বকশিশ বনাম ঘুষের গল্প

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

আমার এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালের ১৩ অক্টোবর। কোনো এক অজানা কারণে ওই বছর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) খুব দ্রুত তাদের ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত ভর্তি ফরম জমা দেওয়ার শেষ তারিখের মধ্যে আমাদের উপজেলা পর্যায়ের কলেজগুলোতে ট্রান্সক্রিপ্ট পৌঁছাবে, কিন্তু সেই ট্রান্সক্রিপ্ট আমার কাছে আসতে সেই তারিখ অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। তাই কলেজের প্রিন্সিপাল স্যারের ফরওয়ার্ডিং নিয়ে বোর্ড থেকে সরাসরি ট্রান্সক্রিপ্ট ওঠানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।

ঢাকা থেকে রমজানের এক পড়ন্ত বিকেলে লঞ্চে উঠে চাঁদের আলোতে নদীর অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে খুব ভোরে পৌঁছে গেলাম বরিশাল শহরে। ইতিপূর্বে ক্লাস সেভেনে পড়াকালে বাবার সঙ্গে একবার এসেছিলাম এই শহরে। আরেক বার এসেছিলাম ২০০২ সালে বন্ধু বিশ্বজিতের বোনের বিয়েতে ওর প্রক্সি দিতে। দুইবারই বড় কেউ সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু এবার আমি এই অচেনা পরিসরে আমি সম্পূর্ণ একা। উপরন্তু শিক্ষা বোর্ডের মতো বড় সরকারি অফিসে এটাই আমার প্রথম যাত্রা। মনে দুই রকমের ভয় কাজ করছিল প্রথমত বোর্ড অফিসে আমি ঠিকভাবে চিনে যেতে পারব তো এবং দ্বিতীয়ত চিনে গেলেও আমি যে উদ্দেশ্যে যাচ্ছি তা পূরণ করে আজকের মধ্যেই ঢাকাতে ফিরে যেতে পারব কিনা। লঞ্চ থেকে নেমে টার্মিনালের বাইরে আসতেই শুনলাম, একজন বেবিট্যাক্সির চালক ‘বোর্ড অফিস, বোর্ড অফিস’ বলে যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। আমি নির্ভয়ে তাঁর বেবিট্যাক্সিতে উঠে বসলাম ও নির্ভাবনাতে বোর্ড অফিসে পৌঁছে গেলাম।

বোর্ড অফিসে সকলেই মহাব্যস্ত। অনেককেই অনুরোধ করলাম আমার পূরণকৃত ফরমগুলো একটু নিরীক্ষণ করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সকলেই ব্যস্ততার অজুহাতে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। অনেকেই দেখলাম বসে ঈদের কেনাকাটা নিয়ে গল্প করছেন, কিন্তু আমার অনুরোধ রাখার সময় পাচ্ছেন না। মনে কষ্ট নিয়ে রুমের এককোণে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে তাঁদের কেউ একজনের মনে আমার কাজটির গুরুত্ব বোঝাবার ক্ষমতা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকলাম। এমন সময় একজন নারী সেকশন অফিসার আমাকে ডেকে তাঁর টেবিলের সামনে বসালেন এবং বললেন, আমার হাতের কাজ শেষ করে তোমার ফরমগুলো আমি দেখে দেব। তার হাতের কাজ শেষ হওয়ার পরে আমার সমস্যার কথা তাকে বুঝিয়ে বললাম। বিস্তারিত শুনে তিনি আমাকে সকল কাজ হাতে হাতে করানোর পরামর্শ দিয়ে কারণ হিসেবে বললেন, কাল থেকে অফিস ঈদের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। আজকের মধ্যে যদি তুমি এটা হাতে না পাও তাহলে সাত দিনের মতো দেরি হয়ে যাবে। এ কথা বলে তিনি আবার নিরীক্ষণ শুরু করলেন।

এরপর সামান্য কিছু ভুল শোধরানোর পর তার কথামতো একটি জমা স্লিপের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকে নির্ধারিত ফি জমা দিলাম। তিনি আমাকে বললেন, এখন এই ফরম ও টাকার রসিদ নিয়ে হাতে হাতে ওই রুমে দিয়ে এসো। এই কথা বলে তিনি কী যেন চিন্তা করে বললেন, তুমি আমার সঙ্গে এসো। আমি তাঁকে অনুসরণ করে ওই রুমে পৌঁছানোর আগেই তিনি আমার কাগজ স্বাক্ষর করিয়ে এনে বললেন, এবার সোজা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের রুমে নিয়ে যাও। তার একটা স্বাক্ষর হলেই এটা প্রিন্টিং সেকশনে চলে যাবে এবং আমি আশা করি আজকের মধ্যেই তুমি ঢাকা রওনা হতে পারবে। আমি তাঁকে অশেষ ধন্যবাদ দিয়ে নিয়ন্ত্রক মহোদয়ের রুমের উদ্দেশে পা চালালাম।

নিয়ন্ত্রক মহোদয়ের রুমের সামনে একজন পাঞ্জাবি পরা শ্মশ্রুমণ্ডিত ভদ্রলোক আমাকে থামালেন এবং কী উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি তা জানতে চাইলেন। আমি বিস্তারিত বলার পরে তিনি বললেন, এক দিনে ওঠানোতো অনেক কঠিন ব্যাপার। ফরমগুলো দাও দেখি কী করা যায়। আমি তার হাতে সকল ফরম দেওয়ার পরে তিনি সেগুলো নিয়ে চলে গেলেন। আমি মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলাম যে, আল্লাহ এখানেও এই ব্যক্তির মতো একজন ভালো মানুষের ব্যবস্থা করে দিলেন।

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

এরপর আমি ওই রুমের উল্টো দিকে খোলা ছাদে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। ৩০-৩৫ মিনিট পরে তিনি এসে বললেন, আপনার কাজতো অনেক জটিল। এই কাজ একদিনে করা অনেক কঠিন হবে। আপনি এক কাজ করেন, আজ চলে যান ঈদের পরে এসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আমি উঠিয়ে রাখব। আমি তাঁকে বাকৃবির ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দেখিয়ে বললাম, এখানে ফরম জমা দিতে হলে আমার এই কাগজ আজকেই তুলতে হবে। তিনি কী যেন চিন্তা করে চলে গেলেন। পাঁচ মিনিট পরে আবার এসে বললেন, নাহ মনে হয় আজ আপনি আর এই কাগজ তুলতে পারবেন না। স্যারের টেবিলে অনেক কাজ জমা হয়ে আছে।

আমি তাকে নিচের সেকশন অফিসারের কথা বলে বললাম, উনি তো বলল আজকের মধ্যে সম্ভব। ভদ্রলোক এতে করে খুব খেপে গেলেন এবং বললেন, আমি স্যারের সঙ্গেই থাকি সারা দিন আমি জানি না, ওই দুই কলম পড়নেওয়ালি সেকশন অফিসার আমার চেয়ে বেশি জানে? আমি খুব বিনীতভাবে তাকে বললাম, উনি আমাকে বলেছেন, তাই বললাম। আর আমি জীবনে এই প্রথম বোর্ড অফিসে এসেছি, তাই এত কিছু আমার জানা নাই। ভদ্রলোক কিছুটা নরম হয়ে বললেন, কাজটা আমি করে দিতে পারি কিন্তু বিভিন্ন টেবিলে কিছু বকশিশ দিতে হবে।

আমি এবার বুঝে গেলাম এই কাজ কেন এত কঠিন হয়ে গেল। আমি তাকে বললাম কি বললেন কাকা বুঝলাম না। তিনি বললেন, দুদিন পরে ঈদ। ঈদের সময় সকল কাজেই সবাই মোটা বকশিশ দেয়। বকশিশ না দিলে ছেলেমেয়েদের নতুন কাপড়, বউয়ের শাড়ি এগুলো আমরা কীভাবে কিনব বলেনতো বাপু। আমি তাকে বললাম, আমি আবার বকশিশ দিই না কাকা, ঘুষ দিই। ঘুষ দিলে কি আজকের মধ্যে কাজ হবে। তিনি নিজের গালে মৃদু চড় মেরে আঁতকে উঠে বললেন, কী যা তা বলছেন, রোজার দিন, এর পরেও আমার মতো একজন আল্লাহভক্ত লোক এই হারাম ঘুষ নিয়ে কাজ করবে? আমি সাবলীলভাবে বললাম, চাচা আমার কাছে আপনাকে দেওয়ার মতো ৫০০ টাকা আছে। কিন্তু তা বকশিশ হিসেবে দেওয়ার ক্ষমতা আমার নাই। ঘুষ চাইলেই কেবলমাত্র তা দিতে পারি। এতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে বললেন, জানেন ঘুষ দিতে চাওয়ার অপরাধে আপনাকে পুলিশে দেওয়া যাবে। আমি বললাম, কাকা আপনি যে বকশিশ চাইলেন সেটার কোনো অপরাধের মধ্যে পড়ে না? আর আমার যা বয়স তাতে পুলিশ আমার আগে আপনাকে থানাতে নিয়ে যাবে বলে আমার মনে হয়। এতে কিছুটা ভড়কে গিয়ে চাচা বললেন, তোমার সঙ্গে এত কথা বলার সময় নাই, আমি উপকার করতে চেয়েছি, তা তোমার ভালো লাগে নাই। এই কাগজ ঈদের পরেই তুমি পাবা। যাও এখান থেকে চলে যাও, আমি নামাজে যাব।

তিনি চলে যাওয়ার পরে আমি সরাসরি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (যতটুকু মনে পড়ে তাঁর নাম মনিরুজ্জামান ছিল বা ম দিয়ে কোনো একটি নাম) স্যারের রুমে ঢুকে তাঁকে সব বলার পরে তিনি আমার ফরমগুলো দেখতে চাইলেন। আমি তাঁকে বললাম, আমার সকল কাগজপত্র ওই চাচা জমা নিয়েছেন। আমার কথা শুনে নিয়ন্ত্রক স্যার আমাকে বসতে বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। পাঁচ-সাত মিনিট পরে আমার কাগজগুলো হাতে তিনি রুমে ঢুকলেন। তাঁর চেহারা দেখে আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি আমার কাগজগুলো আমার সামনে দিয়ে বললেন, দেখতো এগুলো কিনা? আমি দেখে তাঁকে সম্মতি জানাতে, তিনি কাগজ নিতে নিতে বলে উঠলেন, ওই চোরটা তোমার কাগজ ওর টেবিলের ড্রয়ারে রেখে তালা দিয়ে নামাজের নামে বের হয়ে গেছে। এই কথা বলে কাগজে স্বাক্ষর করে তিনি আমাকে ইশারা করলেন তাঁর সঙ্গে যেতে।

আমি তাঁকে অনুসরণ করে একটি রুমের সামনে এসে দাঁড়ালাম। তিনি ভেতরে ঢুকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে চলে যাওয়ার সময় মাথাতে হাত রেখে বললেন, কিছু মনে কর না বাবা, এই সকল মেকি বক ধার্মিকে দেশটা পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এরা ধর্মের লেবাস পরে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ১০-১৫ মিনিট এই বারান্দাতে অপেক্ষা কর, তোমার কাগজ ওরা তৈরি করে এনে দেবে। আর হ্যাঁ, এই যে আমি রুম থেকে বের হয়ে তোমার কাজ করে দিলাম, এর দুটি প্রতিদান তোমাকে দিতে হবে।

আমি প্রশ্ন করলাম কি স্যার? তিনি বললেন, এক নম্বর হলো ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমাকে চান্স পেতে হবে, আর দুই নম্বর হলো পড়াশোনা করে কোনো চাকরি নিয়ে এই সকল বকশিশ কাম ঘুষ খোরদের থেকে আমাদের এই দেশটিকে রক্ষা করতে হবে। তাঁর প্রথম কথাটি রেখে ছিলাম কিন্তু বৃহৎ পরিসরে দ্বিতীয় কথাটি আজও রাখতে পারিনি। তবে ক্ষুদ্র পরিসরে হয়তো কিছু করেছি এবং আল্লাহ যদি তৌফিক দেন তাহলে বৃহৎ পরিসরেও পালন করার অদম্য ইচ্ছা মনের মধ্যে সযত্নে লালন করছি।

আসুন না, একটি শপথ আমরা নিই, আর তা হলো বকশিশ নামক ঘুষ কিংবা ঘুষ অথবা যেকোনো দুর্নীতিকে আমরা শক্ত হস্তে দমন করব এবং পোশাক নির্ভর ধার্মিক না হয়ে কাজেকর্মে ধার্মিক হব।

শেখ মাহাতাবউদ্দিন: প্রাক্তন শিক্ষক, সেন্ট জোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও পিএইচডি গবেষক, সাপ্পারো, জাপান।
ইমেইল: <[email protected]>