দিঘল মেঘের দেশে-ছয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাকিব ভেবেছিল, সে ছয়টা-সাড়ে ছয়টার আগেই রওনা হবে। কিন্তু তার বাসা থেকে বের হতে হতে প্রায় আটটা বেজে গেল। হিলক্রেস্টের পেট্রল পাম্প থেকে পেট্রল ও পাশের ক্যাফেটেরিয়া থেকে একটা হোয়াইট কফি নিয়ে হ্যামিল্টন ছাড়তে ছাড়তে প্রায় সাড়ে আটটা বাজল।

আজ সকালের রোদটা খুব সুন্দর উঠেছে। চারদিকে স্নিগ্ধ সবুজের মধ্যে হলদে আভার রোদটা অদ্ভুত সুন্দর অবয়ব নিয়ে বিছিয়ে রয়েছে। আকাশের অসীম নীলের মধ্যে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলো অনেক দূরে দূরে। পাহাড়ের ঢালে রোদ ও ছায়ার খেলা। সবুজ উপত্যকায় সাদা-ধূসর ভেড়াগুলোকে দেখা যাচ্ছে দুধ-সাদা ফুলের মতো। যেন সবুজের ওপর দুধ-সাদা ফুল ফুটে আছে।

শনিবারের সকাল বলে স্টেট হাইওয়ে ওয়ানে গাড়ির আসা-যাওয়া কম। রাকিব এক রাত হেস্টিংস শহরে থাকবে বলেই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। রাতে সে রিনেই ভাবির বাসায় থাকবে। রিনেই ভাবির সঙ্গে রাকিব ফোনে কথা বলেছে। তার ইচ্ছে ছিল, কোনো মোটেলে রাতটা কাটিয়ে দেবে। এক রাতেরই তো ব্যাপার। কিন্তু রিনেই ভাবি এমন অধিকারের গলায় বললেন। রাকিব না করতে পারেনি।

এমেন্ডার সঙ্গে রাকিবের কাল সকাল সাড়ে দশটা-এগারোটার দিকে দেখা হবে। রাতটা কাটাতে হবে বলে রাকিব ছোট্ট একটা লাগেজ গুছিয়ে গাড়ির পেছনে রেখেছে। মোবাইলে তো ছবি তুলতেই পারবে। তারপরও রাকিব তার ডিজিটাল ক্যামেরাটা সঙ্গে করে এনেছে। বেশ অনেক দিন পর রাকিব হেস্টিংস যাচ্ছে। সেই কবে, প্রায় আড়াই বছর আগে একবার গিয়েছিল। সেটাকে অবশ্য যাওয়া বলে না। সেবার দুপুরের মধ্যে সে হেস্টিংস শহরে গিয়ে এক ঘণ্টা থেকে এমেন্ডা ও সে এক জজের সামনে বসে ডিভোর্সের কাগজে সাইন করেছিল। কিন্তু প্রায় চার বছর আগে রাকিব হেস্টিংস গিয়ে শহরে গিয়ে দুই রাত কাটিয়েছিল। তখন অবশ্য রাকিব রিনেই ভাবির বাসায় থাকেনি। মোটেলে ছিল। তার সেই যাওয়াটা ছিল একটা করুণ অধ্যায়ের যবনিকা দেখতে। তার আড়াই বছরের মেয়েটা ক্যানসারে মারা গিয়েছিল। সাদিয়াকে হেস্টিংসের কারামু রোডের সিমেট্রিতে দাফন করার জন্যই শেষবারের মতো গিয়েছিল।

আজ এত দিন পর আবার যাচ্ছে। আজ কেন যাচ্ছে রাকিব নিজেও জানে না। এমেন্ডা অনুরোধ করেছে বলেই? কী জানি? সে কেন এমেন্ডার অনুরোধ রাখতে গেল?

হ্যামিল্টন থেকে হেস্টিংসের দূরত্ব প্রায় সাড়ে তিন শ কিলোমিটার। নিজে গাড়ি চালিয়ে গেলে পাঁচ ঘণ্টা লাগে। বাসে বা ট্রেনে আরও বেশি সময় লাগে। মাঝখানে বেশ কতগুলো ছোট শহর ও দুটো প্রধান শহর পড়ে। প্রথম যে বড় শহরটা পড়ে ওটার নাম তাওপো। দ্বিতীয় বড় শহরটার নাম নেপিয়ার। নেপিয়ার শহরটা হেস্টিংস শহরের কাছাকাছি অবস্থান। মাত্র বাইশ কিলোমিটারের ব্যবধান। ছোট ছোট শহরগুলোর মধ্যে প্রসিদ্ধ কেমব্রিজ, টিরাও ও টকোরোয়াসহ আরও দুই-তিনটা শহর।

যদিও হ্যামিল্টন থেকে তাওপো শহরে পৌঁছতে পৌঁছতে দুই ঘণ্টার মতো লেগে যাবে। তবুও রাকিব ভাবল, নাশতাটা সে তাওপো শহরে গিয়ে খাবে। কোনো ফাস্ট ফুডের দোকান থেকে ফাস্ট ফুড কিনে তাওপো লেকের পাড়ে বসে খাওয়ার আনন্দটাই আলাদা। এখন সে গাড়ি চালাতে চালাতে খালি পেটে কফি খাচ্ছে।

কফি খেতে খেতে রাকিব ভাবল, খালি পেটে কফি খেতে মজাই আলাদা। কফির পুরো নেশাটা পাওয়া যায়। মাঝেমধ্যেই রাকিব খালি পেটে কফি খেয়ে অফিসে যায়। সাড়ে দশটার সময় অফিসে চায়ের বিরতিতে সে ক্যাফেতে বা অফিসের পাশের ম্যাকডোনাল্ডসে গিয়ে নাশতা করে।

গাড়িটা ঘণ্টায় এক শ কিলোমিটার বেগে যাচ্ছে। আর সামান্য গেলেই হ্যামিল্টনের নিকটতম ছোট্ট শহর কেমব্রিজ। কেমব্রিজ শহরটা ইংল্যান্ডের কোনো শহরের আদলে গড়া। পুরোনো গির্জা, পুরোনো ঘোড়দৌড় ময়দান, পুরোনো কলোনিয়াল স্টাইলের বড় বড় বাংলো বাড়ি। এ ছাড়া প্রত্যেকটা রাস্তার ছক পুরোপুরি সোজা। সেই সোজা রাস্তাগুলোর ওপর অসংখ্য বড় বড় গাছ নিস্তব্ধ ছায়া করে ঝুঁকে আছে। গাছের ছায়ারও যে একটা বিশাল সৌন্দর্য আছে, তা কেমব্রিজ শহরে এলেই বোঝা যায়।

কেমব্রিজ শহরের প্রায় সব অধিবাসীরাই ইউরোপিয়ান সাদা কৃষক। তারা খুব ঐতিহ্য নিয়ে চলেন। রাকিব প্রথমবার এই শহরটাতে এমেন্ডার সঙ্গে আসে। এমেন্ডার এক মামা এই শহরে থাকতেন। তখন রাকিবের এই ছোট্ট শহরটা ঘুরে দেখে খুব ভালো লেগেছিল। ছায়া সুনিবিড় ও শান্তির নীড় বলে যে একটা কথা আছে, তা এই শহরটায় বিদ্যমান।

কেমব্রিজ শহর পার হতে না হতেই উঁচুনিচু পাহাড় শুরু হলো। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে পথটা করা বলে রাকিবকে গাড়ি খুব আস্তে চালাতে হচ্ছে। পাহাড়ের ঢাল থেকে সমান্তরালে বয়ে যাওয়া ওয়াইকাটো নদীটা মাঝেমধ্যে দৃশ্যমান হচ্ছে। সবুজের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ নদীর রূপালি রেখা! এমনিতেই পাহাড়ি পথ বলে রাকিব ধীর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। তার ওপর ওসব অপূর্ব দৃশ্যমান দৃশ্য দেখতে গিয়ে তার গাড়ির গতি যেন আরও কমে যাচ্ছে। পাহাড়ি পথের কোথাও কোথাও বিস্তৃত উপত্যকা। উপত্যকার ঢালগুলোতে ভেড়া আর গরুর পাল। কৃষকদের বিশাল বিশাল বাংলো।

রাকিব গাড়ি চালাতে গিয়ে বহুবার দেখেছে, স্পষ্ট রোদের সঙ্গে পিচের রাস্তারও কেমন রং বদলায়। রোদ কিছুটা মিইয়ে এলেই পিচের রাস্তার কালো রং ধূসর হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত রোদে পিচের রাস্তায় মরীচিকে বলে ভ্রম হয়। নিউজিল্যান্ডে তো রোদছায়ার খেলা বড্ড বেশি। কখনো দিঘল পথের দিকে তাকালে পিচের রাস্তাটাকে মনে হয় যেন কালো রঙের দিঘল কোনো জলের স্রোত বড় বড় ঢেউ নিয়ে খেলছে।

এসব পথে গাড়ি চালাতে গেলে রাকিবের কাছে মনে হয়, সে যেন এক দিগন্তহীন পথে ছুটছে। তার সামনে কী এক অনন্তহীন যাত্রা যেন।

মাঝখানে তিনটা ছোট ছোট শহর টিরাও, পুটোরুরু ও টকোরোয়া পড়লেও সে কোথাও গাড়ি থামাল না। রাকিব সরাসরি বড় শহর তাওপোতে চলে এল। দুই ঘণ্টার পথ দেখতে দেখতেই চলে গেল।

তাওপো শহরে এসে রাকিব সরাসরি ফার্স্ট ফুডের দোকান ম্যাকডোনাল্ডসের ড্রাইভ থ্রোতে গিয়ে ঢুকল। একটা ফিলেট ও ফিশ বার্গার, একটা মিডিয়াম চিপস এবং একটা কোকো কোলা ড্রিংকসের কম্বো নিয়ে সে তাওপো লেকের পাড়ে গিয়ে গাড়ি পার্ক করল।

ততক্ষণে প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেছে। আকাশ তখনো বেশ পরিষ্কার। লেকের জলের ওপর সমস্ত আকাশের নীলটা গলে গলে পড়ছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলো অনেক দূরে দূরে। বিশাল বিস্তৃত লেকের জলে ছোট ছোট ঢেউ।

রাকিব লেকের পাড়ের একটা বেঞ্চিতে বসল। গ্রীষ্মকাল বলে এই সকালেই লেকের জলে গা ভেজাতে মানুষজন দলবল নিয়ে নেমেছে। কেউ কেউ ওয়াটার ভলিবল খেলছে। কেউ আবার ছোট্ট ছোট্ট কেনোই বা নৌকা বাইছে। অনেকে ভট ভট শব্দ তুলে ওয়াটার বাইক চালাচ্ছে। তাদের বেশির ভাগই পর্যটক। বেশ কিছু ক্রীড়াবিদও আছে। প্রতি গ্রীষ্মে এই লেককে কেন্দ্র করে অনেক খেলাধুলা হয়। তাই তাওপো শহরকে বলা ইভেন্ট ক্যাপিটাল অব নিউজিল্যান্ড।

রাকিব বার্গার চিপস খেতে খেতে লেকের জলের দিকে তাকাল। লেকের এই সবুজ জলের ভেতর তার অনেক দীর্ঘশ্বাস জমে আছে। বিভিন্ন সময় এই শহর ধরে আসা-যাওয়া পথে এমেন্ডা ও সে কতবার এই লেকের পাড়ের বেঞ্চিতে বসে সকালের নাশতা বা দুপুরের খাবার খেয়েছে!

লেকটা প্রায় দিগন্ত বিস্তৃত বড়। প্রায় ছয় শ ষোলো বর্গ কিলোমিটার। লেকের গভীরতাও অনেক। এক শ নব্বই মিটার গভীর। ভূতত্ত্ববিদদের মতে এক শ পঁচাশি খ্রিষ্টাব্দে এক বিশাল আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণে লেকটার সৃষ্টি হয়।

যদিও আজকাল কোনো কোনো ভূতত্ত্ববিদ দ্বিমত পোষণ করেন। তাদের ধারণা, যিশুখ্রিষ্টের জন্মের বহু পূর্বে লেকটার সৃষ্টি। তবে লেকটা যে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণে ভূগর্ভের ম্যাগনাম চেম্বার খালি হয়ে ভূমির সমতল ভেঙে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

তাওপো লেক সম্বন্ধে মাউরি মিথ অবশ্য অন্য। মাউরিদের নাটাইরাঙ্গি ট্রাইবের উপ ট্রাইব টোউফারি টোয়ার লোকজন বিশ্বাস করে, তাদের দেবতা নাটাইরাঙ্গি জলের অভাব দূর করার জন্য টাউফিরি পর্বতে দাঁড়িয়ে আকাশ সমান বিশাল একটা গাছকে মূলসহ তুলে ফেলেছিলেন বলে সেই গর্তের স্থানে বৃষ্টির দেবতা পানি জমিয়ে লেকটার সৃষ্টি করেন।

রাকিব জানে, মাউরি মিথগুলো নিয়ে যুক্তি টানলে হয়তো সবাই বলবে, এগুলো সব গাঁজাখুরি গল্প। কিন্তু আজকাল অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বড় বড় সাহিত্যিক ও অধ্যাপকেরা এগুলো নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। তারা মাউরি মিথের নতুন নতুন দিক আবিষ্কার করছেন। এ ছাড়া এগুলো আদিবাসী মাউরিদের ধর্মীয় বিশ্বাস। ধর্মের অনেক বিষয় যেমন যুক্তি দিয়ে বিচার করা যায় না, শুধুমাত্র বিশ্বাস করা যায়। এগুলো মাউরি আদিবাসীদের জন্য সেরকমই।

গ্রীষ্মকালে নিউজিল্যান্ডে সূর্যের উজ্জ্বলতায় সকালটা খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। দুপুরের সন্ধিক্ষণের সময় আসতেই মনে হয় যেন পুরোপুরি দুপুর হয়ে গেছে। যদিও দুপুর হতে এখনো অনেকটা সময় বাকি। কিন্তু চারদিকের লেকের জলে এত স্পষ্ট রোদ যে দুপুরের সোনা গলা রোদটা যেন এখন পড়ছে।

রাকিব ঘড়ি দেখল। সবে এগারোটা বাজে। সে বার্গার-চিপস শেষ করে ড্রিংকসের কাপে একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছে। পেছনের রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে সাঁই সাঁই। লেকের জলে যারা ওয়াটার ভলিবল খেলছে, তাদের চিৎকার-চ্যাঁচামেচি আসছে। মাঝেমধ্যে ওয়াটার বাইকের ভট ভট শব্দ।

রাকিব ড্রিংকসের কাপে আরেকবার চুমুক দিয়ে দিঘল দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। তাওপো শহরে এই বৃহৎ লেকটার পাশাপাশি আরেকটা আকর্ষণীয় দিক হলো, লেকের ওপারে দূরের তিনটা বরফ আচ্ছাদিত পর্বত। এই পর্বত তিনটার নাম মাউন্ট টঙ্গারিরো, মাউন্ট রোয়াপিহো ও মাউন্ট টাউফিরি। এই পর্বত তিনটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেই স্থানটার নাম ফাকাপাপা।

শীতকালে নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণ দ্বীপে বরাবরই প্রচুর পরিমাণ তুষার পড়ে। অনেক তুষারপাত হয়। তুষারপাতের কারণে অনেক শহরের বেশির ভাগ স্কুল-কলেজ পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু উত্তর দ্বীপে শীতকালে ফাকাপাপা বাদে আর কোথাও তেমন তুষার পড়ে না।

শীত ঋতুতে ফাকাপাপার সেই পর্বত তিনটা বরফে আচ্ছাদিত হয়ে যায় বলে দূর থেকে উজ্জ্বল দিনে সূর্যের আলোর যে প্রতিবিম্ব এই তাওপো শহরে এসে পড়ে, তাতে একটা অকল্পনীয় দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। যেন বিশাল এক আয়নার আলোর চকমকি এই শহরে এসে পড়ে। রাকিব বহুবার শীতকালে লেকের এ স্থানটায় বসে সেই আলোর প্রতিবিম্ব দেখেছে। পাশে বেশির ভাগ সময়ই এমেন্ডা থাকত।

রাকিব গ্রীষ্মকালে আলোর প্রতিবিম্বের এ দৃশ্য যে দেখেনি, তা নয়। তবে গ্রীষ্মকালে শুধুমাত্র পর্বত তিনটার মাথায় বরফ জমে থাকে বলে সূর্যের আলোর প্রতিবিম্ব কম হয়। তারপরও সেই প্রতিবিম্বে পর্যটকদের চোখে সৌন্দর্যের কোনো হানি হয় না।

এখন গ্রীষ্মকাল বলে পর্বত তিনটার মাথায় বরফ জমে আছে। দিনটাও বেশ সোনালি হলুদ রোদের দিন। দূর নীল আকাশের নিচে বরফ মাথায় নিয়ে যেন পর্বত তিনটা দাঁড়িয়ে আছে। আলোর প্রতিবিম্ব হচ্ছে চকমকি আয়নার মতো। রাকিব দৃশ্যটা অনুভব করছে। পাশাপাশি এও অনুভব করছে, সে এখন একা বসে দৃশ্যটা দেখছে। রাকিব মনে মনে এমেন্ডাকে ছাপিয়ে নদীকে অনুভব করল। কিন্তু অনুভব করা মাত্রই তার ভেতর থেকে তৎক্ষণাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল।

লেকটার পুরো নাম লেক তাওপো ওটি টোয়া। আদিবাসী মাউরিদের নাম। বেশ কয়েকটা ছোট নদী ও প্রায় ত্রিশটার মতো ঝরনা এই লেকটায় এসে পড়েছে। কিন্তু একটা মাত্র নদী এই লেক থেকে বের হয়ে গেছে। সেই নদীটার নাম ওয়াইকাটো নদী। লেক তাওপো থেকে ওয়াইকাটো নদী বের হয়ে দিঘল পথ পাড়ি দিয়ে অকল্যান্ডের কাছাকাছি ওয়াইকাটো পোর্টে গিয়ে পড়েছে। নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে দীর্ঘতম নদী এটা।

রাকিব ভাবল, এই ওয়াইকাটো নদীর সঙ্গে তার কত সুখদুঃখ গাঁথা। সেই জেলিকো ড্রাইভ ও প্লাংকেট টেরেসের কোণায় হায়াস প্যাডক। পাঁচটা ওক গাছ। খানিকটা দূরেই কিছু পাইন গাছ। পাইন গাছের ফাঁকে ফাঁকে তিনটা ক্যাবেজ গাছ। একটা ডক জলের অনেকটা অব্ধি নেমে গেছে।

সেই ডক, সেই ওক গাছের নিচে গত সাড়ে পাঁচ বছরের কত স্মৃতি! তার একাকিত্বের স্মৃতি। গত তিন-চার মাসে নদীর সঙ্গে কিছু স্মৃতি।

যদিও অবয়বে কোনো মিল নেই, তারপরও রাকিব তার বাল্যকালের গোমতী নদীর সঙ্গে ওয়াইকাটো নদীর বেশ মিল খুঁজে পায়। সেই ছোটবেলায় গোমতী নদীর সঙ্গে যেমন নিজে নিজে কথা বলত, নিজের অভিযোগগুলো জানাত। গত সাড়ে পাঁচ বছরে ঠিক তেমনই ওয়াইকাটো নদীর সঙ্গে সে নিজে নিজে সুখদুঃখের আলাপ করে আসছে। তার যত অভিযোগ, সে ওয়াইকাটো নদীর কাছে করছে।

তাওপো শহরে রাকিব এতক্ষণ কাটাবে সে ভাবেনি। লেকের পাড়ের বেঞ্চি থেকে উঠে এসে কফি খাওয়ার জন্য একটা ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকেছিল। ইচ্ছে করলে সে ক্যাফেটেরিয়া না ঢুকে বিপি কানেক্ট বা শ্যাল সার্ভিস স্টেশন থেকে কফি নিতে পারত। কিন্তু সে তা না করে ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকে একটা ঘণ্টা কাটাল।

রাকিব যখন তাওপো শহর ছেড়ে নেপিয়ার-হেস্টিংস শহরের উদ্দেশে রওনা হলো তখন প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। রাকিব ভাবল, তাওপো শহরে সে এতক্ষণ দেরি না করলেও পারত। কিন্তু পরক্ষণই সে ভার মুক্তের মতো মাথা নাড়ল। আজ তো তার কোনো কাজ নেই। সে সরাসরি রিনেই ভাবির বাসায় গিয়ে উঠবে। তার যত কাজ কাল। রাকিব হেভলুক নর্থে গিয়ে এমেন্ডার সঙ্গে দেখা করবে। ওখান থেকে এসে সে কারামু রোডের সিমেট্রিতে সাদিয়ার কবরটা দেখতে যাবে। তার মাথায় আরেকটা বিষয় আছে, যদি সময় পায় তাহলে একবার আজমল হোসেনের সঙ্গে দেখা করবে। যদিও রাকিব তার ফোন নম্বর ও বাসার ঠিকানা জানে না। কিন্তু রিনেই ভাবি নিশ্চয়ই জানেন।

আজমল হোসেন রাকিবের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না। রাকিব ছিল মানবিক বিভাগের ছাত্র আর আজমল হোসেন ছিলেন বিজ্ঞান বিভাগের রসায়নের শিক্ষক। তারপরও একই কলেজের শিক্ষক বলে কথা।

তাওপো শহর ছেড়ে বের হয়ে স্টেট হাইওয়ে ফাইভ ধরতেই শুরুতে উঁচুনিচু পাহাড় আর পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথের শুরু। কিন্তু কয়েক কিলোমিটার যেতেই দিঘল বিস্তৃত সমতল পথ দুই পাশের পাইন গাছের বন নিয়ে এত সোজা গেছে যে পথের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। এই পথটার নাম ডেজার্ট রোড।

ডেজার্ট রোডে আসতেই রাকিবের পুরোনো কিছু স্মৃতির কথা মনে পড়ে গেল। রাস্তাটা দিগন্ত বিস্তৃত সোজা বলে এ পথে এলেই রাকিব ঘণ্টায় এক শ জোনে গাড়ির স্পিড এক শ সত্তর-আশি তুলে ফেলত। সেটা প্রায় নয়-দশ বছর আগের কথা। তখন তার বয়স কম ছিল। জীবনে বেশ উদ্দামতা ছিল। এমেন্ডা পাশে বসে ভয়ে তার বাম হাত খামচে ধরে রাখত।

এই ডেজার্ট রোডেই রাকিব জীবনের প্রথম পুলিশের কাছ থেকে স্পিডিং ইনফ্রিজমেন্ট ফাইন খেয়েছিল। তাও আবার সাত শ আশি ডলার। নয়-দশ বছর আগে সাত শ আশি ডলারের অনেক মূল্য ছিল। এ ছাড়া রাকিব এই পথে বেশ অনেকগুলো সাদা কাক দেখেছিল।

রাকিব আজ ডেজার্ট রোডে উঠে সাদা কাক দেখার চেষ্টা করল। রোডটা আসলে নামেই ডেজার্ট রোড। রাস্তার আশপাশে মরুভূমির কোনো অস্তিত্ব নেই। দুই পাশে সমান্তরালে এগিয়ে গেছে দিগন্ত বিস্তৃত পাইনের বন। দুই পাশে ঘন সবুজ যেন খানিকটা দূর থেকে পথের দিকে তাকিয়ে ঝুঁকে রয়েছে।

রাকিব আজ অনেকটা দূর গিয়েও কোথাও কোনো সাদা কাক দেখল না। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1557654