দিঘল মেঘের দেশে-চার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দীর্ঘ ছুটির পর অফিস খুললে যেমনটা হয়। অফিসের কাজকর্ম খুব ধীরে চলে। কর্মচারী ও কর্মকর্তারা ওম দেওয়া মুরগির মতো গা ফুলিয়ে চলে। কেউ হাঁটে তো হাঁটে না। কেউ বসে তো বসে না। আজ রাকিবের অফিসে তেমনটাই হচ্ছে। সবার মধ্যে দীর্ঘ ছুটির রোমন্থন। প্রথম দিন বলে অনেকেই অফিসে আসেননি। ওয়ার্কশপে লোকজন খুব কম। ক্রেতা, বিল্ডার বা কনট্রাকটরদের ভিড় একেবারেই নেই। সর্বত্র ঝিম ধরা একটা পরিবেশ।

প্রায় একুশ দিন পর আজ অফিস খুলেছে। সেই ডিসেম্বরের ২২ তারিখ অফিস বন্ধ হয়েছে, আজ জানুয়ারির ১৪ তারিখ। এবারের বড়দিন ও নতুন বছরটা রাকিবের বেশ ভালোই কেটেছে। অন্যান্য বছর এই দীর্ঘ ছুটিতে সে এদিক-ওদিক ঘুরতে চলে যায়। কিন্তু এবার নদী আছে বলে সে দূরে কোথাও ঘুরতে যায়নি। সপ্তাহের দুই-তিন দিন বিকেলে ওয়াইকাটো নদীর পাড় ধরে দীর্ঘপথ হাঁটা। কোনো কোনো বিকেলে হায়াস প্যাডকের ওক গাছগুলোর নিচে বসে নতুন কবিতা আবৃত্তি করা। কোনো কোনো রাতে কারি পট ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খাওয়া। এ ছাড়া নদী তিন-চার দিনদুপুরেও তার বাসায় চলে এসেছিল। অগোছালো বাসা গুছিয়ে দিয়েছিল। একদিন কিচেনে রান্নায় সহযোগিতা করেছিল। একটা আবেশ। একটা অনুভূতি। একটা আনমনার ভেতর বসবাস ছিল।

কিন্তু সেদিন শনিবার প্রফেসর ড. নিকোলাস রজারসনের বাসায় না গেলে রাকিব এখনো সত্যি সেই আনমনার ভেতর বসবাস করত। তারপর সেই শনিবারের পর আরেক শনিবার গেছে। আজ সোমবার। নদী এরই মধ্যে একটা বারও আসেনি। অবশ্য দুই-তিন দিন নিয়মমাফিক ফোন দিয়েছে। রাকিব ফোনে কথা বলতে গিয়ে অনেক কিছু পাশ কেটে গেছে।

রাকিবের ফোনে পাশ কেটে যাওয়ার অভ্যাস অনেক দিনের। এটা তার নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার একটা প্রবণতা। যদিও নদীর সঙ্গে তার তেমন কিছু হয়নি। নদী ঠাট্টা করে মাঝেমধ্যেই এটা-সেটা বলে। আর প্রফেসর রজারসনকেই বা সে কত দূর জানে? তার কটু ও অযৌক্তিক কথাগুলোতে গা না মাখলেই হতো?

রাকিব নিজে নিজে মাথা ঝাঁকাল। ভাবল, কী জানি! তারপরও সে নদীর কাছ থেকে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। রাকিব জানে, সারাটা জীবন সে নিজেকে গুটিয়ে রাখার যুদ্ধে পরাস্ত হতে হতে এ পর্যায়ে এসেছে। মৃদুমন্দ একটা দক্ষিণের বাতাসের আবেশ। একটু নরম উষ্ণতা। একটা আবেগ জড়ানো মুগ্ধতা। কবিদের বুঝি এভাবে বারবার পরাস্ত হতে হয়?

রাকিবদের অফিস ছুটি হয় পাঁচটায়। অফিসের কাজ সাধারণত সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। কিন্তু ওয়ার্কশপ খোলা থাকে চব্বিশ ঘণ্টা। রাকিবও এক সময় সেই ওয়ার্কশপে সিফটিং ডিউটি করত। গত দেড় বছর ধরে সে নয়টা-পাঁচটা অফিস করছে।

নয়টা-পাঁচটা অফিস হলেও রাকিবকে মাঝেমধ্যে আরও দুই-এক ঘণ্টা বেশি থাকতে হয়। মাঝেমধ্যে তাকে সাইডে যেতে হয়। কখনো করোগেটেড আয়রনের ডেলিভারি সংক্রান্ত ঝামেলা থাকলে ছয়টা-সাতটার সময় অফিস থেকে বের হতে হয়।

কিন্তু আজ অফিসে কোনো কাজ নেই বলে রাকিব চারটার সময়ই অফিস থেকে বের হয়ে গেল। অফিস থেকে বের হয়ে সে সরাসরি বাসার দিকেই রওনা দিল। তার ইচ্ছে, বাসায় গিয়ে কাজের কাপড়-চোপড় ছেড়ে হালকা ধরনের কাপড় পরে জুরাসিক ওয়ার্ল্ড-টু মুভিটা দেখতে যাবে। জুরাসিক সিরিজের সব মুভি সে দেখেছে। সেই নব্বই দশকে জুরাসিক পার্ক-ওয়ান দেখেই রাকিব খুব মুগ্ধ হয়েছিল। সেই থেকে জুরাসিক পার্কের তিনটা পার্ট ও জুরাসিক ওয়ার্ল্ড-ওয়ান, কোনোটাই বাদ দেয়নি।

রাকিবের মনে মনে নদীকে সঙ্গে নিয়ে মুভিটা দেখার ইচ্ছে হলো। কিন্তু ইচ্ছে হলেই কী হয়? আর নদী!

ফ্রাঙ্কটন থেকে কিলারনি রোড ধরে লেক ক্রিসেন্ট ঘুরে ব্রিজ স্ট্রিট ও গ্রে স্ট্রিট দিয়ে বাসায় ফিরতে রাকিবের খুব বেশি সময় লাগে না। সচরাচর পনেরো মিনিট লাগে। অফিস ছুটির সময় যানজটের কারণে হয়তো বিশ মিনিট সময় লেগে যায়। কিন্তু আজ সে অফিস ছুটির সময়ই পনেরো মিনিটে বাসায় চলে এল। গাড়িটা বাসার সামনে ড্রাইভওয়েতে পার্ক করে কী মনে করে চিঠির বাক্সে গেল। চিঠির বাক্স খুলতেই দেখল, আজ বেশ কয়েকটা চিঠি এসেছে। এর মধ্যে আতিকের নামে দুটো চিঠি, তার নিজের নামে চারটা চিঠি। তার নিজের এই চারটা চিঠির মধ্যে তিনটা চিঠিই বিভিন্ন ব্যাংকের। আর একটা চিঠি একটা ল ফার্মের মনোগ্রাম সংবলিত। তবে খামের গায়ে প্রেরকের নাম নেই।

রাকিব অবাক হলো। ল ফার্মের মনোগ্রামে চিঠি? কে লিখেছে? একটা সময় এসব ল ফার্মের মনোগ্রামের চিঠি সে বেশ পেত। সেটা তো বছর কয়েক আগে।

রাকিব মনোগ্রামের নিচে ছোট্ট ছোট্ট অক্ষরে লেখা ঠিকানাটা ভালোভাবে দেখে তৎক্ষণাৎ কেমন চমকে উঠল। শুধু চমকে ওঠা নয়, তার ভেতর রক্তের একটা ক্ষীণ ধারা পা থেকে মাথা পর্যন্ত শির শির করে নাড়িয়ে দিল। তার ঠোঁট গলে আপনাআপনি একটা অস্ফুট শব্দ বের হয়ে এল, এমেন্ডার চিঠি!

রাকিব চিঠির বাক্সের কাছে দাঁড়িয়েই খামটা খুলল। দেখল, হ্যাঁ, এমেন্ডার চিঠিই। ল ফার্মের প্যাডেই লেখা। মাত্র আট লাইনের চিঠি। রাকিব এক শ্বাসে যেন চিঠিটা পড়ল।

চিঠির বিষয়বস্তু খুব সাধারণ। কোনো জরুরি কিছু লেখা নেই। এমেন্ডা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন চলে যাচ্ছে। যাওয়ার আগে সে সাদিয়ার ডেথ সার্টিফিকেটসহ কিছু কাগজপত্র ও একটা ছবির অ্যালবাম দিয়ে যেতে চাচ্ছে। তাদের ল ফার্মের একটা অফিস মেলবোর্নে খুলেছে। এমেন্ডা তিন সপ্তাহ পর হেভলুক নর্থ থেকে মেলবোর্নে চলে যাবে। রাকিব যেন এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে হেভলুক নর্থ থেকে ঘুরে যায়।

যদিও খামের মনোগ্রামের নিচে অফিসের ঠিকানা লেখা আছে, তারপরও এমেন্ডা নিজ হাতে চিঠির নিচে তার অফিসের ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর লিখে দিয়েছে।

রাকিব বাসা ঢুকতে ঢুকতে ভাবল, সাদিয়ার ডেথ সার্টিফিকেট, কাগজপত্র ও ছবির অ্যালবামটা তো এমেন্ডা ডাকেই পাঠাতে পারে? এগুলোর জন্য তাকে কেন হেভলুক নর্থ যেতে হবে? সেই চার শ কিলোমিটার দূর। কত দূরের পথ!

রাকিব বাসায় ঢুকে অফিসের কাপড়চোপড় না ছেড়ে সোফায় গা ছেড়ে বসল। কয়েক মুহূর্ত ঝিম মেরে বসে থেকে টি-টেবিল থেকে চিঠিটা নিয়ে আবার পড়ল। এমেন্ডার একটা মোবাইল নম্বর তার কাছে ছিল। তবে সেই নম্বরে গত আড়াই-তিন বছরে তাদের কোনো কথা হয়নি। সর্বশেষ কথা হয়েছিল সাদিয়ার মৃত্যুর পর।

রাকিব কী ভেবে এমেন্ডার সেই পুরোনো মোবাইল নম্বরটায় প্রথমে ফোন দিল। ওপাশে থেকে মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্নের একটা মেসেজ পেল। সঙ্গে সঙ্গে চিঠির নিচে এমেন্ডার হাতের লেখা নতুন মোবাইল নম্বরটা নিল। নম্বরটা সেভ না করেই সে ফোন দিল। ওপাশে রিং বাজছে তো বাজছেই। কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না। রাকিব কেটে দিয়ে এবার নম্বরটা তার কল লিস্টে সেভ করল। তারপর আবার ফোন দিল। কিন্তু এবারও ওপাশে কেউ ফোন ধরছে না।

রাকিব এবার মনে মনে বিরক্ত হলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তার খানিকটা ক্ষুধা পেয়েছে। দুপুরে সে ভারী কোনো খাবার খায়নি। অফিসে থাকলে দুপুরে এমনিতেও ভারী খাবার খায় না। স্যান্ডউইচ বা বার্গার ধরনের খাবার খায়। অফিসের পাশেই ফার্স্ট ফুডের দোকান ম্যাকডোনাল্ডস ও বার্গার কিং। খানিকটা দূরে একটা বেকারি ও ফিশ অ্যান্ড চিপসের দোকান। রাকিব একটা কিছু দিয়ে দুপুরের খাওয়াটা সেরে নেয়।

আজ রাকিব বেকারি থেকে একটা স্যান্ডউইচ কিনে খেয়েছে। একেবারেই ছোট্ট খাবার। তাই ক্ষুধাটা এখন চনমন করে উঠছে।

রাকিব বাসার ফ্রিজে কাল কয়েক পদ রান্না করে ছোট ছোট প্লাস্টিক কন্টেইনারে ভরে রেখেছে। এ কাজটা রাকিব প্রায় প্রতি রোববারের বিকেলেই করে থাকে। আতিক থাকলে অন্য কথা। সে এখনো বাংলাদেশে। তার নাকি নতুন বউ ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছে না।

গতরাতেই রাকিবের সঙ্গে আতিকের কথা হয়েছে। ফোনের ওপাশে আতিকের সে কী উচ্ছ্বাস! বলে, দোস্ত, বউ এত মজার! এত দিন কত মেয়ের সঙ্গেই তো রাত কাটিয়েছি। কিন্তু বউয়ের যে মজা সেই মজাটা কখনো পাইনি। হা হা হা! বিশ্বাস কর, মা যে এত অসুস্থ, তাঁর টানও এত বোধ করি না যতটুকু বউয়ের টান বোধ করি!

রাকিব ভাবল, বেচারা! তারপর অফিসের কাপড়চোপড় না ছেড়েই কিচেনে ঢুকল। ফ্রিজ থেকে একটা প্লাস্টিক কন্টেইনার বের করে ওখান থেকে একটা বাটিতে কয়েক চামচ বাঁধাকপির ভাজি নিল। এ ছাড়া অন্য কন্টেইনারগুলোতে মুরগির মাংস, ফিজি ক্যাসবার ডাল রান্না করে রাখা আছে। কিন্তু রাকিব সেগুলো বের করল না। রাকিব আপাতত হালকা ধরনের খাবার খেতে চায়। দুই-তিন স্লাইস ব্রেড দিয়ে বাঁধাকপি ভাজি।

রাকিব ফ্রিজটা বন্ধ করে বাঁধাকপি ভাজির বাটিটা মাইক্রোওয়েভে দিল। এক মিনিট সময় দিয়ে মাইক্রোওয়েভটা অন করল। মাইক্রোওয়েভের ছোট্ট এলসিডি স্ক্রিনে সময়টা এক সেকেন্ড করে কমছে।

রাকিব পুরো এক মিনিট মাইক্রোওয়েভের একেকটা সেকেন্ড কমে যাওয়া দেখল। কিন্তু বাঁধাকপি ভাজির বাটিটা বের করার আগেই তার মোবাইলটা বেজে উঠল। মোবাইলটা লাউঞ্জের টি-টেবিলের ওপর রাখা।

বাঁধাকপির ভাজির বাটিটা মাইক্রোওয়েভ থেকে বের না করে রাকিব মোবাইলটাই আগে ধরতে গেল। মোবাইলের স্ক্রিনে দেখল এমেন্ডার নাম। কিছুক্ষণ আগেই সে এমেন্ডার নতুন নম্বরটা তার মোবাইলে সেভ করেছে।

ওপাশ থেকে এমেন্ডার মিহি গলা ভেসে এল। বলল, হ্যালো, সরি, আমি আমার মোবাইলে তোমার নম্বর থেকে দুইটা মিস কল পেয়েছি।

রাকিব বলল, হ্যাঁ, আমি ফোন করেছিলাম।

: আমি কি জানতে পারি তুমি কে? আমাকে কেন ফোন দিয়েছ?

: হ্যাঁ, আমি রাকিব।

এমেন্ডা এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। তারপর আস্তে করে বলল, অনেক দিন পর তোমার সঙ্গে কথা বলছি তো, তাই গলাটা হঠাৎ করে চিনতে পারিনি। সরি। আমি এমেন্ডা।

রাকিব বলল, হুম্ম। আমি তোমার চিঠি পেয়েছি। এই তো অফিস থেকে ফেরার পথে লেটার বক্স চেক করতে গিয়ে পেলাম। চিঠিতেই তোমার নতুন নম্বরটা পেয়েছি। আমি অলরেডি মোবাইলে সেভ করে নিয়েছি।

এমেন্ডা বলল, তুমি মনে হয় নতুন নম্বর নিয়েছ।

: হ্যাঁ, বছর দেড়েক আগে নিয়েছি।

: তোমার নতুন নম্বরটা তো পাঠাওনি। তাই চিঠি লিখতে বাধ্য হয়েছি। ভাগ্যিস তোমার বাসার ঠিকানাটা আমার ফাইলে ছিল। তাও আমি নিশ্চিত ছিলাম না। অনিশ্চয়তার মধ্যেই চিঠিটা পাঠিয়েছি।

: আমার বাসা বদল হয়নি।

: তা তো বুঝতে পারছি। নয়তো চিঠিটা পেলে কীভাবে?

রাকিব ফোনের এপাশে মৃদু হাসল। বলল, তোমার মোবাইল নম্বরও তো বদল হয়েছে।

এমেন্ডা বলল, হ্যাঁ। কোনো একটা কারণে বদল করেছি। ওটা তোমাকে বলা যাবে না।

: ভালো, বেশ ভালো।

: নতুন ফোন নম্বরটা দিলেই কি তুমি আমাকে কখনো ফোন দিতে?

রাকিব কিছু বলল না। চুপ হয়ে গেল।

ওপাশে এমেন্ডাও কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল।

রাকিব দাঁড়ানো ছেড়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসে বলল, শোনো, সাদিয়ার ডেথ সার্টিফিকেট, সামান্য কাগজপত্র আর একটা ফটো অ্যালবামের জন্য আমি আর এত দূর এসে লাভ কী? তুমি বরং পোস্ট করে দাও। আজ থেকে আমার অফিস শুরু হয়েছে। ছুটি পাব না।

এমেন্ডা বলল, উইকএন্ডে আস। শনিবারে এসে রোববারে চলে যাও?

: শুধু শুধু এত দূর কেন আসব?

: শুধু শুধু কেন হবে?

: ওগুলো তো তুমি পোস্ট করে দিলেই পার, তাই না?

: হ্যাঁ, পারি। কিন্তু তোমার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে। মেলবোর্নে পারমান্যান্টলি চলে যাচ্ছি। আবার কবে দেখা হবে...।

: জরুরি কথাগুলো ফোনে বললেই পার।

: না, ফোনে বলা যাবে না। তুমি আস না একবার প্লিজ। আমার বাসায় আসতে হবে না। অফিসে আস। অফিসের অনেক কাগজপত্র গোছাচ্ছি বলে আগামী দুই সপ্তাহ শনি-রোববারেও আমি অফিস থাকব। আমার বস বা অন্য কেউ অবশ্য থাকবে না। তুমি একবার শনিবার বা রোববারে আস। প্লিজ, প্লিজ!

রাকিব এবার না করতে পারল না। বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তোমাকে কালই জানাচ্ছি কবে আসব।

এমেন্ডা বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।

রাকিব বেশ কিছুক্ষণ ধরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে ঘড়িতে প্রায় সাতটা বাজলেও বিকেলটাকে এখনো মধ্য বিকেলেই বলা যায়। গ্রীষ্মের বিকেল। ডে-লাইট সেভিংসের কারণে এখন সন্ধ্যা হয় প্রায় সাড়ে নয়টায়। আজ তার আর জুরাসিক ওয়ার্ল্ড-টু দেখা হয়নি। এমনকি সে যে ব্রেড দিয়ে খাবে বলে একটা বাটিতে বাঁধাকপি ভাজি মাইক্রোওয়েভে দিয়েছিল, ওটাও বের করেনি।

তার যে ক্ষুধাটা নেই, তা নয়। ক্ষুধায় তার পেট গড়গড় করছে। কিন্তু এখন তার এসব ব্রেড-বাঁধাকপি ভাজির মতো ছাইপাশ খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কাছেই কুক স্ট্রিটে কুক বার অ্যান্ড গ্রিল। ওখানে গিয়ে রেড ওয়াইনের সঙ্গে গ্রিল চিকেন বা বিফ স্টেইক দিয়ে খাবার খেয়ে আসতে পারে। একটু হেঁটেও আসা হবে। কিন্তু তার ব্যালকনি ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। একধরনের স্থবিরতা তার ভেতরে ও বাইরে।

বাইরের আবহাওয়াটা অবশ্য বেশ চমৎকার। দক্ষিণের হিন হিন বাতাস বইছে মাথার চুলে হালকা বিলি কেটে। তার এখনো অফিসের কাপড়চোপড়গুলো ছাড়া হয়নি। রাকিব ব্যালকনির রেলিংয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বিকেলের রোদের ওঠানামা দেখছে। আকাশটা ঠিক পরিষ্কার নীল নয়। এদিকওদিক ছেঁড়া মেঘের আনাগোনা আছে। তবে পাতলা ছেঁড়া মেঘ। ছেঁড়া মেঘগুলো কখনো সূর্যের মুখ ঢাকছে। কখনো সূর্যের মুখ থেকে সরে যাচ্ছে।

রাকিব আকাশ দেখছে। সারি সারি ম্যাপল গাছের সবুজ পাতা দেখছে। ফাঁকে ফাঁকে ওক গাছের জলছাপ দেওয়া সবুজ পাতা। ক্যাবেজ গাছের চিরল পাতার ফাঁকে দুধ সাদা ফুল ফুটতে শুরু করেছে। এলোমেলো রাবার গাছগুলো সাদা পিঠ দেখিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিকেলের হেলে পড়া সোনালি হলুদ রোদ। রোদের মধ্যে গাছের দিঘল ছায়া। গাছপাতা আর রোদের ঝিকিমিকি আলো। রাকিব এর সবই দেখছে, কিন্তু তার দৃষ্টির ভেতর অন্য আরেকটা দৃষ্টি ওঠানামা করছে। পাঁচ বছর, সাত বছর কিংবা দশ বছর আগের স্মৃতি।

রাকিব তখন নিউজিল্যান্ডে একেবারেই নতুন। নিউজিল্যান্ডে এসেছিল ভিজিট ভিসায়, দালালের মাধ্যমে। তার বড় চাচার এক কলিগ কীভাবে যেন ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

রাকিব অকল্যান্ডে পৌঁছে দালালেরই এক পরিচিত ভদ্রলোকের বাসায় ওঠে। ভদ্রলোকের নাম ছিল আবদুল রফিক। এখানকার বাঙালি মানুষজন তাকে বলত জ্ঞানী রফিক। জ্ঞানী রফিকের কথাবার্তা এত জ্ঞানী ধরনের ছিল যে, মাঝে মধ্যে তার মনে হতো ভদ্রলোকের যে নাম আবদুল রফিক, সেই নামটাও হয়তো ভুয়া। কথাবার্তায় কখনো তিনি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যেতেন। কখনো আর্মি অফিসার। কখনো পুলিশ সার্জেন্ট। কখনো কখনো তিনি ডাক্তারিও ফলাতেন।

আবদুল রফিকের বাসায় থাকাকালে রাকিব ভাগ্যক্রমে অন্য আরেক বাঙালির মাধ্যমে মতি ভাইয়ের ফোন নম্বরটা পায়। রাকিব সেদিনই তাকে ফোন দেয়।

মতি ভাই ফোন পাওয়ার পরদিনই রাকিবকে তার গাড়িতে করে এক ইমিগ্রেশন ল ইয়ারের কাছে নিয়ে যান। মার্শাল বার্ড ল ফার্ম।

মার্শাল বার্ড ল ফার্ম থেকেই রাকিব নিউজিল্যান্ড ইমিগ্রেশনে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে একটা কেস দাখিল করে এবং এর সঙ্গে নিউজিল্যান্ডে কাজ করার জন্য ওয়ার্ক পারমিটেরও আবেদন করে। এর দুই সপ্তাহ পর রাকিব ইমিগ্রেশন থেকে একটা অস্থায়ী ওয়ার্ক পারমিট পেয়ে যায়। অস্থায়ী ওয়ার্ক পারমিট হাতে পেয়েই রাকিব মতি ভাইয়ের পরামর্শে সোজা হকস বে অঞ্চলের হেস্টিংস শহরে চলে যায়। ওখানে গিয়ে হাসানুজ্জামান হাসান নামে এক ভদ্রলোকের বাসায় ওঠে।

হাসানুজ্জামান হাসান ছিলেন মতি ভাইয়ের বন্ধু। তার পরিচয়েই রাকিব তার বাসায় ওঠে।

হাসানুজ্জামান হাসানের স্ত্রী ছিলেন এ দেশি সাদা চামড়ার ইউরোপিয়ান। নিউজিল্যান্ডের যাদের পাকিহা বলে। তাদের দুটো মেয়ে ছিল। বড় মেয়ের নাম পুতুল। ছোট মেয়েটার নাম কোহিনূর। দুজনই বেশ ফুটফুটে সুন্দর ছিল।

হাসানুজ্জামান হাসানের বাসাতেই এমেন্ডার সঙ্গে রাকিবের প্রথম পরিচয় হয়। এমেন্ডা ছিল হাসানুজ্জামান হাসানের স্ত্রী রিনেই ভাবির চাচাতো বোন। ওদের মধ্যে বেশ আসা-যাওয়া ও ওঠা-বসা ছিল।

রাকিব হেস্টিংস শহরে গিয়ে প্রথমে আপেল অরচার্ডে কাজ শুরু করে। কাজটা একটু কঠিন হলেও বেশ আনন্দ পেত। কাজটাতে বেশ কায়িক পরিশ্রম আছে। কিন্তু জীবনের কাছ থেকে একধরনের ভিন্ন অভিজ্ঞতা পাচ্ছিল।

তবে রাকিবকে অরচার্ডে কাজটা বেশি দিন করতে হয়নি। একটা নতুন দেশে এলে ভাষাগত যে সমস্যা হয়, সেই সমস্যায় তাকে তেমন একটা পড়তে হয়নি। স্কুল-কলেজে রাকিব বরাবরই ইংরেজিতে ভালো ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালেও বেশ ইংরেজি চর্চা করত। প্রায়ই ব্রিটিশ কাউন্সিলে যেত। ইংরেজি পত্রিকাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ত। নীলক্ষেত থেকে পুরোনো টাইম ম্যাগাজিনগুলো বাসায় কিনে নিয়ে আসত।

হেস্টিংস শহরে আসার মাস দেড়েক পর রাকিবের কাউন্ট ডাউন সুপার মার্কেটে ক্রো হিসেবে একটা চাকরি হয়ে যায়।

এমেন্ডাও সেই কাউন্ট ডাউন সুপার মার্কেটে চাকরি করত। তবে তার কাজ ছিল চেক আউটে।

বাসায় রিনেই ভাবির চাচাতো বোন হিসেবে এমেন্ডার সঙ্গে রাকিবের প্রথম দিন থেকেই পরিচয় ছিল। তার ওপর একই জায়গায় কাজ। মাঝেমধ্যে একই সময় আসা-যাওয়া। আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক এক সময় ভালোবাসায় গড়ায়। একদিন হাসানুজ্জামান হাসান ও রিনেই ভাবির উদ্যোগে একটা ছোটখাটো পার্টির আয়োজন করে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর ওরা সেন্ট অবেন স্ট্রিটের একটা দুই বেডরুমের বাসা ভাড়া নেয়।

নতুন বাসায় ওঠার আগেই রাকিব লাল রঙের একটা স্টারলেট টয়োটা গাড়ি কেনে। সেই গাড়িটা সে বিয়ের পর এমেন্ডাকে দিয়ে দেয়। এমেন্ডার পুরোনো স্টেশন ওয়াগন গাড়িটা সে নিয়ে নেয়। ওদের প্রতিদিনের ছোট ছোট সুখ, প্রতিদিনের ছোট ছোট অনুভূতি। প্রায়ই ওরা কাজের শেষে বিকেলে সমুদ্রের পাড়ে চলে যেত। কখনো ব্লাফ হিলের চূড়ায় বসে প্রশান্ত মহাসাগরের জলে সূর্যাস্ত দেখত।

একটা রক্তিম সূর্য। টুপ করে জলে ডুবে যাচ্ছে। সমুদ্রের অশান্ত ঢেউ। দক্ষিণের হিন হিন বাতাস। এই অনুভূতির চেয়ে চমৎকার অনুভূতি আর কী হতে পারে? রাকিবের কাছে তখন জীবনটাকে মনে হতো, প্রতিদিনের একটা সুখ স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙার মতোই। ওদের বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় এমেন্ডা প্রেগন্যান্ট হয়। তারপর ফুটফুটে একটা মেয়ে।

মেয়েটা একদম রাকিবের গায়ের রং পায়। শ্যামলা। দিঘল আঁখি।

রাকিব মেয়ের নাম রাখে, সাদিয়া। সে তার ছোট চাচির নামের সঙ্গে মিলিয়ে নামটা রাখে।

কিন্তু সাদিয়ার বয়স যখন দেড় বছর, ঠিক তখনই রাকিবের জীবনে একটা বিরাট ঝড় আসে। এমেন্ডা তত দিনে কাউন্ট ডাউন সুপার মার্কেটের চাকরি ছেড়ে দিয়ে একটা ল ফার্মে রিসেপশনিস্ট হিসেবে চাকরি নেয়।

এমেন্ডার ল ফার্মের চাকরি নেওয়াটা হয়তো কোনো সমস্যা ছিল না। সে একটু দূরে সরে গিয়েছিল। কিন্তু সিরাজের উপস্থিতিতেই রাকিবের জীবনে যত ঝড় নেমে আসে। সিরাজ ছিল রাকিবেরই বন্ধু।

রাকিব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবল, সেই সিরাজ। একজন নরম চেহারার ও নরম হাসির মানুষ সিরাজ!

সিরাজের সঙ্গে রাকিবের পরিচয় হয়েছিল হাসানুজ্জামান হাসানের বাসায়। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব।

সিরাজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। রাকিবের সমবয়সী। তবে সে ছিল বিজ্ঞানের ছাত্র। মৃত্তিকা বিজ্ঞানে পড়ত। কিন্তু কলাভবনে তার বেশ আসা-যাওয়া ছিল। রাকিবের ক্লাসের কয়েকজন বন্ধু তার বন্ধু ছিল।

বন্ধুত্বের সূত্রেই রাকিবের বাসায় সিরাজের আসা-যাওয়া ছিল। মাঝেমধ্যে সে বিনা নোটিশেই রাতের খাবার খেতে চলে আসত। ব্যাচেলর হয়েও সে বেশ কয়েকবার রাকিব ও এমেন্ডাকে বাসায় বা রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাইয়েছে। আর সে সাদিয়াকে এমন ভালোবাসা দেখাত যে, মনে হতো সাদিয়া যেন রাকিব-এমেন্ডার মেয়ে নয়। তার মেয়ে।

একদিন রাকিব ঘরে ফিরে দেখে, এমেন্ডা আর তার ঘরে নেই। সাদিয়াও এমেন্ডার সঙ্গে সিরাজের ঘরে। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন