কোরবানি ও মায়ের মুখ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বাঙালির জীবনে গৃহপালিত জীব-জন্তুর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গৃহপালিত জীব-জন্তুকে পরিবারের আট-দশজন সদস্যের মতোই একই চোখে দেখা হয়। খাবার-দাবার থেকে শুরু করে এমনকি পোশাকপরিচ্ছদের ব্যাপারেও তাদের জীব-জন্তুর কাতারে না ফেলে বরং মানুষের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েই দেখা হয়। প্রকৃতি বিশেষ করে গৃহপালিত জীব-জন্তুরা তাদের কাজে-কর্মে ফাঁকি মারে না বা কোনো কিছু সম্বন্ধে দুই নম্বরি করতে জানে না, তাই গ্রামের মানুষজন স্বভাবগতভাবেই হয় একেবারে প্রকৃতির নিয়মকানুন মেনে চলা আদর্শ মানুষ। তারা অনেক ক্ষেত্রে জানেনই না ভণ্ডামি বা কপটতা কী? তাই তাদের অনুমান করা খুবই সহজ এবং কেউ যদি তাদের কথা বা কাজ নিয়ে যখন প্রশ্ন তোলেন, তখন তারা ক্ষেপে যান।

এর বাস্তব উদাহরণও আছে। যেমন আমাদের দেশে উত্তরবঙ্গের মানুষকে ‘ভোদাই’, ‘আবদুল’ বা ‘মফিজ’ বলে সম্বোধন করা হয়। কারণ তারা খুবই সহজ সরল। তাদের বেশির ভাগই বংশপরিক্রমায় কৃষি কাজ করে এবং তারা প্রকৃতির মতোই খুব সহজ। যদিও প্রকৃতি সব সময়ই তাদের নিয়ে খেলে। এই মানুষগুলা তাতে কখনই ক্ষান্ত হয় না বা উত্তরবঙ্গ ছেড়ে অন্য কোথাও বা ঢাকা শহরে চলে যায় না, একেবারে নিরুপায় না হলে। এ কারণেই ঢাকা শহরে সবচেয়ে কম বাস করে এই এলাকার মানুষ। প্রকৃতির সঙ্গে তাদের এই টানাপোড়েনকে আমি ‘টম অ্যান্ড জেরি’ কার্টুনের সঙ্গে তুলনা করি। জেরি সব সময়ই টমের পেছনে লেগে থাকে কিন্তু যখন কোনো বহিঃশত্রু আবার তাদের আক্রমণ করে তখন তারা একে অপরের সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়ে যায়। আমি আমার ক্ষুদ্র কর্মজীবনের অনেকটা সময় উত্তরবঙ্গের মানুষের সংস্পর্শে কাটানোর সুযোগ পেয়েছি, সেখান থেকেই এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।

যা হোক মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমার ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে গৃহপালিত গরু-ছাগলের পাশাপাশি একটা কুকুর ও একটা বিড়ালও দেখেছি। অন্যান্য গৃহপালিত জন্তুর মতোই এই দুটি প্রাণীকেও খাবার ও পোশাক দেওয়া হতো একেবারে ঠিকঠাক। তাদের খাবার জন্য আলাদা আলাদা মাটির পাত্র ছিল। তাতেই তাদের খাবার দেওয়া হতো। কখনো মাটিতে খাবার দেওয়া হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না।

শীতের সময় মানুষের জন্য যখন শীতের পোশাক কেনা হতো তখন তাদের গরুর জন্য চটের বস্তা মাঝখান দিয়ে কেটে তাদের জন্য কোটের মতো একটা পোশাক বানিয়ে ফেলা হতো। এর দুই মাথায় ও মাঝ বরাবর দড়ি থাকত, যাতে করে সেগুলো গায়ে দেওয়ার পর বেঁধে দেওয়া যায়। যাতে নড়াচড়া করলেও সেগুলো গা থেকে খুলে পড়ে যায় না। খুব বেশি মশার আক্রমণ দেখা দিলে সারা গোয়াল ঘরে ধূপের ধোঁয়া দেওয়া হতো। আমি এখন পর্যন্ত এমন অক্ষতিকর উপায়ে মশা তাড়ানো আর দেখিনি। শহরে অ্যারোসল স্প্রে করা হয়। জানি না কতটা মশা মারা যায় কিন্তু নিজেদের শরীরের যে ১৩টা বাজে সেটা আমি জানি।

সপ্তাহে একদিন সময় করে তাদের গোসল করানো হতো। বছরে একবার হেমন্তকালের ফসল ওঠার সময়ে একজন মানুষ ট্রেনের মতো হুইসিল দিয়ে গ্রামে আসত। তখন সবাই বুঝে যেত গরু দাগাতে হবে। গরু দাগানোর ব্যাপারটা একটু রোমহর্ষক টাইপের ছিল। লোহার রড টাইপের বস্তু গরম করে গরুর গায়ে ছ্যাঁকা দেওয়া হতো। এ যেন অনেকটা রোগ জীবাণুকে ভয় দেখানো। এ ছাড়া প্রতিবছর একবার গক্ষুনাত আসত। সে গরুর গোয়ালের বাইরে বসে তার হাতে ঘণ্টা বাজিয়ে সুর করে মন্ত্র পড়ে গরুর গোয়ালের কোনো এক অংশে সিঁদুরের তিনটা সমান্তরাল লম্বা দাগ দিত। এতে মনে করা হতো এক বছরের জন্য গরুর গোয়াল সুরক্ষিত হয়ে গেল।

কোনো কারণে যদি কোনো গরু-ছাগল মারা যেত তখন পরিবারের মানুষের কান্নার ব্যাপারটা আজও আমি চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই। অবশ্যই এখানে আর্থিক ব্যাপারটা থাকে, কিন্তু মারা যাওয়ার পর যেমন মানুষটার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে কান্নার রোল পড়ে যেত ঠিক তেমনি গরুটা বা ছাগলটা কী কী করত, কী কী খেতে পছন্দ করত তা নিয়ে ঠিক একইভাবে কান্না করা হতো। সবচেয়ে বড় ব্যাপার যেটা সেটা হচ্ছে, সঠিকভাবে তাদের সৎকার করা হতো। বিভিন্ন মন্ত্র পড়ে মাটির নিচে কবর দেওয়া হতো এবং তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে সাধারণত সেই জায়গাটাতে কোনো একটা গাছের চারা লাগিয়ে দেওয়া হতো।

গরু ছাগল নিয়ে আমার মা মনে হয় একটু বেশি ধরনের বাড়াবাড়ি করে ফেলতেন। কয়েকটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার হবে। ছাগলের বাচ্চা যদি কখনো শীতকালে হতো আমার মা কখনই সেই বাচ্চাকে ছাগলের কাছে ঠান্ডার মধ্যে রাখতেন না। ছাগলের গায়ে তো চটের সোয়েটার থাকত। কিন্তু ছাগলের বাচ্চাকে তো আর চটের সোয়েটার পরানো যাবে না। তাই আমাদের পুরোনো ছোট হয়ে যাওয়া সোয়েটার তাদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হতো। আর রাতে তারা ঘুমাত আমার মায়ের সঙ্গে একই বিছানায়।

রাতে একাধিকবার মা ঘুম থেকে উঠে বাচ্চাগুলোকে তাদের মায়ের কাছ থেকে দুধ খাইয়ে এবং বাথরুম করিয়ে আনতেন। মা কীভাবে বুঝতেন যে এখন তার বাথরুমের সময়, এটা আমার কাছে আজও আশ্চর্য লাগে। তবে মা বলতেন, ওদের বাথরুম বা খিদে পেলে ওরা মুখ দিয়ে আওয়াজ করে জানান দিত। মাঝে দু-একবার এমন হয়েছে যে, মা কোনো কারণে ঘুমে থেকে উঠতে পারেননি, ওগুলো বিছানায় বাথরুম করে দিয়েছে। মা সকালে ঘুম থেকে উঠে যত ভয়ংকর ঠান্ডাই হোক না কেন তিনি লেগে যেতেন সেই কাপড় পরিষ্কার করতে।

আমাদের বাসার ছাগলের বাচ্চার একটা আলাদা কদর ছিল আমাদের পাড়াতে। হয়তো আমাদের ছাগলটা গর্ভবতী হলো, সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার কিছু মানুষ এসে আমার মাকে অগ্রিম টাকা দিতে আসত। তারা এসে মাকে বলত, ভাবি একটা বাচ্চা আমাকে দিতে হবে কিন্তু। তাও প্রায় বাজার দরের দ্বিগুণ-তিন গুন টাকায়। কিন্তু মা সবার আবদার রাখতেন না। তার যখন মনে হতো এই মানুষটা তার ছাগলের বাচ্চাটার যত্ন ভালোভাবে নিতে পারবে, শুধু তাদেরই দিতেন। না হলে দিতেন না। যদিও কোনো কারণে কোনো খারাপ লোকের হাতে পড়ে যেত, মা প্রায় প্রতিদিন গিয়ে বাচ্চাটাকে দেখে আসতেন এবং বারবার করে বলে আসতেন বাচ্চাটা কী কী খেতে পছন্দ করে, কীভাবে ঘুমায় ইত্যাদি। আর বাড়িতে এসে আমাদের কাছে বলতেন ওরা আমার বাচ্চাটাকে কী কী ভাবে অযত্ন করছে। আর আব্বাকে বলতেন, ওই বাচ্চাটাকে যেন ফিরিয়ে আনা হয়। আব্বা এ নিয়ে মাকে অনেক খেপাতেন। প্রত্যকটা বাচ্চাকে আমার মা অদ্ভুত এক একটা নাম দিতেন ও সেই নামেই ডাকতেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ওরা ঠিক তেমনি সাড়াও দিত। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমার এসএসসি পরীক্ষার নিবন্ধন ফিসের টাকা দেওয়া হয়েছিল আমার মায়ের সবচেয়ে আদরের ছাগলের বাচ্চাটা বিক্রি করে। সে কাহিনি অন্য কোনো দিন।

গরুর বাচ্চার ক্ষেত্রেও মা একই পাগলামি করতেন। যখনই কোনো গরু বা ছাগল বিক্রির ব্যাপারে আব্বা উদ্যোগ নিতেন সেদিন আমার মা যেভাবে কান্নাকাটি করতেন যেন আমার আব্বা আমাদের কোনো এক ভাইকে বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছেন। মা শাড়িতে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে চলতেন। যখন গরু বা ছাগলকে বাড়ি থেকে যখন বের করে নেওয়া হতো, তখন মাকে আর আশপাশে কোথাও পাওয়া যেত না। তিনি বাড়ির পেছনে গিয়ে অবিরাম কেঁদেই চলতেন। আমাদের লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার পেছনে গরুর দুধ বিক্রি করা পয়সার একটা বিশাল অবদান আছে। শুধুমাত্র আমার মায়ের কারণেই শরৎ চন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পটা আমাকে অনেক কাঁদিয়েছিল। এই গল্পটা যে আমি জীবনে কতবার পড়েছি, তার কোণ ইয়ত্তা নেই।

একবার ঈদের আগের দিন কোরবানির হাটে গরু কিনতে গিয়ে আমার এমনই একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমরা যে গরুটা কিনেছিলাম তার মালিকের বাড়িও ছিল কুষ্টিয়াতে। যখন তিনি শুনলেন আমার বাড়িও কুষ্টিয়াতে, শুধু তখনই রাজি হলেন। তিনি বলল সেটা তার অনেক আদরের গরু। আপনি ভাই একটু দেখেন যেন কোনো প্রকার অযত্ন না হয়। গরু কিনে হাসিল হওয়া পর্যন্ত তিনি গরুর দড়ি ছাড়ছিলেন না। এমনকি বলেই বসলেন, ভাই আমি গরুটা আপনার বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসি। আমি বললাম, লাগবে না, আর আপনি চিন্তা করেন না। আমি গরুটা নিয়ে যখন চলে আসছি, দেখি তিনি আমাদের দিকে চেয়ে আছেন। একটু এগিয়ে এসে আমি আবার পেছনে তাকিয়ে দেখি তিনি ঠিক একইভাবে দাঁড়িয়ে আছেন আর ঘন ঘন গামছায় চোখ মুছছেন। তখন আমার মায়ের মুখটা বারবার মনে হচ্ছিল।

মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>