কিছুটা সত্য, কিছুটা কাল্পনিক

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কথায় বলে এক দেশের গালি অন্য দেশের বুলি। কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম বাংলাদেশের পুলিশ দুই সন্ত্রাসীকে ধরেছে। একজনের নাম লেংটা তাজগীর। অন্যজন এতিম বেলাল। একজন সন্ত্রাসীর নামের সঙ্গে যদি এতিম থাকে তাহলে পাঠকের পক্ষে তার বিপক্ষ নেওয়া কিছুটা তো কঠিন বটে। নামের ক্রিয়েটিভিটিতে পৃথিবীতে বাংলাদেশের জুড়ি নেই। হাওলাদার, তালুকদার, তরফদার, দফাদার, চৌকিদার থেকে শুরু করে অনেক পদের পেশা ও নামে একাকার। শুধু বাংলাদেশেই নয়। আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশেই মানুষের নামের ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ আছে। অনেকে আবার জন্মসূত্রে পাওয়া নামের বিড়ম্বনার শিকার। আমেরিকায় দেখেছি নাইন ইলেভেন ঘটনা ঘটার পর নামের আগে ও পরে অনেকে কাটছাঁট করেছে।

প্রাচীনকাল থেকেই নামের উৎপত্তি হয়েছিল পেশা থেকে। আমার এক কলিগ ছিলেন, যার নাম ওয়াকিং স্টিক অর্থাৎ হাঁটার লাঠি। ঠাট্টাচ্ছলে তাঁকে প্রায়ই বলতাম, তার পূর্ব পুরুষেরা হয়তো হাঁটার লাঠি বানাত। ভারতের এক চিকিৎসকের নাম ডাক্তার মোদী সরকার। আমেরিকায় পার্ক একটা কমন লাস্ট নাম। কিন্তু এক ব্যক্তির নামের প্রথম অংশ জুরাসিক। পুরো নাম জুরাসিক পার্ক। আরেকজন সেক্স অফেন্ডার ক্রিমিনালের নাম মিস্টার লাভ। বাংলাদেশে প্রায়ই দেখা যায় শিক্ষিত ও ডিগ্রিধারী রাজনীতিবিদেরা নামের প্রথম অংশে অ্যাডভোকেট, ব্যারিস্টার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিএ, এমবিএ, এমবিবিএস ইত্যাদিতে বিশেষণ করেন। বিশেষ করে যাদের নাম একটু লেংটা লাগে। যদি কোনো ডিগ্রি নাও থাকে তাহলে সমস্যা নেই। হাজি কিংবা আলহাজ টাইটেল নিতে খুব একটা সমস্যা হয় না। আর কারই বা ওগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সময় আছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, নামকরা অপরাধী কিংবা সন্ত্রাসীদের নামও আসে তাদের পেশা থেকে। তাদের নামগুলো হয় সাধারণত শারীরিক, মাদক, দেশ কিংবা পশুপাখি সংক্রান্ত। যেমন গালকাটা কাশেম, মুরগি মিলন, সুইডেন আসলাম ইত্যাদি।

এতো গেল ব্যক্তি বিশেষের নাম। এবার আসি শহরের নামকরণে। শহরের নাম নিয়ে আমেরিকাকে কেউ হারাতে পারবে না। শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য কিছু নাম দিলাম। যেমন, ক্যালিফোর্নিয়ার একটা শহরের নাম অ্যাক্সিডেন্ট। ওই শহরে ঢোকার সময় বিশাল সাইনবোর্ডে লেখা ওয়েলকাম টু অ্যাক্সিডেন্ট। টেক্সাসের মন্টগোমারি কাউন্টির একটা শহরের নাম কাট অ্যান্ড শুট অর্থাৎ বাংলায় কাটো ও গুলি করো। সত্যি হলেও আমেরিকায় টেক্সাস আর ফ্লোরিডাতে বেশি গোলাগুলি হয়। ওই স্টেটে আরেকটা শহরের নাম Uncertain বা অনিশ্চিত। মিশিগানের একটা শহরের নাম হেল। শহরের প্রবেশমুখে বিরাট করে লেখা ওয়েলকাম টু হেল। চিন্তা করা যায় নতুন কেউ ওই শহরে যাবে গ্যাস আর খাবার কিনতে আর প্রবেশ মুখে বিরাট সাইন নরকে স্বাগতম। অ্যারিজোনাতে একটা শহরের নাম নাথিং। পেনসিলভানিয়ার একটা শহরের নাম ইন্টারকোর্স।

আমার অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে সুন্দর একটা শহরের নাম পেয়েছি আইওয়া স্টেটে। গত শীতে মিনেসোটা থেকে টেক্সাস যাওয়ার পথে আইওয়াতে বিশ্রাম নেবার জন্য একটা শহরে থামলাম। নাম Story City বা গল্প শহর। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে স্টোরি ছিল ওই শহরে প্রথম আসা এক ব্যক্তির নাম। বাংলার গল্পটল্প কিছুই না। তবে গল্প শহরের ছোট একটা গল্প মনে পড়ে গেল। শহরের প্রবেশ মুখেই একটা গ্যাস স্টেশন আর তার ভেতর পিৎজা হাটের একটা দোকান। গ্যাস ভরে খাবার কেনার জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। ভাবলাম আরও তিন শ মাইল ড্রাইভ করে ক্যানসাস শহরের কাছাকাছি কোথাও হোটেল বা মোটেলে থাকব। তা ছাড়া আইওয়ার হাইওয়ে অনেকটাই নিরিবিলি। শুনেছি অনেক হন্টেড হাউসও আছে। হাইওয়েতে অ্যাক্সিডেন্টে মরে যাওয়া অনেক মানুষ নাকি মাঝে মধ্যেই পুলিশ সেজে দাঁড়িয়ে থাকে। রাতের বেলা ড্রাইভারদের বিভ্রান্ত করে। তা ছাড়া আমেরিকার প্রায় পঁয়তাল্লিশ শতাংশ মানুষই ভূতপ্রেত বিশ্বাস করে। সেদিন ছিল ভয়ানক ঠান্ডা। এত ঠান্ডা যে, গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করলে এক কি দুই মিনিটেই শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। বেশিক্ষণ দেরি না করে আমি গরম পিৎজা কিনব বলে লাইনে দাঁড়িয়েছি। সামনে আরও তিন কী চারজন। সবচেয়ে সামনে মধ্যবয়স্কা এক সাদা নারী। বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন। মনে হলো তিনি আমাকে কিছু বলতে চাইছেন।

—তুমি কোন সাইজের পিৎজা খাবে? মিডিয়াম নাকি লার্জ?
আমি ভাবলাম তিনি হয়তো ভদ্রতাবশত জিজ্ঞেস করছেন। বললাম, মিডিয়াম।
—বিফ নাকি চিকেন?
—তোমার জেনে কি হবে? অতি উৎসাহী দেখে কিছুটা বিরক্ত হয়েই উত্তর দিলাম।
—আমি তোমার বিলটা দিয়ে দেব?
—কেন? আমার তো টাকা আছে।
—না, আসলে আজ সকালের নাশতা কেনার সময় কেউ একজন আমার বিলটাও দিয়ে দিয়েছিল। তুমিও পরে কাউকে বিলটা দিয়ে দিয়ো। এটা একটা চেইন অব কমান্ডের মতো খেলা। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক গড়ে ওঠার খেলা। হয়তো অনেক আগে কেউ এ রকমই লাইনে দাঁড়িয়ে কারও বিল দিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকে এই রীতি হয়তো চলে এসেছে।

ভদ্রমহিলার কথাবার্তা জুতসই। আমার পছন্দ হলো। পরিচয় জানলাম। নাম এঞ্জেলা। তিনি তার স্ত্রী ও দুই দত্তক বাচ্চা নিয়ে ক্যানসাস শহরে থাকেন। মিনেসোটা গিয়েছিলেন বেড়াতে। এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।

বললাম, এত মানুষ থাকতে আমার বিল কেন দিতে গেলে? আমি কিন্তু অত গরিব না। আমার চাইতে আরও গরিব লোক তুমি দেখতে পারতে। কিনে যখন দেবেই তখন থ্যাংকিউ বলাটা তো বিরাট পাওনা। ঠাট্টাচ্ছলে তাঁকে বললাম।
—পিৎজা কিনে দেওয়াটা ওভাবে নিয়ো না। এত দায়বদ্ধতা মনে করলে তুমিও কাউকে কিনে দিয়ো। বাই দ্য ওয়ে, তুমি কি কিছু মনে করবে যদি বলি অরিজিন্যালি তুমি কোথাকার?
—মোটেই না। বাংলাদেশ।
—ও মাই গড! হোয়াট এ স্মল ওয়ার্ল্ড।
—এতে গডকে ডাকার কি হলো?
—বলছি, বলেই এঞ্জি অন্যদিকে ইঙ্গিত করে একজন ভারতীয় মতো দেখতে নারীকে কাছে আসার জন্য ইঙ্গিত দিলেন।

আমার ধারণা তিনি ভারতীয় বা পাকিস্তানি। তখন তিনি অন্যমনস্ক হয়ে দোকানের ভেতর স্যুভেনির দেখতে ব্যস্ত। তার সঙ্গে ছোট দুটি মেয়ে।

—নাজমা, দিস জেন্টলম্যান ইজ ফ্রম বাংলাদেশ অ্যান্ড হি লিভস ইন মিনেসোটা।

ভদ্রমহিলা আমার দিকে একটু দ্রুত হেঁটে এসেই সরাসরি বাংলায় প্রশ্ন করলেন, আপনি কি বাংলাদেশের? মিনেসোটার কোথায় থাকেন।
—জি, বাংলাদেশে আর মিনেসোটায় মিনিয়াপোলিশ শহরে থাকি। আপনার পরিচয়টা কি জানতে পারি?
—আমি নাজমা। অরিজিন্যালি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। ক্যানসাস সিটিতে থাকি আর ওদিকেই ফেরত যাচ্ছি। মিনিয়াপোলিশ শহরে গিয়েছিলাম এঞ্জির বোনের বিয়েতে।
—যদি কিছু মনে না করেন, এঞ্জির সঙ্গে আপনার পরিচয়?
—ও হ্যাঁ, এঞ্জি হচ্ছে আমার হাজব্যান্ড আর এই দুটি মেয়ে হচ্ছে আমাদের অ্যাডাপ্টেড বাচ্চা।

বিদায় নিয়ে আমি দ্রুতই হাইওয়েতে গিয়ে উঠি। কিছুক্ষণের মধ্যেই গল্প শহরের সাইন পেছনে পড়ে যায়। ড্রাইভ করছি আর ভাবছি গল্প শহরকে নিয়ে কীভাবে একটা গল্প বানানো যায়। ওই শহরের প্রথম আগন্তুক মিস্টার স্টোরির কি শেষমেশ স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল? নাকি কোনো এক অশরীরী তার মৃত্যুর কারণ। তুষার ঝরা কোনো এক গভীর রাতে কেউ একজন তার বাড়িতে এসে কড়া নাড়ে। আগন্তুক বলে, সে তার হারানো বিড়াল খুঁজছে। এত রাতে কেউ একজন হারানো বিড়াল খুঁজছে শুনে মিস্টার স্টোরি বিরক্ত হন। আগন্তুককে তাড়িয়ে দেন। তার কিছুদিন পরেই মিস্টার স্টোরিকে বাসার পাশে ঝোপঝাড়ে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার শরীরে ছিল অসংখ্য বিড়ালের আঁচড়। পুলিশ আজ পর্যন্ত ওই মৃত্যুর সমীকরণ মেলাতে পারেনি। আমি ভাবছিলাম গল্প শহরের গল্পটা এভাবেই এগিয়ে যাবে। হোক না কিছুটা সত্য, কিছুটা কাল্পনিক। স্বয়ং গুরু রবীন্দ্রনাথই তো বলে গেছেন—

‘পাছে সত্য ভ্রষ্ট হই, এই ভয় জাগে মোর মনে।
নারদ কহিলা হাসি, সেই সত্য যা রচিবে তুমি।’
...

জামাল সৈয়দ: মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র।