কে যেন ডাকে আমায় - আয় ফিরে আয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রিকশার হুড ফেলে ঝিরিঝিরি বাতাসে আনমনে গাইছি—‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান...।’ মফস্বলের একটু আধটু ভাঙা রাস্তা, কাঠের সেতুর নিচে বয়ে যাওয়া মৃদু স্রোতস্বিনী টলটলে জলভরা এক আঁজলা ঢেউ। ওই দূর পাহাড়ের কিনারে বাউলিয়া মেঠো সুর। সবুজ ধানের শিষে বয়ে যাওয়া কিশোরীর এক পা দুই পা নাচের মুদ্রা। আর আমি তো সেই কবে থেকেই সবুজ গ্রামীণ চেক শাড়িতে হলুদ ফুলের লাবণ্যে খেতের আইল বেয়ে মাটির সানকিতে তুলেছি কড়কড়ে ভাত; মরিচ ভর্তা আর পাটশাক! আঁচল দিয়ে মুছে দিয়েছি সারা দিনের ঘাম। সামান্য চিলেকোঠা ভরে গেছে সোনার ধান আর মিঠেল হাসিতে। পোড়া রোদে নাক ছবি এখন নয়া সোহাগ জাগায়। দখিন ভিটায় ঘর ওঠে। ধান ঘর আর পেছন বাড়ির বিছরায় পিঠালি ঘ্রাণ—মৌ মৌ নতুন ফসলের ডাক! চার চুলায় ধোঁয়া ওঠা ভাঁপার ঘ্রাণ।

নতুন ক্লাস শুরু হওয়ার আরও কয়েকটা দিন বাকি। আমরা ভাইবোন দাদির নথপড়া কাব্য, পুথি কথন আর পৌরাণিক সিন্ধুকের গোপন রহস্য উন্মোচন করব বলেই সোনামুড়া চলে এসেছি। ভোরবেলায় পাখির ঘর খুঁজতে যাওয়ার অছিলায় একদলা শিউলি কুড়িয়ে দাদির কোচর ভরে দিতাম। দাদি জবাকুসুম তেল লম্বা এলোচুলে মেখে রাতে ঘুমাতে যেতেন। বড় পালঙ্কে আড়াআড়ি ঘুমে কিচ্ছাকাহিনিতে কেটে যেত তামসী রাত। ছড়া কাটতাম—কী কথা লেখা আছে সোনার পালঙ্কে মনের থলিতে!’ রূপকথার নানান গল্পে কখনো আনন্দে, কখনো ভয়ে শিউরে উঠতাম। টিনের চালে বেলপাতার নড়াচড়া আর ঝরাপাতার শব্দ যেন তালগাছের গা ছমছম করা ভূতের বাড়ির কথা মনে করিয়ে দিত। আত্মরক্ষার জন্য দাদির আঁচলে একে একে মুখ লুকাতাম।

ভেতর বাড়ির পাকা ঘাটলায় সোনাই দাদি কাঁচা হলুদ মেখে গোসল করতেন। গলায় মালা ছরা, কানে সাগরিকা আর হাতে ঢেউখেলানো বালা বউ বউ রং ছড়াত পুরো বাড়িময়। চাঁদবরণ কন্যাকে সবাই চাঁদবানু বলেই ডাকত। আমি খুব আদর করে ডাকতাম পদ্ম সই। পালকি থেকে নেমে জল চকিতে আল তাপরা ফরসা পা, বেনারসিতে মোড়ানো নতুন বউকে দেখার জন্য পাড়া–পড়শির ধুম লেগেছিল আমাদের বাড়িতে।

গেল বার পদ্মপুকুরের পাড় ঘেঁষে স্কুল ঘরের কিনারা দিয়ে হেঁটে যেতেই সালমা ফুফু দূরের ওই শিউলি গাছটা দেখিয়ে বললেন—‘ওইখানেই তোর দাদি ঘুমিয়ে আছে।’ ঘাসফুল ছেয়ে আছে পুরো জমিনজুড়ে। একটা দুটা শিউলি বোঁটা আর বুকজুড়ে হাহাকার, হুহু কান্না...! বিড়বিড় করে ডাকছি পদ্ম সই-ই ও ও...পদ্ম সই, বুবুউউউউউ! কান্না সামলাতে সালমা ফুফু আমাকে বুকে টেনে নিলেন।

সেই সোনামুখী চাঁদবানু, খেলাচ্ছলে সেজে ওঠা এ বাড়ি ওবাড়ি দৌড়ানো পুতুল বউ আর নেই আর নেই! উঠোনের কোণে চৌকিটা পড়ে আছে। ঝরাপাতার দলও নীরব! শেওলা পড়া পাকা ঘাট, কাচারি ঘর আর সোনার পালঙ্ক সাক্ষ্য দেয় পৌরাণিক ইতিহাসের! এ বাড়িতে ছিল এক লাল বউ, পদ্ম সই আর চাঁদবানু। বড় আদরের। অভিমান ভাঙাতে দাদাজী গঞ্জ থেকে লাল পিরান, পুতির মালা, নাড়ু মুড়ালি কত কী-ই নিয়েই না বাড়ি ফিরতেন। যখন খুশি পালের নাওয়ে হান্দেশ, বাতাসা আর মিঠাই নিয়ে বাপের বাড়ি নাইওরি হতেন। বাড়ির সামনে, খোলামাঠে জেফত হতো মাঝে মাঝেই শুধু চাঁদবানুর আহলাদিপনাতেই।

অতঃপর ঐতিহাসিক সিন্দুকে ঠাঁই হয় প্রাচীন নকশা করা মালতী হার, পুতি দিয়ে গড়া নাক ছবি অন্য বউ অথবা অন্য কারও জন্য।

মাঝরাতে বুক পাঁজরে ধুকপুকানি। জ্যোৎস্না নামে জানালা জুড়ে। আমি আদর ভেবে মুঠোভর্তি করি। চুমু খাই তারপর হঠাৎ আঁধারে মিলিয়ে যেতে থাকা রোশনি টুকুতে দাদির ঘ্রাণ খুঁজি। বড় আদিম ঘ্রাণ, কলিজা জুড়ায়! গহিন রাতে বাঁশঝাড়ের ওপর ঠিকরে পড়ে সোনালি আলো। ঝিঁঝি ডাক, বুনোফুল—ঝোপঝাড় সংগত করে একাকিত্বের! আমি ফিরে যেতে থাকি আপন আলয়ে। বাউল বাড়ির কাছাকাছি যেতেই কানে ভেসে আসে—

‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়...।’

আরেকটু সামনে এগোতেই ওই দূর সবুজ মাঠে হঠাৎ দেখি উড়ান পাখির উৎসব। নতুন পানিতে জিয়ল মাছের কানাকানি। ভেসে যাচ্ছে কিছু দলছুট সাদা হাঁস। কমলা ফুল, জট লাগা লতাগুল্ম আর গত রাতের কুয়াশায় মুষড়ে পড়া কয়েকটা ম্যাপল সদ্য ছুঁয়েছে ভোরের নরম সূর্য। শিশুরা মেতেছে গল্পের আসরে।

নাকছবি জুড়ে ঝুলন্ত পুতিগুলো বন্দনা করছে নয়া-উৎসবের!

বহুদূর থেকে কে যেন ডাকে আমায়—আয় ফিরে আয়!
...

মুক্তা মাহমুদা: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।