শুক্লপক্ষের অপেক্ষায়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে রাহনুমার। দ্রুত নিশ্বাসের সঙ্গে বুক ওঠানামা করছে অস্বাভাবিকভাবে। তাকে দেখে লাগছে বাঘের তাড়া খেয়ে ছুটে পালানো কোনো ত্রস্ত হরিণের মতো, বুঝি এখুনি এসে গেল বাঘের নাগালে। ঘামে ভেজা মুখ ১০০ ওয়াটের বাল্বের আলোয় চকচক করছে। মনে হচ্ছে ছোট ছোট মুক্তোর দানা বিন্দু বিন্দু করে লাগানো আছে মুখের মাঝে।

একরামেরও ঘুম ভেঙে গেছে। রাহনুমার পাশে ঘুম জড়ানো চোখ নিয়ে বসে আছে। গত চল্লিশ বছর ধরেই এমনটা হচ্ছে। যখন-তখন রাহনুমার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম থেকে উঠে ঘামে জবজবে শরীর আর দ্রুত নিশ্বাসে ওঠানামা করা বুক নিয়ে সে বসে থাকে, ভীতসন্ত্রস্ত অসহায় হরিণের মতো।

একরাম চোখ কচলে টেবিলের দিকে যায়। একরাম জানে রাহনুমা এখুনি পানি খেতে চাইবে। পানির জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে রাহনুমার দিকে এগিয়ে আসে।

রাহনুমা কোনো দিকে না তাকিয়েই উদ্‌ভ্রান্তের মতো বলল, পানি! পানি খাব!

একরাম পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়।

ঢকঢক করে পানির গ্লাসটা খালি করে ফেলে রাহনুমা। কিছুটা পানি গড়িয়ে পড়ে তার বুক ভিজিয়ে নিচের দিকে নেমে যায়। এতক্ষণে কিছুটা পানি তার চোখ থেকেও গড়াতে শুরু করেছে।

: আবার স্বপ্ন দেখেছ? একরাম নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে।

একরাম অবশ্য জানে রাহনুমা আবার স্বপ্নটা দেখেছে। তবু পরিস্থিতিটাকে একটু হালকা করতেই প্রশ্নটা করা। রাহনুমাও জানে একরাম জেনেই প্রশ্নটা করেছে। তাই সেও আস্তে করে উত্তর দেয়, হুম।

: স্বপ্ন তো স্বপ্নই, তাই না?

: যখন দেখি তখন আর স্বপ্ন বলে মনে হয় না। মনে হয় সত্যিই আমি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। আর ছোট ডিঙিটা ডুবে যাচ্ছে, তার সঙ্গে কেউ একজন ডুবে যাচ্ছে।

: ভয় পেয়েছ?

: হুম।

: তুমি তো ডাক্তারের কাছেও যেতে চাও না।

: ডাক্তারের কাছে কেন যাব? আমার তো কোনো অসুখ হয়নি।

: অসুখ নাতো কী? কয়দিন পর পরই স্বপ্ন দেখ তুমি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছ আর আমি ডিঙি করে নদী পার হতে গিয়ে ডুবে মরে যাচ্ছি। এটার কোনো মানে আছে। নদীর কাছেতো দূরের কথা তোমাকে নিয়েতো কোনো দিন পুকুরের কাছেও যাইনি।

একরাম বালিশটাকে ঠিক করে নিয়ে আবার ঘুমানোর আয়োজন করে।

: আচ্ছা, আমাদের দেশের গড় আয়ু কত এখন? একরামের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চায় রাহনুমা।

: কেন? হঠাৎ আয়ু জানতে চাইছ কেন?

: বলই না, কথার পিঠে কথা আমার একদম ভালো লাগে না।

: পুরুষদের ৬৮, আর মহিলাদের ৭০।

: তাহলে তো আর বেশি দিন সময় নেই হাতে, ৬৫ হয়ে গেছে।

: হুম, তা ঠিকই বলেছ। এত বছর যে বেঁচে আছি সেই তো অনেক। কত লোকজনতো জীবন শুরু হবার আগেই মরে যাচ্ছে। সে হিসাবে তো এখন বোনাস পিরিয়ড চলছে আমাদের।

: হুম, কত লোক তো জীবন শুরু হবার আগেই মরে যাচ্ছে। বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রাহনুমা। সাতচল্লিশ বছরের পুরোনো দীর্ঘশ্বাস। তার দুই চোখ দিয়ে আবার অশ্রু গড়াতে শুরু করেছে। বাতি বন্ধ থাকায় একরাম দেখতে পাচ্ছে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একরামের ভোস-ভোস ঘুমের আওয়াজ পাওয়া যায়। রাহনুমা জেগে থাকে। সে আর ঘুমাবে না। ফিরে যাবে সাতচল্লিশ বছর আগের দিনগুলোতে।

দুই.

রোজকার মতোই সবাই সবার জীবন শুরু করেছে। রাস্তার ইলেকট্রিকের তারের ওপর বসে কাকগুলো কা কা করেই যাচ্ছে। রাহনুমার বারান্দার হাসনাহেনা গাছ থেকে কড়া ঘ্রাণ আসছে। একরাম হয়তো তার অফিসে ফাইলপত্র ঘাঁটছে অথবা চা খাচ্ছে কিংবা হয়তো কোনো মিটিংয়ে ব্যস্ত। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর কিছুদিন ঘরে শুয়ে-বসে কাটিয়েছে। পরে বেকার জীবন ভালো না লাগায় একটা প্রাইভেট ফার্মে যোগ দিয়েছে। সময় ভালোই কাটছে। রাহনুমারও সময় কাটে। ছেলেপুলে নেই। একাকী জীবন। অনেক বছর একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেছে। স্কুলের চাকরিটা নেওয়ার পেছনে কারণ ছিল সব সময় ছোট ছোট ছেলেমেয়ের মাঝে থাকা। এতে কাজও হয়েছিল কিছুটা। নিজের ছেলেমেয়ে না থাকার ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিল সে।

আর যদি হুট করে কখনো শীতের বাতাসের মতো কোনো ফুটো দিয়ে সে ব্যথাটা তার হৃদয়ে ঢুকেই যেত, তখন রাহনুমা আলমারি খুলে তার সন্তানকে বের করত।

কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে হাসনাহেনার গন্ধ আর কাকের কা কা ডাকের মাঝে এ সকল ভাবনা মিলে একটা ঘোলাটে অবস্থা তৈরি হয় রাহনুমার মনের ভেতর, মাথার ভেতর।

হুম, রাহনুমারও একটা সন্তান ছিল। ছিল কি, আছে? ভ্রূণ হয়ে আছে। পৃথিবীর আলো দেখতে পায়নি। রাহনুমার খুব ইচ্ছে সেই ভ্রূণটাকে পৃথিবীর আলো দেখায়।

সাতচল্লিশ বছর ধরে সেই ভ্রূণ লালন করে যাচ্ছে রাহনুমা।

রাহনুমা ঘরে ভেতর আসে।

তার বুকশেলফ থেকে একটা পুরোনো ডায়েরি বের করে। তার সন্তান। চামড়ার কাভার দিয়ে বাঁধানো ডায়েরি। জীর্ণ শীর্ণ কভার। জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। চামড়ার ফুটো ভেদ করে ফোমের অংশ উঁকি ঝুঁকি মারছে। এই ডায়েরির বয়স কত সে জানে না। তবে সাতচল্লিশ বছর ধরে এটিকে সে সযতনে আগলে রেখেছে। ডায়েরির পাতার ভেতর প্রথম পাতায় বড় করে লেখা ‘পাণ্ডুলিপি’। তারপর একের পর এক পাতা উলটে যায় রাহনুমা। একটির পর একটি কবিতা পড়ে যায়। কত ধরনের কবিতা-সমাজ, দর্শন, প্রেম, প্রকৃতি কিছু বাদ নেই। পুরো পাণ্ডুলিপিতে তিয়াত্তরটি কবিতা। গত সাতচল্লিশ বছর ধরে পড়তে পড়তে তার মুখস্থ হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে পাতা ওলটায় আর ডায়েরির গায়ে হাত বুলিয়ে যায় রাহনুমা। আর ভাবে সময় বেশি নেই। গড় আয়ু যদি ৭০ বছর হয়, আর সময় বেশি নেই। সবাই তো ৭০ বছর বাঁচেও না, সত্যি সময় বেশি নেই। সেই সংক্ষিপ্ত সময়ও রুটিন মেনে তার মতো করে চলে যাচ্ছে।

তিন

রাহনুমা তখন সবে কলেজে উঠেছে। আর তক্ষুনি তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। রাহনুমা খুব খুশি। পড়াশোনা তার ভালো লাগে না। বিয়েটা হয়ে গেলে পড়াশোনা সে বাদ দিয়ে দেবে। রাহনুমার মা-বাবা চেয়েছিলেন বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক। দেশের অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। কখন কী হয়ে যায়, কেউ বলতে পারে না। মিলিটারি যখন-তখন আসে অবস্থা। মেয়েকে নিয়ে তাই খুব একটা ভরসা পাচ্ছিলেন না। এমন রূপবতী কিশোরী মেয়ে এ তল্লাটে নাই। তাই তাড়াহুড়া করেই রাহনুমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।

মাঈনুল ভাইকে রাহনুমার দারুণ পছন্দ। যদিও মাঈনুল ভাই সব সময় ধমক দিয়ে কথা বলেন। তবুও তার ভালো লাগে। রাহনুমার মনে হয় বিয়ের পর সে এমন সব কাজ করবে যাতে মাঈনুল ভাইয়ের মেজাজ যখন-তখন বিগড়ে যায়। মাঈনুল ভাই ধমকে যাবেন আর রাহনুমা হাসতে থাকবে। ধমক দিতে দিতে মাঈনুল ভাই ক্লান্ত হয়ে যাবে, কিন্তু হাসতে হাসতে সে কখনই ক্লান্ত হবে না।

মাঈনুল ভাইও তখন কলেজে পড়েন। তার কলেজজীবন শেষ হবে হবে করছে। বয়স হবে ১৯ কী ২০ বছর। বড় বড় বাবরি চুল। তামাটে বর্ণ। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। আর বিগড়ানো মেজাজ। এই বিগড়ানো মেজাজটাই রাহনুমার সবচেয়ে পছন্দ ছিল।

কিন্তু মাঈনুলের বোধ হয় রাহনুমাকে পছন্দ হতো না। দেখলেই কেমন ধমকে ধমকে কথা বলত। রাহনুমা আর মাঈনুলের বিয়ে ছোটবেলা থেকেই ঠিক করা। মাঈনুলের নানা ছোটবেলায় মাঈনুল আর রাহনুমার ভাব দেখে মাঈনুলের বাবাকে বলেছিলেন, আমিনুল, তোর ছেলের সঙ্গে রাহনুমার বিয়ে দেব। আমি যদি মরেও যাই তুই কিন্তু আমার কথা রাখবি। রাহনুমার বাবারও বোনের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়েতে কোনো আপত্তি ছিল না। বরং তিনিও এমনটাই চেয়েছিলেন। মেয়ে ঘরেই থাকুক, অন্য কোথাও না যাক। এই মেয়ে অন্য ঘরে চলে যাবে আর তিনি বসে বসে মেয়ের চিন্তায় না খেয়ে মরে যাবেন, এমন ভয় তার মনে সব সময়ই কাজ করত।

মাঈনুল আস্তে আস্তে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল। কারও সঙ্গে কোনো কথা বলে না। একা একা কী জানি ভাবে সারাক্ষণ। কলেজে ইচ্ছে হলে যায়, ইচ্ছে হলে যায় না। কলেজ ছুটি হলে রাহনুমা মাঈনুলদের বাড়িতে যায়। মাঈনুল রাহনুমার সঙ্গে কোনো কথা বলে না। ঘরে ঢুকলে ধমক দিয়ে বের করে দেয়। রাহনুমার কেমন যেন লাগে। এই ধমক তো চিরচেনা ধমক নয়। মাঈনুলের মা-বাবার চোখে মুখেও দুশ্চিন্তা। ছেলে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। তবে কী বিয়েতে মাঈনুলের মতো নেই? সে কী অন্য কাউকে পছন্দ করে?

মাঈনুলের বাবা স্ত্রীকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, কীগো মাঈনুলের মা, তোমার ছেলের ভাব-গতিক কিছু বুঝতে পার? তার কি বিয়েতে মত নাই?

: কী জানি, কিছু তো বুঝতে পারি না। কেমন জানি হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেছে ছেলেটা। মাঈনুলের মা জবাব দেন।

বিয়ের সময় ঘনিয়ে আসে। মাঈনুল আরও চুপচাপ হয়ে যায়। কারও সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলে না। কোথায় যায়, কী করে, কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।

চার

আকাশে মাঈনুল এর আগে এত বড় চাঁদ দেখেনি। রাত খুব একটা হয়নি। কিন্তু সারা দিনের গতরখাটা ক্লান্তি শেষে যখন কিছুটা রাত নেমে আসে, এ গ্রামের মানুষগুলো গ্রামটাকে কবরের মতো নিস্তব্ধ করে দিয়ে ঘুম দেয়। কিংবা তারা ঘুমায় না। ভয়ে ভয়ে জেগে থাকে। রাতের নিস্তব্ধতার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে মাঈনুল আস্তে করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল।

রাহনুমার চোখেও কোনো ঘুম নেই। মাঈনুল ভাই তার সঙ্গে এখন এমন করে কেন? চিন্তায় তার ঘুম আসে না। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে তার চেতনা ফিরে আসে। কে? ভয়ার্ত স্বরে সে জানতে চায়।

: আমি, আমি মাঈনুল। চাপা স্বরে জবাব আসে।

রাত্রির নিস্তব্ধতা সে চাপা স্বরকেও পৌঁছে দেয় রাহনুমার কাছে।

রাহনুমা দরজা খোলে। চাঁদের আলোয় মাঈনুল ভাইয়ের তামাটে বর্ণ কেমন যেন ঔজ্জ্বল্য ছড়ায়, কিন্তু সেই উজ্জ্বল চেহারায় কীসের যেন একটা ফ্যাকাশে প্রলেপ ছড়ানো।

কেউ কোনো কথা বলে না। মাঈনুল রাহনুমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর রাহনুমা নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে।

: আকাশে কেমন চাঁদ দেখ রানু? চল নদীর ধারে যাই।

রাহনুমা তাকায় না। রাহনুমার চোখে পানি চলে আসে। চাঁদের আলোয় সেই অশ্রুবিন্দু মুক্তোর মতো ঝরতে থাকে। মাথার ঘোমটাটা টেনে দিয়ে সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাঈনুলকে অনুসরণ করে। কিছুটা পথ গিয়ে রাহনুমা তার হাতটা মাঈনুলের হাতে একটু একটু করে ছুঁয়ে দেয়। মাঈনুল শক্ত করে রাহনুমার হাতটা ধরে। রাহনুমা তার ঘোমটাটা ছেড়ে দেয়। নেশা লাগানো একটা চাঁদ তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়।

চন্দ্রপুকুর নদী কলকলিয়ে বয়ে চলেছে। চাদের আলোয় চন্দ্রপুকুর নদীর রূপ যেন পূর্ণতা পেয়েছে। মনে হচ্ছে কেউ নদীর বুকে রুপার প্রলেপ ঢেলে দিয়েছে। নদীর পাড়ে অসংখ্য ছাতিম গাছ পাতা ঝরিয়ে দিচ্ছে বাতাসের তালে তালে। বাতাস, ছাতিম গাছ আর চন্দ্রপুকুর নদীর এই প্রণয়ের সাক্ষী হয়ে নদীর পাড়ে হাতে হাত রেখে চুপ করে বসে আছে মাঈনুল আর রাহনুমা।

: রানু।

: কী?

: আমি তোকে বিয়ে করতে পারব না।

: রানু কোনো উত্তর দেয় না।

: আখিতাড়া গ্রামে মিলিটারি আসছে। অসংখ্য ঘরবাড়ি পুড়ায়া দিছে। নৃপেন স্যারকেও মাইরা ফেলছে।

রানু কিছু বোঝে না। এটুকু বোঝে মাঈনুল ভাই অনেক খবর জানেন। সারা দিন রেডিও নিয়া বসে থাকেন, কোথায় কী হয় সব খোঁজ রাখেন।

: রানু, অই যে দেখ ডিঙি নাও দেখা যায়।

রানু মাঈনুলের আঙুল বরাবর তাকায়। অদূরে একটা ছোট্ট ডিঙি। দুজন লোক বসে আছে।

চাদরের আড়াল থেকে মাঈনুল একটা ডায়েরি বের করে।

: রানু, এই ডায়েরিখানা তুই যত্ন করে রাখবি। আমি ফিরে এসে তোর কাছ থেকে নিব। যত্ন করে রাখবি, যেন হারায় না।

তারপর অনেকক্ষণ চন্দ্রপুকুর নদীর পাড়ে কোনো শব্দ হয়নি। নদী তার কলকল শব্দ বন্ধ করে দিল। বাতাসেরও কোনো শব্দ পাওয়া যায়নি। ছাতিম গাছগুলো কোনো পাতা ঝরায়নি।

ডিঙি নৌকা থেকে লোকজনের ইশারা এল। মাঈনুল উঠে দাঁড়াল। রাহনুমা সঙ্গে সঙ্গে গেল, শক্ত করে মাঈনুলের হাতটা ধরে রইল।

: বাড়ির কাউকে কিছু বলি নাই। শুধু তালিব জানে। ওকে রেখে গেলাম তোদের সবাইকে দেখার জন্য। তুই সবাইকে বুঝিয়ে বলিস।

রানু মাথা নাড়ল। তার চোখ দিয়ে আরেকটা চন্দ্রপুকুর নদী নেমে গেছে তা মাঈনুল দেখতে পায়নি।

: ফিরে আসলে আমাদের বিয়ে হবে রানু। এখন কি বিয়ে করার সময় বল? যখন ফিরে আসব তখন এই দিন থাকবে না। বিয়ের দিন রাতটা আমরা এই চন্দ্রপুকুর নদীর ওই ছাতিম গাছের নিচে ওই জায়গাটাতে বসেই কাটিয়ে দিব? ঠিক আছে না?

: হুম। রাহনুমা এর বেশি কিছু বলতে পারল না।

মাঈনুল ধীরে ধীরে চন্দ্রপুকুর নদীতে নেমে গেল। যতক্ষণ ডিঙি নৌকা দৃষ্টির সীমানার মধ্যে ছিল রাহনুমা তাকিয়ে থাকল। অতঃপর নৌকাটা যখন আর দেখা গেল না, তখন মাঈনুলের ভাই তালিব কোথা থেকে এসে বলল, ভাবি চলেন, বাড়িতে যাই। রাহনুমা ডায়েরিটা শক্ত করে বুকে জড়িয়ে চাঁদের আলোয় এক বুক অন্ধকার নিয়ে হেঁটে চলল। রাহনুমার চন্দ্রপুকুর নদীতে জোয়ার এসেছে।

পাঁচ

আরও একবার মাঝরাতে ঘর্মাক্ত শরীর আর ঘুম জড়ানো চোখ নিয়ে বসে আছে রাহনুমা। দ্রুত নিশ্বাসের সঙ্গে বুক ওঠানামা করছে অস্বাভাবিকভাবে। একরাম পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বসে আছে। গ্লাসটা অবশ্য খালি।

: স্বপ্নটা আবার দেখেছি, নিচের দিকে তাকিয়েই রাহনুমা বলল।

: হুম। দেখলে আমি খেয়া পার হতে গিয়ে ডুবে মরে যাচ্ছি।

: আমি সারা জীবন তোমার কাছে একটা মিথ্যে বলে এসেছি।

: মিথ্যে?

: হুম, স্বপ্নে আমি আসলে তোমাকে দেখি না। এত দিন মিথ্যে বলে এসেছি। স্বপ্নে আমি আসলে মাঈনুল ভাইকে দেখি। মাঈনুল ভাই ফিরে আসেননি। সবাই বলেছিল মাঈনুল ভাই খুব সাহসের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন মিলিটারির হাতে ধরা পড়ার আগে। তারপরের খবর আর কেউ কিছু বলতে পারে না।

সে রাতে রাহনুমা অনেক কাঁদল। যে কান্নাটা সাতচল্লিশ বছর আগে চন্দ্রপুকুর নদীর পাড়ে তার মাঈনুল ভাইকে জড়িয়ে ধরে সে কাঁদতে চেয়েছিল সেটা সে মিরপুরের দুই রুমের এই ফ্ল্যাটটাতে মাঝরাতে একরামকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল।

ছয়

অনেক দিন হয়ে গেল, রাহনুমা এখন আর মাঝরাতের স্বপ্নটা দেখছে না। রাতে তার খুব ভালো ঘুম হয়। একরামের ডায়াবেটিস আছে। রাতে মাঝে মাঝে তার ঘুম ভেঙে যায়। অনেক সময় ভোর রাতের দিকে ঘুম ভেঙে গেলে একরাম আর ঘুমায় না। আলমারি থেকে পুরোনো ডায়েরিটা বের করে পড়ে। সকাল হলে অফিস চলে যায়। রাহনুমা বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে কাকের ডাক শোনে। কাকের ডাক তার কাছে খুব একটা খারাপ লাগে না। হাসনাহেনা ফুলগুলো তাদের মতো করে সুবাস ছড়িয়ে যায়।

এরপর একদিন একটা লোক এল রাহনুমাদের বাসায়। অফিস শেষে একরাম নিয়ে এসেছে। রাহনুমা লোকটাকে চেনে। তিনি একজন নামকরা প্রকাশক। বিদায়বেলায় প্রকাশক রাহনুমার পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে যান। একরাম রাহনুমার কাঁধে হাত রেখে বলেন, আগামী বইমেলায় পাণ্ডুলিপিটা বই আকারে বের করব বলে ঠিক করেছি। প্রকাশক রাজি হয়েছেন। আমাদের তো আর বেশি দিন সময় নাই। তোমার ৬৫, আর আমার ৬৪। বেশি দিন তো আর আমরা পাণ্ডুলিপিটা আগলে রাখতে পারব না। বাকি যে কয়দিন সময় আছে হাতে চল দুজনে মিলে খুঁজে দেখি মাঈনুল সাহেবের শেষ ঠিকানাটা খুঁজে বের করতে পারি কিনা-কবর, বধ্যভূমি, যাই হোক। আর একটা কথা, নদীর পাড়ের সেই ছাতিম গাছটার নিচেও একদিন আমরা বসব, যখন আকাশে ভরা পূর্ণিমা থাকবে।

রাহনুমা কিছু বলল না। তার চোখে ভেসে উঠল, রুপালি নদী, জোছনা আর ছাতিম গাছের পাতা ঝরানোর শব্দ।
...

মনোয়ার মোকাররম: দিল্লি, ভারত।