্রায় প্রতি ছয় মাসে বিচরণ এই আরব আমিরাতে। আজ তাঁরই সহধর্মিণী প্রকৌশলী প্রিয়াঙ্কা এসেছেন এই আসরে। সঙ্গে তাঁদের প্রিয়তম দুই সন্তান—দ্বীপান্বিতা ও শাশ্বত। দেশ থেকে আনা হয়েছে তাঁদের দুই বোন দেবী রানি ও রত্না পালকে। বড় ভাইয়ের আদরে তাঁরা আজ সিক্ত। একইভাবে ছোট ভাইও আনন্দিত।

আনন্দময় সময়
আনন্দময় সময়

মনোজ পাল বললেন, আমি সুখী। আবার একই কথা। বাঁশের ঘর থেকে ইটের দালান। এই ফিরিস্তির পরিসীমা টানলে দুবাই কিংবা আবুধাবিকে স্পর্শ করে। দুবাইয়ের হরাইজন টাওয়ার কে না চেনে? এরই ৬ ও ৩৮ তলায় তাঁর ফ্ল্যাট বাড়ি। তাঁর বাড়ি আবুধাবির রিম আইল্যান্ডে।
তিনি আবার এলেন সবার কাছে। শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। তিনি তাঁদের ঘাম শ্রমে গড়া কোম্পানির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। উষ্ণ ভালোবাসা জানালেন আত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ীরা। তাঁরাও হয়ে উঠলেন এই পরিবারের সদস্য।

নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত।