প্রবাসের নারীরা

সহধর্মিণীর সঙ্গে লেখক
সহধর্মিণীর সঙ্গে লেখক

লেখার শিরোনামটা একটু কেমন না! প্রবাসী নারী বলতে আমি বিশেষভাবে বাঙালি নারীদের বোঝাচ্ছি। আরও স্পষ্টভাবে টরন্টোর নারীদের। কারণ আমি এই শহরের বাসিন্দা। তাদের আমি যতখানি কাছ থেকে জানি, অন্য প্রবাসী নারীদের জানি না। তবে পার্থক্য কিছু আছে বলে মনে হয় না। নানা দেশ ঘুরে আমার তাই মনে হয়েছে। সেটা নিউইয়র্ক হোক, সিডনি, প্যারিস, লন্ডন আর টোকিও হোক নারীদের ভূমিকা একই।

যারা বাংলাদেশে থাকেন তারা বুঝবেন, তাদের সঙ্গে প্রবাসী নারীদের মধ্যে তফাতটা কোথায়। যে মেয়েটি দেশে থাকতে এক গ্লাস পানিও ঢেলে খায়নি, সেও প্রবাসে এসে রাজ্য চালানোর মতো দক্ষ হয়ে ওঠে। এমনকি এখানকার নতুন প্রজন্ম, যারা তরুণ তারাও চমৎকারভাবে সবকিছু সামলাতে শিখে ফেলে। বাংলাদেশের একজন তরুণের কাছে তা অবিশ্বাস্য মনে হবে। তিন চার বছরের শিশুরাও অনেক কিছু জানে। মা-বাবাকে সাহায্য করে, এমনকি ডেবিট মেশিন চালাতেও জানে। সব অবদানই মায়েদের।

এক অনুষ্ঠানে কয়েকজন সুবেশা নারী আমাকে বলেছিলেন, জসিম ভাই শুধু নিজের স্ত্রী আর মায়ের কথাই লেখেন। আমাদের কথাও কিছু লেখেন, ভাবিদের কথা...। আমি তাদের কথায় হাসি। একজন আমাকে সমর্থন করে বললেন, না, না উনিতো আরও কত কী লেখেন! একজন বললেন, জসিম ভাই সাহস করে যা লেখে অনেকে তা লিখতে পারবে না। একজন বললেন, আপনি আমার মনের কথাগুলো লেখেন। কীভাবে মেয়েদের মনের কথা বোঝেন!

এতগুলো নারীর মাঝে আমি লজ্জায় প্রায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিলাম। এমনিতেই লেখা নিয়ে কথা উঠলেই আমি নিজেকে গুটিয়ে ফেলি এবং তা যদি কোনো সাহিত্য জাতীয় আলোচনা হয় তাহলে, আমি আরও আতঙ্কগ্রস্ত থাকি। কখন না আমাকে কিছু বলতে হয়। নিজেকে রক্ষার জন্য যে যা বলেন, তাতেই সমর্থন দিয়ে যাই। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম দিকের কথা। সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে এক স্মরণসভায় আমি পেছনের দিকে বসেছিলাম। উদ্যোক্তাদের একজন আমাকে বললেন, জসিম তুমি কিছু বলো। আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, না, না আমি না, আমি শুনতে এসেছি। মুগ্ধ হয়ে শুনছি।

আমি নারীদের প্রতি একটু দুর্বল এটা সবাই জানেন। এই দুর্বলতা তৈরি হয়েছে আমার শৈশবকাল থেকেই। আমি অনেক বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের মধ্যে ঘুমিয়েছি। বড় হয়ে যখনই বাড়িতে গিয়েছি, মায়ের পাশে শুয়ে থেকেছি। আমি আমার স্ত্রীর ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। আমার মেয়ে অরিত্রি আমার কাছে কিছু চায় কিনা, সে জন্য আমি দিনের পর দিন অপেক্ষা করি। একদিন যেমন বলল, বাবা আমাকে উইনফোর্ড ড্রাইভে ড্রপ করে দাও। আমি মহা আনন্দে অরিত্রিকে নিয়ে যাই। গাড়িতে বলল, বাবা আমাকে পাঁচ ডলার দাও। আমি বললাম, মাত্র পাঁচ ডলার! অরিত্রি বলল, হ্যাঁ। বললাম কি করবা। অরিত্রি বলল, আমি একটা সালোয়ার কামিজ অর্ডার করেছি, ১৫৫ ডলার দাম, পাঁচ ডলার শর্ট আছে। আমি বললাম, পুরোটাই দিই আম্মু। সে বলল, না বাবা, আমি চাকরি করি না! আমার নারী আত্মীয় যারা আছে বা আমার বন্ধু তাদের প্রতি আমার বিশেষ পক্ষপাত আছে।

প্রবাসী নারীরা আমাকে প্রতিনিয়ত বিস্মিত করেন। তারা ঘরের কাজ করেন, বাইরে কাজ করেন। সেই তারা অনেকে আবার ছুটির দিনে সাজগোজ করেন, বিউটি পারলারে যান। বেড়াতে যান, গান করেন, নাচ করেন, আবৃতি করেন, সাহিত্য করেন, মঞ্চে বক্তৃতা করেন, শীতের রাতে শহীদ মিনারে ফুল দেন, যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদে অগ্রভাগে থাকেন। বেশির ভাগই নিজেই ড্রাইভ করে কোথায় কোথায় চলে যান, এক শ বিশ কিলোমিটার স্পিডে গাড়ি চালান। অনেকে নিজের ব্যবসা পরিচালনা করেন দক্ষভাবে। বাজার করেন, ওয়াশিং মেশিনে কাপড় পরিষ্কার করেন, বিশ পদের রান্না করে একসঙ্গে পঞ্চাশজনকে দাওয়াত খাওয়ান।

পুরুষ তার সহযোগী ঠিকই কিন্তু সিদ্ধান্ত নারীই নেন। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তাই হতে দেখি। এখন অবশ্য বাংলাদেশের নারীরাও সবকিছু করছে। তারাই প্রবাসে এসে সহজেই মানিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে। একজন পুরুষ অনেক কিছু উপেক্ষা করতে পারেন, কিন্তু একজন নারী তা পারেন না। তিনি সন্তান ধারণ করেন, সন্তান লালন পালন করেন, অসুখে সন্তানের পাশে বসে নির্ঘুম রাত পার করেন। একজন নারী কী না করেন! সবই করেন। সেদিনের অনুষ্ঠানে সেই সব সুবেশী নারীদের কথায় পরে আমার মনে হয়েছিল, সত্যিই তো এগুলো নিয়ে আমি কেন লিখিনি!
...

জসিম মল্লিক: টরন্টো, কানাডা। ইমেইল <[email protected]>