আমার বাবার দুঃখ

বাবার সঙ্গে লেখক
বাবার সঙ্গে লেখক

আমার বাবা বলেন, ‘বার্ধক্য পুরো জীবনটাকেই চুষে খোকলা করে ফেলে।’ যেমন খোসা না ছাড়িয়ে আম চুষে খেয়ে ফেললে যেমন শুধু আঁটি আর ছালটা বাকি থাকে তেমনি। আমার বাবা ৪০ বছর ধরে দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর কথাগুলো দার্শনিকের মতো।

আমার বাবার বয়েস ৮৬ বছর। ১২ বছর আগে আমার মা গত হয়েছেন। তারপর থেকে আবার বাবা এক ধরনের নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছেন। এ জীবন তিনি স্বেচ্ছায় বেছে নেননি। তার একাকিত্ব ঘোচানোর কেউ নেই। তাই তিনি একাকী হয়ে গেছেন। তার সমবয়সী কোনো বন্ধু বেঁচে নেই। পরিচিত লোকজন এত ব্যস্ত থাকেন যে, তাঁর সঙ্গে সময় দেওয়ার কেউ নেই। তাঁর শিক্ষকদের মতো গাম্ভীর্যপূর্ণ কথাবার্তাও অনেকে উপভোগ করেন না।

আমার বাবার ছাত্রদের অনেকেই এখন অতিরিক্ত সচিব, সচিব ও রাষ্ট্রদূতসহ নানা উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত আছেন। তার অনেক ছাত্র সারা বিশ্বে খ্যাতি ছড়াচ্ছেন। তাদের কথা বাবাকে বললে তিনি যার পর নাই খুশি। কিন্তু তিনি নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। তাঁর ভয়, ছাত্ররা যদি সহানুভূতি দেখায়।

আমিও তেমন কিছু করতে পারি না। কারণ আমি সুদূর ডেনমার্কে থাকি। তিনি আমার এখানে বেড়াতে আসেন। কিন্তু বেশি দিন থাকতে চান না। আমি তাঁকে আমার এখানে স্থায়ীভাবে থাকার কথা বলেছিলাম। কিন্তু দেশের প্রতি তাঁর অসম্ভব টান। তিনি দেশের বাইরে থাকতে চান না। বাবার সবচেয়ে ভয়, যদি তাঁর মৃত্যু যদি বিদেশের মাটিতে হয়।

আমার বাবা যখন আমার বয়সী ছিলেন, তখন তিনি আমার চেয়ে অনেক সবল ছিলেন। তাঁর সাইকেলের সামনে ও পেছনে দুটো সিটে আমি আর আমার ভাই বসতাম। আমি একটু মোটা ছিলাম। তবুও তাঁর চালাতে অসুবিধা হতো না।

তিনি বেশ আমুদে মানুষ ছিলেন। তার রসিকতাগুলো বেশ গভীর অর্থের ছিল। অনেকে বুঝে উঠে পারতেন না।

তিনি অসম্ভব সৎ ও সাহসী শিক্ষক ছিলেন। তার পরীক্ষার হলে কেউ নকল করতে সাহস পেত না। তিনি একবার এক ভয়ানক গুন্ডা ছাত্রকে নকল করার কারণে বহিষ্কার করেছিলেন। ঘটনাটা ওই সময় বাগেরহাট শহরে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

তিনি পোতাদের (আমার ছেলেদের) জন্য পাগল। তিনি যখনই ডেনমার্কে আমার এখানে আসেন সব সময় আমার শিশুদের মাঝে থাকেন। তাদের সঙ্গে তিনি প্রচুর খেলা করেন। আমরা ছোট থাকতে তাঁকে এত শিশুসুলভ দেখিনি।

কয়েক বছর ধরে তাঁর শ্রবণশক্তি কমে আসছে। তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে হিয়ারিং ডিভাইস ব্যবহার করে এখন একটু ভালো শুনতে পান।

তাঁর চোখের অনেক ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। চেখে ঝাপসা দেখছিলেন। অপারেশন করার পর এখন একটু ভালো। তাঁর একটা রোগ একটু কমলে বার্ধক্যের কারণে অন্য রোগ দেখা দেয়। এখন সমস্যা হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের।

তার দুই হাঁটুতে গ্রন্থি বাত হয়েছে। আমি অস্থি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করেছি। বিশেষজ্ঞ এই বয়সে অপারেশন বিপজ্জনক মনে করেন। তিনি হাঁটুতে প্লাস্টার ব্যবহার করেন আর আস্তে আস্তে হাঁটেন।

তিনি মিষ্টি খুব পছন্দ করতেন। ডায়াবেটিকস ধরা পড়ার কারণে এখন মিষ্টি খাওয়া বারণ। তিনি বুড়ো হওয়ার আগে যা যা পছন্দ করতেন, এখন তার কিছুই করতে পারেন না। এটা সব বয়োজ্যেষ্ঠদের মতো তাকেও যথেষ্ট ভোগায়। বার্ধক্য তাঁকে প্রায় অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। একটা রোগ ছাড়ে তো আরেকটা রোগ ধরে।

আমি অসহায়ের মতো তার বুড়ো হয়ে যাওয়ার বেদনা দেখে যাচ্ছি। তিনি দর্শন ও জীবনের তাৎপর্যের ওপর বই লিখতেন। এখন তার সেই জীবনই বার্ধক্যে বন্দী হয়ে আছে। এই বন্দী জীবনে তিনি খুব কষ্ট পাচ্ছেন। তিনি এই দীর্ঘ জীবনের ওপর বিরক্ত। তিনি বলেন, আমি শুধু বেঁচেই যাচ্ছি। তাঁর সমবয়সী কেউ নেই, শুধু তিনি আছেন। তিনি নিজের মৃত্যু কামনা করছেন। তাঁর বড় ভয় হঠাৎ পঙ্গু হয়ে অন্যের ওপর নির্ভর করে বাঁচতে হলে। আমি শুধু অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে শুনে যাই।

আমার করার কীই-বা আছে। আমিও তো একদিন এমন হব যদি অতদিন বেঁচে থাকি। বুড়ো জীবন কেমন হতে পারে তাঁকে দেখে বুঝি। বুড়ো হয়ে যেতে থাকলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা লোপ পায়। নতুন জীবকোষের সৃষ্টি হয় না। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। মানুষ ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে থাকে।

বার্ধক্যের কোনো ইতিবাচক দিক নেই। বার্ধক্য মৃত্যুর মতোই একটা নিষ্ঠুর সত্য। আমার বাবা তা বুঝতে পেরেছেন। তিনি বলছেন, দীর্ঘ জীবন কোনো আশীর্বাদ নয়।
...

ওবায়দুল করিম খান: ডেনমার্ক। ইমেইল: <[email protected]>