আমরা ঘরে না ফেরা মানুষ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

এই ঈদ মিলিয়ে সর্বমোট নয়টি ঈদ হবে, ফিরব ফিরব করে ঘরে আর ফেরা হয় না। আমার মতো হয়তো অনেকেই আছেন তারাও এবার ঘরে ফিরবেন না। ব্যক্তিগত ও দূরত্বগত নানা প্রতিকূলতায় আমাদের আর ঘরে ফেরা হয় না।

হয়তো এমনও মানুষ আছেন জীবনের পঞ্চাশটি ঈদ পেরিয়ে গিয়েছে, ঘরে আর ফেরা হয় না। শিকড়ের নির্যাস নেওয়া হয় না। কোনো এক কৈশোরে বা যৌবনে সেই যে ঈদে ঘরে ফিরেছিল—বাবা-মা, ভাই-বোনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ করেছিল। সেই যে ঘর ছাড়া হলো। এখন পড়ন্ত বয়স চলছে তবুও ঈদে ঘরে ফেরা আর হলো না।

আমার এই চার বছরের প্রবাসজীবনে নয়টি ঈদ কীভাবে যে চলে গেল টের টুকুও পেলাম না। পরিবারের বাইরে থেকে শুধু মনে পড়ে সাময়িক শূন্যতার যন্ত্রণা। যান্ত্রিক ব্যস্ততায় সব যন্ত্রণা আবার দিন শেষে ভুলেও যাই। মনে বাসা বাঁধে শূন্যতা। বছর শেষে অনুভব করি বুকে শূন্যতার পাহাড়। প্রথম যে ঈদটি জার্মানিতে করেছিলাম তার মাত্র তিন দিন আগে জার্মানির মাটিতে পৌঁছেছিলাম। আমরা বাঙালিরা খুব কাছের না হলে ঈদ জামাত শেষে কোলাকুলি বা আলিঙ্গন করতে খুব একটা অভ্যস্ত নই। আবার এটাও সত্য যে ভিনদেশে ভিনদেশি মানুষের ভিড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব বাঙালিই চিরচেনা ও চির আপন। সেই হিসেবে বিদেশের মাটিতে সেই কাছের মানুষটি হতে পারে বাংলাদেশের মাটিতে বেড়ে ওঠা যেকোনো মানুষ৷

জার্মানিতে ঈদের নামাজ শেষে ভিনদেশি মানুষের ভিড়ে আলিঙ্গন করার মতো বাংলাদেশি কাউকে আমার মেলেনি। আশপাশে হাসিখুশি মানুষগুলো যখন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করছিল, তখন আমি স্মৃতি হাতড়ে আব্বা আর বড় ভাইকে খুঁজছিলাম। মস্তিষ্কে হ্যালুসিনেশনের প্রভাবে ঈদের মাঠে পরিচিত মানুষ দেখছিলাম। মুহূর্তেই তারা মিলিয়েও যাচ্ছিল। এমন যন্ত্রণা ঘুরে ফিরে মানুষের জীবনে কমই আসে। কালির ছোঁয়ায় যেমন সব যন্ত্রণা বর্ণনা করা যায় না। এ ছিল তেমনই এক তীব্র যন্ত্রণা। দেশে আমার আলিঙ্গনের প্রথম মানুষটি ছিলেন আব্বা তারপরে বড় ভাই। এরপরে পরিচিত মানুষ বা কাছের বন্ধু। আক্ষরিক অর্থে সেদিন নিজেকে এতিম মনে হচ্ছিল। যদিও এখন বাস্তবে আমি অর্ধ এতিম। মা আছেন আব্বা নেই। গত বছরের রোজায় আব্বা আমাকে পরবর্তী কোনো আলিঙ্গন করার সুযোগ না দিয়েই চলে গিয়েছেন। বেঁচে থাকলে ঘরে হয়তো ফিরব, তবে আলিঙ্গন করার জন্য এই মানুষটিকে আর সামনে পাব না। পিতৃহারা সন্তানদের জন্য এটি একটি অবর্ণনীয় যন্ত্রণার কথা। এ যন্ত্রণা সবাই বুঝতে পারে না। বোঝার ক্ষমতা তৈরি হয় না। পিতৃহারা আমরা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষগুলোও এতিম। আমাদের সমস্যা হচ্ছে যারা একটু পরিপূর্ণ যুবক বা মধ্যবয়সী হয়ে গিয়েছে তারা বাবা-মা হারালেও তাদেরকে এতিমের কাতারে রাখা হয় না। ২০১৪ সালে সর্বশেষ রোজার ঈদটা পরিবারের সঙ্গে করেছিলাম। এরপরে আর সুযোগ হয়ে ওঠেনি। কবে যে সুযোগ আসবে সে ব্যাপারে সন্দিহান। হয়তো বেঁচে থাকলে সৃষ্টিকর্তায় ইচ্ছায় সামনের কোনো এক ঈদে ঘরে ফিরব।

লেখক
লেখক

সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন পরিচিত মানুষের ছবি ও সেলফি সয়লাব। সবাই ঘরে ফিরছে। পথে নানা রকম যন্ত্রণা। তারপরেও ক্লান্ত ও মলিন মুখে অকৃত্রিম হাসি। ভ্যাপসা গরম, যানজট, দেরি করে বাস আসছে, ট্রেন আসছে, লঞ্চ ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, সঙ্গে নানাবিধ কষ্ট। তারপরেও আমার কাছে তারাই সুখী মানুষ, যারা অন্তত ঘরে ফিরছে৷ এটা যে কত আনন্দের অনুভূতি হতে পারে একমাত্র তারাই বুঝবে যারা আমার মতোই ঘরে না ফেরা মানুষ৷ সুখী মানুষগুলো বাস, ট্রেন ও লঞ্চে করে ঘরে ফিরছে৷ ট্রাফিক জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসের মধ্যে বসে থেকে যে কষ্ট হয়, যে যন্ত্রণা হয়, সব কষ্ট-যন্ত্রণা হাওয়ায় মিলিয়ে যায় এটা ভাবতে যে শিকড়ের কাছে ফিরে যেতে পারছে৷ বাড়ি ফিরেই বাবা-মায়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখ৷ ভাই-বোনের হাস্যোজ্জ্বল মুখ৷ আহ! কী আনন্দ! ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়। ঠাসাঠাসি করে ট্রেনে ঢুকতে কষ্ট হয়, তারপরেও সব পরিশ্রমের ফলাফল সন্তোষজনক সুস্থভাবে মায়ের কোলে ফিরতে পারছে৷ ভাই-বোন মিলে মিশে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে।

বরাবরের মতো এবারেও আমার সাদামাটা ঈদ হবে। রাতে লিখতে গিয়েই মনে পড়ল রাত পোহালেই ঈদ৷ ভিনদেশে আমার সংসার বলতে আমি ও আমার সহধর্মিণী৷ গতবারের মতোই এবারেও দুজনের ঈদ৷ আসলে ঈদ কখনো দুজনের হয় না৷ ঈদের আনন্দ তখনই আনন্দ মনে হয় যখন ঘরের পরিচিত মুখগুলো একত্রে চোখে পড়ে৷ বন্ধুদের সঙ্গে সারা দিন আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া, ঈদ সেলামি আর ভাই-বোনের খুনসুটি৷ সে হিসেবে এটি আক্ষরিক ঈদ, প্রকৃত ঈদ নয়।

প্রবাসের ঈদ শুধু একটা পরিচিত শব্দ মাত্র৷ এতে বিন্দুমাত্র কোনো আবেগ, অনুভূতি বা আনন্দ নেই৷ এবারে ঈদে আর ছুটি নেওয়া হয়নি৷ অফিসে যেতে হবে৷ ঘরে ফেরা সুখী মানুষগুলোর জন্য রইল ঈদের শুভেচ্ছা।

(২০ আগস্ট ২০১৮)

মাহবুব মানিক: গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি।