উচ্চশিক্ষা ও একটি দীর্ঘশ্বাস

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাট চুকিয়ে জাপান সরকারের মনবশু বৃত্তির অর্থায়নে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা করতেন আলম (ছদ্মনাম)। জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অর্জন খুব ভালো হওয়াতে ওখানেই শিক্ষকতার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। কিন্তু ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আলমকে টলাতে পারেনি। ওই লোভনীয় প্রস্তাব পায়ে ঠেলতে তিনি এক মুহূর্তও দেরি করেননি। কারণ, তাঁর পরিকল্পনা ছিল জাপান থেকে গবেষণার তীর্থভূমি যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন। সেখানে দুই বছর পোষ্টডক্টরাল গবেষণা করে নিজের গবেষণার ভিত্তি আরও মজবুত করবেন। তারপর এই গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও নেটওয়ার্কিংকে কাজে লাগিয়ে দেশে একটি বিশ্বমানের ল্যাব প্রতিষ্ঠা করবেন।

সেই স্বপ্ন নিয়েই আলমের মার্কিন মুলুকে গমন। পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই বছর পর গাঁটের পয়সা খরচ করে বাংলাদেশে কয়েকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু বিধিবাম! তিনি জানতেন না, অতিরিক্ত যোগ্যতা বাংলাদেশে এক ধরনের অযোগ্যতা। এর পরিবর্তে পিএইচডি ছাড়া কিংবা কারও নামমাত্র পিএইচডি আছে এমন দক্ষ(!) ব্যক্তিদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। ভাইভা বোর্ডে কমন এক প্রশ্ন—এত ভালো গবেষণার প্রোফাইল নিয়ে তুমি বাংলাদেশে ফেরত আসতে চাচ্ছ কেন? কেউ কেউ তো বলেই ফেললেন, কোনো সমস্যা আছে হয়তো। অনেকে আবার আলমের এসএসসি পরীক্ষায় রসায়নে লেটার মার্ক না পাওয়া নিয়েও হাসাহাসি শুরু করলেন। আলম বিষয়গুলোতে ব্যথিত কিংবা কনফিউজড হতে থাকলেন। তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না, এসএসসি পরীক্ষার রসায়নের ফলাফল কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হবে?

আলমের এ দ্বিধা দূর করতে তখন ত্রাতার মতো আবির্ভূত হলেন একজন সহকারী অধ্যাপক। তাঁর নাম সোহেল (ছদ্মনাম)। এই সহকারী অধ্যাপক আবার দুবার পিএইচডি করতে দুটি দেশে গিয়ে ফেরত আসার পরে তখন নিজ বিভাগেই এক অধ্যাপকের অধীনে পিএইচডি কোর্সে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি আলমকে বুঝিয়ে বললেন, আসলে এ সব প্রশ্নের উদ্দেশ্য একটাই আর তা হলো, তাঁকে বিভ্রান্ত করে তাদের পছন্দের কাউকে নিয়োগ দেওয়া। তিনি আরও বললেন, যদি আলম রাজি থাকেন, তাহলে তিনি নিজের উদ্যোগে তাঁর জন্য লবিং করে তাঁকে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার ব্যবস্থা করে দেবে। আলম এ কথার খুব মনঃকষ্টে ভুগলেন কিছুদিন। তাঁর হিসাবেই ধরছিল না, সোহেল সাহেব বিভাগে পজিশনধারী কিন্তু তিনি যে শিক্ষকতার জন্য অযোগ্য, তাতো তাঁর উচ্চশিক্ষার রেকর্ডে প্রমাণিত। তাহলে আলমকে কেন সেই সোহেল সাহেবের লবিং ধরে নিজের দেশের সেবা করার একটা সুযোগ ভিক্ষা করতে হবে? এই বিষয়টি তিনি কিছুতেই মানতে পারলেন না।

এক সপ্তাহ ধরে নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে আলম হেরে গেলেন। তিনি হেরে গেলেন তাঁর বিবেকের কাছে। তিনি হেরে গেলেন বাংলাদেশের স্বজনপ্রীতি ও দুর্জনের পৃষ্ঠপোষকতার নীতির কাছে। তিনি বুঝে গেলেন, শিক্ষাগত কিংবা গবেষণা নয়, বাংলাদেশে বড় যোগ্যতা হলো অন্য কিছু, যা অর্জনে আলম ব্যর্থ। কিন্তু সোহেল সাহেব এ ক্ষেত্রে বিজয়ী! এই ব্যর্থতার গ্লানি মাথায় নিয়ে আলম দেশ ছাড়লেন। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি চাকরি নিলেন। পরবর্তীতে মার্কিন নাগরিকত্ব নিলেন এবং সেখানে তিনি এখন একটি নামকরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একজন গুরুত্বপূর্ণ গবেষক! যার নেতৃত্বে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামকরা বিজ্ঞানীদের একটি দল নিত্যনতুন আবিষ্কারের নেশাতে বুঁদ হয়ে দিন রাত খেটে যাচ্ছে।

বিদেশে এমন আলমের সংখ্যা অগণিত। যারা নিজের দেশকে সেবার জন্য নিজেদের সর্বস্ব বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত। যারা শুধু চায় নিজেদের সম্মান ধরে রেখে কাজ করার অধিকার। পদলেহন ব্যতীত নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার অঙ্গীকার। কাজ দিয়ে নিজেদের অধিকার আদায় করতে জানা এই মানুষগুলো আজও দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দেশে ফিরতে না পারার কষ্ট আজও তাদের বুকে জগদ্দল পাথরের চেপে আছে। দিনে দিনে আলমদের সংখ্যা বিভিন্ন দেশে গুণিতক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে দেশে সোহেল সাহেবদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে দেশের সকল সেক্টরে। এই অনাচারের ফলাফল হলো আজকের বাংলাদেশ।

এখনো সময় আছে জাতির এই সকল শ্রেষ্ঠ সন্তানদের দেশ গঠনের কাজে লাগানোর। এ জন্য শুধু দরকার একটু শুভবুদ্ধি ও সৎ ইচ্ছার। এখনো যদি জাতি এই মানুষগুলোকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়ে স্বেচ্ছায় পঙ্গুত্ববরণকারী সোহেল সাহেবদের দিয়েই দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে চায়, তবে তা হবে তাসের ঘরের মতোই স্থায়ী। অমাবস্যার চাঁদের মতো দ্যুতি ছড়াবে সে উন্নয়ন।
...

শেখ মাহাতাবউদ্দিন: পিএইচডি, পোস্ট ডক্টরাল গবেষক, হেনরি ফোর্ড হসপিটাল, যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>