আঙুরির ঈদ আনন্দাশ্রু

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ক্লাসের সব শেষের বেঞ্চের এক কোণে বসে আঙুরি। ছাত্রী মোটামুটি। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। গায়ের পোশাকে কালো কালো তিলক স্পষ্ট। কেউ পাশে না বসলেও নুসরাত বসে তার সঙ্গে। অবশ্য একটি নির্দিষ্ট ক্লাস শেষ হওয়ার একটু আগে। কারণ, নুসরাত প্রথম বেঞ্চে না বসলে টিচারদের সবকিছু শুনতে পায় না। ছোটবেলার অভ্যাস প্রথম বেঞ্চে বসার। আবার আঙুরির জন্যও ভীষণ মায়া লাগে। কেউ বসে না তার পাশে। মমতা ম্যাডামের ক্লাসেই নুসরাত আঙুরির পাশে বসার সুযোগ নেয়। মমতা ম্যাডাম আঙুরির খেয়াল রাখেন সব সময়।

এসেছে কোরবানির ঈদ। কাল থেকে ছুটি।

বিরতির সময় কুসুম, সীমি, নোহা বলছিল তাদের বাবারা কে কত টাকা দিয়ে কিনেছে কোরবানির গরু। নুসরাতের এ সব ভালো লাগে না। গত রাতে নুসরাত তার বাবার কাছে শুনেছে কোরবানি ইতিহাস। কেমন করে প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে পিতা ইব্রাহীম (আ.) কোরবানি দিয়েছিলেন। আল্লাহর হুকুমে কী করে দুম্বা কোরবানি হলো। কেমন করে কোরবানি গোশত দিতে হয় আত্মীয় পরিজন ও দরিদ্রদের। কুসুম, সীমি, নোহা আসে নুসরাতের কাছে। জিজ্ঞেস করে তাদের গরুর দাম, কত বড় গরু কিনেছে তাদের বাবা। নুসরাত জবাব দেয়, দাম আর সাইজ হচ্ছে বড়াই করার জন্য। অহংকার করে এ সব করা ঠিক নয়, আল্লাহ নারাজ হন।

নুসরাতের কাছে পাত্তা না পেয়ে ওরা যায় আঙুরির কাছে। ওরা আঙুরির পোশাক নিয়ে তিরস্কার করে। কোরবানি দিতে পারবে না বলে হাসাহাসি করে। নুসরাত এসে পাশে দাঁড়ায় আঙুরির। ভেংচি কেটে চলে যায় ধনীর দুলালিরা।

ঈদের দিন নুসরাতদের গরু জবাই হয়ে গেছে। নুসরাতের দাদা দাঁড়িপাল্লায় মেপে কাগজের তালিকা দেখে প্যাকেট করছেন। তার বাবা সাহায্য করছেন নুসরাতের দাদাকে। নুসরাত কিছু বলতে চায়, বেশ কয়েক বার আব্বু বলে ডাকে, কিন্তু কিছু বলে না। পরে নুসরাতের বাবা বলে, কি, কিছু বলবি মা।

নুসরাতের জবাব, আব্বু একটা প্যাকেট আমায় দেবে।
তুমি প্যাকেট দিয়ে কি করবে?
আমার বান্ধবী আঙুরিকে দেব।
ও তাই।

নুসরাতের দাদা ভাই খুব খুশি হন নাতিনের কথায়। একটি গোশতের প্যাকেট তুলে দেন নুসরাতের হাতে। নুসরাত ঘরে গিয়ে তার একটি নতুন জামা বের করে ওয়ার্ডরোব থেকে। বড় আপু মারজানকে বলে তার সঙ্গে যেতে। দুই বোন মিলে একটা রিকশা নিয়ে তার খাতায় লেখা ঠিকানা ধরে চলে যায় আঙুরির কাছে।

আঙুরি থাকে শহরের পাশে ঝিলের ওপর পাটাতনের বস্তিতে। দূর থেকে একজন দেখিয়ে দেয় তাদের ঘর। দুই বোন নুসরাত মারজান টিনের একটা দরজা টেনে উঁকি দেয় ভেতরে। আঙুরি বসে আছে। ঘরের মেঝে কাঠের পাটাতনের। কাঠের তক্তার ফাঁকে দেখা যায় শহরের বর্জ্য। আঙুরি তাকিয়ে আছে সে দিকে। ঘরে পুরোনো দিনের একটা বাক্সের ওপর কয়েকটা বই খাতা। পাশে ছেঁড়া চাদরে মোড়ানো কাঁথা। দুটি প্লেট, পুরোনো কয়েকটা হাঁড়ি পাতিল। প্লাস্টিকের জগ ও একটা মগ।

আঙুরি তাদের দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। কয়েক সেকেন্ড। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সে। মারজান ও নুসরাত আঙুরিকে জড়িয়ে ধরে। ঈদ মোবারক জানায়। আঙুরিকে নুসরাতের সালোয়ার, কামিজ পরায়। মারজান সুন্দর করে সালোয়ার–কামিজ পরিয়ে দেয়। আঙুরির চোখে আনন্দাশ্রু।

ঘড়ির কাঁটায় বিকেল চারটা তখন। দরজা ঠেলে প্রবেশ করে আঙুরির মা। তিনিও হতবাক। আঙুরিকে নতুন পোশাকে দেখে এত খুশি হন, আনন্দ আশ্রুতে গাল ভাসে তাঁর। আঙুরি পরিচয় করিয়ে দেয় তার মাকে নুসরাত আর মারজানের সঙ্গে। আঙুরির মা কাপড়ের আঁচলে ঢেকে রাখা খাবার বের করেন। তিনি কাজ করেন এক ধনীর বাসায়। ইতস্তত ভাষায় বলে, কিছু যদি মুখে দেয় এই খাবার থেকে। নুসরাত, মারজান, আঙুরি আর তার মা একসঙ্গে খাবার খায়।

আঙুরির মায়ের অনুমতি নিয়ে আঙুরিকে নিয়ে আসে তাদের বাসায়। নুসরাতের দাদা–দাদু, বাবা–মা খুব খুশি হন নুসরাতের মহানুভবতায়। অহংকার নয় ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত কোরবানি।

গল্পটি কাল্পনিক। আমাদের সন্তানদের মন মানসিকতা কিংবা আমাদের সন্তানদের মানবিক গুণাবলিতে বড় করা উচিত নয় কি?

জাহাঙ্গীর বাবু: সিঙ্গাপুর।