জিবেল জাইস পর্বতের চূড়ায় এক বিকেলে

জিবেল জাইস পর্বতের চূড়ায় লেখিকা
জিবেল জাইস পর্বতের চূড়ায় লেখিকা

সংযুক্ত আরব আমিরাতের ‘জিবেল জাইস’ নামের পর্বত দেখার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হই দুপুরের পরই। এখানে বসবাসরত পরিবারের সদস্য ও তাঁদের বন্ধুরাসহ সব মিলে চারটি গাড়িতে আমরা ১৮ জন সদস্য। দুবাইয়ের প্রশস্ত রাস্তা ধরে যেতে যেতে বেশ অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম রাস্তার দুপাশের দৃশ্য। যত দূর চোখ যায় শুধুই ধু ধু মরুভূমি। এমন দৃশ্য আগে দেখিনি কখনো। বাইরে খটখটে রোদ, প্রচণ্ড গরম। এসি গাড়িতে বসে বাইরের তাপমাত্রা সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। পথিমধ্যে আমরা যখন থামলাম কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। গাড়ি থেকে বের হওয়া মাত্রই যেন এক আগুনের কুণ্ডলীর মাঝে এসে পড়েছি। ভয়াবহ গরম।

আগস্ট মাসে এখানে এমন গরমই নাকি স্বাভাবিক। এখানে দিনের বেলায় বাইরে যে কাজ হয়, তা বন্ধ থাকে ভয়াবহ এই গরমের সময়ে। দিনের পরিবর্তে রাতের শিফটে কাজ করেন শ্রমিকেরা। কেননা, রাতে তুলনামূলক কম থাকে তাপমাত্রা। ক্ষণিক বিরতি নিয়ে গাড়ি আবারও ছুটে চলছে হাইওয়ে ধরে। যতই আমরা জিবেল জাইস পর্বতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, ততই বিস্ময়ে অভিভূত হচ্ছিলাম। চারদিকে পাথরের পাহাড়। পাথরের গায়ে কোনো ঘাস নেই, গাছ নেই। উঁচু উঁচু পাহাড়ের ভেতর দিয়ে যে পিচঢালা মসৃণ রাস্তা তৈরি করা হয়েছে, পাহাড়ের সেই উচ্চতা পর্যন্ত এত দীর্ঘ পথ কত বছর, কতজন শ্রমিকের শ্রমের ফসল, এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল ভেতরে। ভীষণ আঁকাবাঁকা পথ। গাড়ি ধীরে ওপরে উঠছে। রাস্তাটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, বোঝাই যাচ্ছিল না আমরা ওপরের দিকে উঠছি। যেন সমতল রাস্তা ধরে গাড়ি এগিয়ে চলছে। অথচ ভাবা যায়, আমরা ৬ হাজার ৩৪৫ ফুট উঁচু এক পর্বতের চূড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি!

জিবেল জাইস নামের সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই পর্বতটি রাস আল খাইমাহে অবস্থিত। ওমানের সীমান্তের কাছাকাছি। ১ হাজার ৯৩৪ মিটার উঁচুতে ওঠার পর গাড়িতে আমরা কেউই কারও কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না। সকলের কান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অনেকটা সময়ের জন্য। মনে পড়ে আমেরিকার ভার্জিনিয়ায় ‘লরি কেভার্ন’ নামের প্রাচীন এক গুহা দেখে আমরা যখন পাশের স্কাই লাইন ড্রাইভ ধরে এমন সুউচ্চ এক পর্বতের চূড়ার দিকে যাচ্ছিলাম, তখনো এমনটি হয়েছিল। সেই রাস্তাটি ছিল অনেকটাই খাঁড়া। গাড়িতে ওঠা-নামার সময় ভয়ে আতঙ্কে আমাদের অন্তরাত্মা শুকিয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি গাড়ি উল্টে পড়বে। সেদিন আমরা মেঘের খুব কাছাকাছি গিয়েছিলাম। যেন স্বপ্নময় ঘোর লাগা অন্য কোনো গ্রহ!

জিবেল জাইস পর্বতের চূড়ায় লেখিকা ও অন্যরা
জিবেল জাইস পর্বতের চূড়ায় লেখিকা ও অন্যরা

তবে জিবেল জাইস নামক পর্বতে ওঠার সময় এমন মেঘ স্পর্শ করার মতো কিছু ঘটেনি। গাড়িতে রাস্তা দিয়ে ওঠা নামার সময় ভয় কিংবা আতঙ্ক কাজ করেনি। এখানে ঝকঝকে রোদ। কিন্তু আকাশে নীলের লেশ মাত্র নেই। নীলাকাশ কিংবা ছাই রঙা আকাশ নয়, কেমন যেন পানসে এক রং আকাশের। এখানে বৃষ্টি হয় না বললেই চলে। এত ওপর থেকে নিচের দিকে তাকালে ভয়ে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। ভাবি, স্রষ্টার সৃষ্টির কথা। আমেরিকার নায়াগ্রা ফলস দেখেও আমার ভেতরে একই অনুভূতি হয়েছিল।

পাহাড়ের ওপরে পর্যটকদের ভিড়। তাপমাত্রা বেশ সহনীয়। কেউ বারবিকিউ করছে, কেউ বা চাদর বিছিয়ে খোশ গল্পে মগ্ন। বেশির ভাগই ছবি তোলায় ব্যস্ত। আমরা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া খাবার আর চা দিয়ে বৈকালিক নাশতা সারি আরব আমিরাতের সবচেয়ে উঁচু এই পাহাড়ে। গল্পে গল্পে সন্ধ্যা নামে, রাতের আঁধার ঘনায়। আমরা ফিরে আসার প্রস্তুতি নেই। এত এত উচ্চতাতেও একজন বাংলাদেশি পরিচ্ছন্ন কর্মীর দেখা পাই, যিনি আপন মনে পর্যটকদের সুবিধার্থে জায়গাটিকে পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত। তাঁর এ দেশে আসার গল্পটুকু জানা হয়নি সময় স্বল্পতায়। শুধু জানা যায় তিনি চট্টগ্রামের ছেলে। স্বল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করছেন সেখানে। আমরা ফিরছি অদূরে পার্ক করা গাড়ির দিকে। তিনি স্বদেশিদের সেই পথের দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন এক টুকরো কঠোর পরিশ্রমী, জীবনযুদ্ধে প্রাণান্তকর সংগ্রাম করে টিকে থাকা বাংলাদেশ তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।

উঁচু উঁচু পাহাড়ের ভেতর দিয়ে পিচঢালা মসৃণ রাস্তা
উঁচু উঁচু পাহাড়ের ভেতর দিয়ে পিচঢালা মসৃণ রাস্তা

আমাদের গাড়িগুলো একে একে নিচের দিকে নামতে থাকে। মনে হচ্ছিল যেন গা ছমছমে কোনো অন্ধকার গহ্বরে প্রবেশ করছি। দুপাশে বাদামি রঙের পাথরের পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এগিয়ে যাচ্ছি। আবারও আমাদের কান বন্ধ হয়ে আসে। পৃথিবীর সমস্ত শব্দ যেন থেমে থাকে অনেকটা সময়। বেশ কিছু সময় পর আমরা অনুভব করি সমতল ভূমিতে আমাদের ফিরে আসা। আমরা ফিরি জিবেল আলী নামক স্থানের দিকে। বাড়ির দিকে।

রিমি রুম্মান: দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত।