আমার মন ভালো নেই

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আমার দুটি ভাই, কেমন আছিস তোরা? ভালো থাকবি বলেই তো স্বার্থপরের মতো চলে গেসিস। জানিস, আমার মন ভালো নেই। বেশ কত দিন ধরে তোদের কথা খুব মনে পড়ে। আজ কী স্বপ্ন দেখেছি, শুনবি? স্বপ্ন দেখলাম আমাকে চমকে দেওয়ার জন্য তোরা দুই ভাই আমার জন্য ঈদের জামা কিনে আমার মাথার কাছে রেখে গেছিস। ঘুম ভেঙে খচমচ করে উঠে এপাশ-ওপাশ চারপাশ খুঁজে দেখি কোথাও কিছু নেই। এমন স্বপ্ন দেখার কোনো মানে হয়, বল তোরা? যার জীবনে এমন দিন কখনো আসবে না, তার এমন স্বপ্ন দেখার কী খুব দরকার ছিল?

আচ্ছা, তোদের ওখানে কী ঈদ হয়? কী করিস তোরা ঈদের দিনে? ওখানে কী তোদের সেমাই খেতে দেয়। কে-ই-বা রান্না করে সেমাই? খুব জানতে ইচ্ছে করে তোদের সকাল দুপুর রাতের প্রতিটা খবর। এবার বলত, ঈদের দিন তোরাও কী আমাদের মতো নতুন জামা পরে, আতর, সুরমা মেখে ঈদের নামাজ পড়িস? কে কিনে দেয় তোদের ঈদের জামা। তোদের আমার হাতে কেনা জামা পরা হলো না, এটা ভাবলেই আমি আর চোখে কিছু দেখতে পাই না। সব কেমন ঝাপসা লাগে।

জানিস আমি না খুব ভালো জামাকাপড় কিনতে পারি। অনেক দামদর করে সস্তায় সবচেয়ে পছন্দের জামা কিনতে শিখেছি আমি। তোরা এ সময় আমার পাশে থাকলে আমাকে নিয়ে যে কত রকমের হাসি তামাশা করতিস, তা আমি তোর বাকি দুই বোনের আচরণ দেখেই বুঝতে পারি। আমার দামদর করা দেখে কত দোকানদাররা যে বলেছে—‘আপা আপনি দেখি পাথরের চেয়েও কঠিন।’ অমনি তোর দুই বোন তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলেছে—‘ভাই, আপা পাথরের চেয়েও কঠিন। আপা এক জামার কাপড় দিয়ে দুই জামা বানানো মানুষ।’ দোকানদারেরা এই কথা শুনে দ্বিগুণ তামাশা করে বলেছে—‘আপনি এত হিসাবি ক্যান আপা।’

তোরাই বলত দামদর করা কী খারাপ? তোরা আমার কাছে নাই বলেই তো আমাকে এতটা হিসাবনিকাশ করে চলতে হয়েছে। সে দিনগুলোর কথা এখনো ভুলতে পারি না। খরচের মাত্র বারো শ টাকা থেকে টাকা বাঁচিয়ে কেনাকাটা করাটা কী দুষ্কর যে ছিল, সেটা আমার চেয়ে ভালো বোধ হয় আর কেউ জানে না। জানি, তোরা থাকলে হয়তো আমাকে হিসাবের খাতা কখনো খুলতেই দিতিস না। বাদ দে এসব কথা।

লেখিকা
লেখিকা

ভাইয়েরা আমার, এবার তোদের এমন কিছু কথা বলব, যা এই জীবনে কাউকে বলিনি। আমি তখন সেভেনে পড়ি। শবে বরাত ও শবে কদরের রাতে নামাজ পড়ার আগে মা বলতেন, এই রাতে আল্লাহর কাছে যা চাইবে তাই পাবে। আল্লাহর কাছে কী কী চাইব মা সেটাও শিখিয়ে দিয়ে যেতেন। এই যেমন, আল্লাহ যেন আমার পড়ালেখায় মনোযোগী করে, সৎ ইমানদার মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠি ইত্যাদি ইত্যাদি।

মার মতো মা বলে চলে যেতেন। আমি মার সকল কথা ভুলে দাদির পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে প্রতিটা মোনাজাতে কেঁদে কেঁদে শুধু একটা কথাই বলতাম, যাতে আল্লাহ আমার কথা ফেলতে না পারে। সেই কথাটা হলো—‘হে আল্লাহ তুমি আমার দুই ভাইকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। আমি যেন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ওরা আমার পাশে শুয়ে আছে।’

সকাল হতো ঠিকই কিন্তু তোরা কোনো দিন ফিরে আসিসনি। আমাকে পাছে পাগল ভাবে এই ভয়ে এ কথা কাউকে কখনো বলতেও সাহস করিনি। তা ছাড়া, আমি নিজেও পরে বুঝতে পেরেছিলাম, আল্লাহ ভালোবেসে যাদের নিজের কাছে নিয়ে যান তারা আর কখনো ফিরে আসে না। এ কারণে পরবর্তীতে এমন আবদার আর আল্লাহর কাছে করিনি।

আমি না আসলে অনেক বোকা ছিলাম জানিস। তোরা জেনে খুব দুঃখ পাবি, এই জীবনে তোদের জন্য আমি যতবার গোপনে চোখ মুছেছি, তা আর কেউ মোছেনি। এমনকি আমাদের আব্বা-মাও না। আমরা কষ্ট পাব বলে কী তাদের উচিত তোদের ভুলে থাকা, বল তোরা। তোর বাকি দুই বোনের কথা অবশ্য ভিন্ন। আমি নিজেই তাদের কখনো বুঝতে দিইনি তোদের অভাব। এমনকি তোদের আব্বা-মাকেও ভালো রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করে গেছি।

কিন্তু আমার জন্য এমন করে কে ভাববে বলতে পারিস তোরা। আমার জন্য, তোদের কাছে না পাওয়ার শূন্যতা আসলে কোনো কিছু দিয়েই পূরণ হওয়ার নয়। একমাত্র মৃত্যুই পারে তোদের সঙ্গে আমার পথের দূরত্ব মুছে দিতে। তোরা কিন্তু সেদিন আমার জন্য ঈদের জামা কিনে রাখিস, এই বলে রাখলাম। আমি না হয় তত দিন তোদের দেওয়া জামা পড়ার অপেক্ষায় থাকব কেমন। তবে একটা আফসোস সারা জীবনই থেকে যাবে, তোরা কাছে থাকলে ইহলৌকিক ঈদ কেমন হতো সেটা না জানা।

ভালো কথা, তোরা কী ওপর থেকে আমাদের দেখতে পাস? যদি দেখতে পেয়ে থাকিস তবে তো দেখসিস, তোদের বোন নীলাকে ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছি। মেধাবী ছেলে, অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছে। নীলাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। বোনের সুখে ভাই হিসেবে খুব গর্ব হচ্ছে তোদের তাই না। এখানেই কিন্তু শেষ না, তোদের আদরের ছোট বোন নীপামণির ডাক্তারি পড়া শেষ। এখন ইন্টার্নি করছে। তবে তোদের অর্পণ করে যাওয়া সবচেয়ে গুরুদায়িত্ব এখনো আমার বাকি—নীপামণিকে বিয়ে দেওয়া। তোরা তো আল্লাহর খুব কাছে আছিস। আল্লাহকে একটু বল নারে, আল্লাহ যেন আমাদের সবার মনের মতো একজন সৎ পাত্র মিলিয়ে দেন। আর সবাই বুঝতে না পারলেও, আমি কিন্তু ঠিক বুঝতে পারব তোদের দোয়াতেই আল্লাহ আমাদের কাছে এমন একজন মানুষকে পাঠিয়েছেন। কাছে থেকে তো কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারলি না, দূরে থেকে এটুকু অন্তত কর।

পরিশেষে একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, তোরা কী কখনো আশা করেছিলি আমি তোদের কাছে চিঠি লিখব। জানিস, এই চিঠিটা না অনেক দিন আগে লেখা শুরু করেছি, কিন্তু হয়েছে কী, দুই লাইন লিখি তো আর লিখতে পারি না। তাই এত দিন লাগল শেষ করতে। আমি জানি, তোরা আমাকে চিঠির উত্তরও দিবি। আমি মনে মনে সেই চিঠি কতবার যে পড়ব, সেটা কেউ জানতেও পারবে না। ভালো থাকিস তোরা, অনেক অনেক ভালো। ও হ্যাঁ, আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, আমার জন্য ঈদের জামা কিনে রাখতে কিন্তু ভুলিস না।

ইতি, তোদের বোন
২১ আগস্ট ২০১৮
...

লাভলী ইয়াসমীন: গজফোর্ড, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া।