সম্পর্কের সৌন্দর্য

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজের প্রত্যেকটা মানুষই একে অপরের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে আত্মীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ। হতে পারে সেটা রক্তের সম্পর্ক, আবার হতে পারে সেটা সামাজিকতার সম্পর্ক। বাংলাদেশের গ্রামের মানুষদের মধ্যে এটা প্রকটভাবে দেখা যায়। একটা গ্রামের সব মানুষ প্রায় সব মানুষকে চেনেন। তাদের বিপদে আপদে এগিয়ে আসেন। যার ফলে রক্তের সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও তারা একে অপরের আত্মার আত্মীয় হয়ে যান।

গ্রামে অনেক বাড়িতে খানকা ঘর বলে একটা ঘর থাকে রাস্তার সঙ্গে লাগোয়া। বিকেলবেলা সাধারণত সেখানে বসে সবাই দিন শেষে একে অপরের খোঁজ খবর নেন। পাশের রাস্তা দিয়ে যদি কোনো অপরিচিত ব্যক্তি হেঁটে যান তাহলে অবধারিতভাবেই তাকে ডেকে তার কুশল পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। এমনকি কার বাড়ি তিনি যাচ্ছেন সেটাও জেনে নেন। পরিচয় পাওয়ার পর সেই ব্যক্তির সঙ্গে আলাপকারী ব্যক্তির একটা আত্মীয়তার সূত্র খুঁজে বের করেন অনায়াসে—‘ও আচ্ছা তুমি আমাদের অমুকের আত্মীয়। অমুক তো সম্পর্কে আমার এই হয় তাহলে তুমি আমার এই হোচ্ছ।’ ছোটবেলায় বহুদিন দেখেছি গ্রামের মানুষদের এই কর্মকাণ্ড। নিতান্তই অপরিচিত একজন মানুষ নিমেষেই কীভাবে তাদের আপনজন হয়ে ওঠেন।

নদীভাঙনের শিকার হয়ে যখন আমরা গ্রামের বাড়ি থেকে কুষ্টিয়ার শহরতলি বাড়াদিতে বসবাস করা শুরু করলাম তখন সত্যিকার অর্থেই সেখানকার কাউকেই চিনতাম না শুরুতে। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তারা একে একে সবাই আমাদের আত্মীয় হয়ে গেলেন। এখন গ্রামে গেলেই তাদের যখন খোঁজ খবর নিই তখন মনেই হয় না, আমার জন্ম অন্য কোনো গ্রামে হয়েছিল। বাড়াদিতে পাশের বাড়ির সুখজান নেছাকে আমরা ফুপু ডাকা শুরু করলাম। তার ভাইয়ের স্ত্রী ও আমার বন্ধু সালামের মা হয়ে গেলেন খালা। ডান পাশের বাড়ি আলামিন ভাইয়ের বাবা-মা হয়ে গেলেন চাচা-চাচি। সামনের বাড়ির গিয়াস উদ্দিন হয়ে গেলেন দাদা আর তার স্ত্রী হয়ে গেলেন দাদি। সকল আত্মীয়স্বজনকে জন্ম গ্রামে ফেলে এসে আমাদের একটু অসহায় হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিমেষেই নতুন গ্রামের অর্থাৎ বাড়াদির মানুষগুলোর সঙ্গে আমাদের আত্মিক সম্পর্ক হয়ে গেল।

আমি বাস্তব জীবনে মামা-খালাদের বাড়িতে গেছি খুবই কম। তাই তাদের দেখলে এখনো লজ্জা অনুভব করি। কিন্তু বাড়াদি গ্রামের মানুষদের দেখলে সেটা অনুভব করি না। গ্রামের হুজুর হয়ে গেলেন চাচা। আমরা বলি মালেক চাচা। লতিফ ভাইয়ার মা-বাবা হয়ে গেলেন ফুপু-ফুপা। তাদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে হলেও এই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ আমাদেরকে তাদের পরিবারের অংশ বানিয়ে নিয়েছিলেন। ফুপু এখনো দেশে গেলে গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করেন। তখন বারবার আপন ফুপু অর্থাৎ বাবার বোনদের কথা মনে পড়ে যায়।

এসএসসি পরীক্ষার আসন পড়েছে কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে। আমি সাইকেল চালাতে জানি না। অন্যদিকে ভ্যান ভাড়া করে যাওয়ার মতো পয়সাও নেই মায়ের কাছে। তাই মা একটু চিন্তায় ছিলেন। একদিন ফুপু (লতিফ ভাইয়ের মা) এসে বলে গেলেন আমাদের লতিফ ইয়াকুবকে সাইকেলের পেছনে চড়িয়ে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাবে। এরপর থেকে লতিফ ভাই পরীক্ষার দিন আমাকে সাইকেলের পেছনে চড়িয়ে পরীক্ষার হলে পৌঁছে দিতেন। আবার পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই এসে আগে থেকে ঠিক করা জায়গায় উপস্থিত থাকতেন। আমি জানি না, আমার নিজের বড় ভাই অথবা আপন ফুপুর আমার চেয়ে বড় ছেলে থাকলে তিনি নিজের ক্লাস ও পড়া বাদ দিয়ে এভাবে আমাকে পরীক্ষার হলে নিয়ে যেতেন কিনা? আমরা সবাই লতিফ ভাইয়ের ভাইদের নাম ধরে সম্বোধন না করে তাদের নানা বলে ডাকি। যেমন লতিফ ভাইয়ের বড় ভাই রশিদ হলেন বড় নানা, লতিফ ভাই মেজো নানা, আশাদুল ভাই সেজো নানা, নাহিদ হলেন নোয়া নানা আর জাহিদ হলেন ছোট নানা। আমার মনে পড়ে না আমি তাদের কখনো নাম ধরে ডেকেছি।

এরপর স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে একসময় ঢাকাতে ভর্তি হতে হলো। ভর্তির পর বেশ কিছুদিন বসে থাকতে হলো সেশন জ্যামের কারণে। তখন বন্ধু পাভেলের মাধ্যমে পরিচয় হলো দুলাল চাচার পরিবারের সঙ্গে। দুলাল চাচার মেয়ে রুপা ও নিপা এখন পর্যন্ত আমার আপন বোনের জায়গা নিয়ে আছে। ওরাও নিজের ভাইয়ের জন্য যতটা ভাবত, আমার জন্য তার চেয়েও বেশি ভাবে। তারা জানে আমার কী খেতে ভালো লাগে, আর কী আমি খেতে পছন্দ করি না। কোথাও গেলে অন্য সবার মতো ওরা আমার জন্যও উপহার নিয়ে আসত। বুয়েট পাস করার করার পর বাসা খোঁজা নিয়ে একটু ঝামেলা হচ্ছিল। তখন দুলাল চাচার পূর্ব রাজাবাজারে বাসায় এসে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তারপর বাসা খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত ওই বাসাতেই ছিলাম। এখনো বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের দিন ছাড়াও তাদের সঙ্গে নিয়মিত ফেসবুকে কথা হয়। রুপা ও নিপার নিজেদের ছেলেমেয়েরাই এখন বড় হয়ে গেছে। তবুও আমার জন্য ভালোবাসার জায়গাটা ওরা ঠিকই সযত্নে আগলে রেখেছে।

এত গেল দেশের কথা। বিদেশে এসেও বাংলাদেশের মানুষদের কাছে থেকে একই রকমের আচরণ পেলাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এখনো আরও আরও নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে। তাদের কাউকেই আমি আগে থেকে চিনতাম না। কিন্তু তারা সবাই এখন আমাদের তাদের পরিবারের অংশ বানিয়ে নিয়েছেন। আশফাক ভাই ও দিশা ভাবি আমাদের নিজেদের পরিবারের সদস্যদের মতোই দেখেন এবং বিপদে আপদে সবার আগে এগিয়ে আসেন।

এ ছাড়া আছেন বিজয় দাদা, রুপা বৌদি, মিথুন ভাই, নিলা ভাবি, বাপ্পী ভাই, হাসি ভাবি, সাগর ভাই, রোমানা ভাবি, ফেরদৌস ভাই, মোনা ভাবি, পুলক ভাই, ইলা ভাবি, ফয়সাল ভাই, বর্ণি আপুসহ আরও কত নাম। এই নামগুলো বলার কারণ হচ্ছে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই একেকটা আলাদা সম্পর্ক ও সম্বোধন আছে আমার। আশফাক ভাই আর ফেরদৌস ভাই হচ্ছেন বড় ভাই, মিথুন ভাই হচ্ছেন মিতা, বিজয় দাদাকে দাদা বলি, বাপ্পী ভাই আর সাগর ভাইকে সম্বোধন করি বদ্দা। কারণ তারা চট্টগ্রামের মানুষ।

পুলক ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের পর জানলাম তিনি ময়মনসিংহের মানুষ। তাই একদম শুরু থেকেই তাকে সম্বন্ধী (বউয়ের বড় ভাই) সম্বোধন করি এবং সেই মোতাবেক আবদারও করি। তারাও আমাকে নিজেদের জামাইয়ের মতোই আদর যত্ন করেন। আমার গিন্নি দেশে গেলে তারা নিয়মিত খোঁজ নিতেন ও খাবার সরবরাহ করতেন। অবশ্য অন্যরাও যে খাবার দেননি ব্যাপারটা এমন না। ফয়সাল ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের পর জানলাম তার শ্বশুর বাড়ি কুষ্টিয়াতে তাই তিনি শুরু থেকেই আমার দুলাভাই হয়ে গেছেন। বর্ণি আপুর সঙ্গে পরিচয়ের পর জানলাম তিনি আমাদের কলেজজীবনের বন্ধু পান্টুর বোন। সেখান থেকে সম্পর্কটা আরও পাকাপোক্ত হয়ে গেল।

এর বাইরে একটা পরিবার আছে, যাদের আমি বলি আমাদের সিডনির স্থানীয় অভিভাবক। তারা হলেন আমাদের বর্তমান বাসার বাড়িওয়ালা নাজমুল ভাই ও সন্ধ্যা ভাবি। তাদের সঙ্গে পরিচয় কাকতালীয়ভাবে। বাসা বদলানোর জন্য অনলাইনে বাসা খুঁজে বেড়াচ্ছেন আমার গিন্নি। একেকটা ওপেন হাউস (বাড়ি দেখাকে অস্ট্রেলিয়াতে ওপেন হাউস বলে) করে অবশেষে আমার মেয়ে তাহিয়া যে বাড়িটা পছন্দ করল সেটা স্কুল ও মার্কেট থেকে বেশ দূরে। এমনকি বাসার আশপাশে বাসস্ট্যান্ডও নেই। কিন্তু মেয়ে পছন্দ করেছে তাই অবশেষে কথা বলতে হলো। বাড়িওয়ালার সঙ্গে পরিচয়ের পর বুঝলাম আমি তাকে আগে থেকেই চিনতাম। কিন্তু সেভাবে জানাশোনা হয়নি। এরপর নতুন বাসায় ওঠার পর তাদের সঙ্গে ভালোমতো পরিচয় হলো। নাজমুল ভাই অনেক আগে অস্ট্রেলিয়া এসেছেন। চলার পথ অনেক মানুষের সঙ্গে মিশেছেন এবং সেখান থেকেই অভিজ্ঞতার ঝুলিও সমৃদ্ধ। কিছু মানুষ যেমন নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই নিজেদের অন্য জগতের বাসিন্দা ভাবা শুরু করেন, এই মানুষটা তেমন নন বরং অভিজ্ঞতাগুলো তাকে মানব জাতির প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল করেছে।

আমি তার সঙ্গে পরিচয় না হলে জানতামই না যে, নিজের বাসার ভাড়াটিয়াকেও বাইরের মানুষের সঙ্গে প্রতিবেশী বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়। তার স্ত্রী আমাদের এতটাই স্নেহ করেন যে, ভালো কোনো কিছু রান্না করলেই বাটি ভর্তি করে সেটা আমাদের বাসায় দিয়ে যান। আগে থেকে কেউ না বলে দিলে সবাই আমাদের একই একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য ভেবে বসবেন নিশ্চিত। একবার আমার গিন্নি দুর্ঘটনাবশত গাড়ি দিয়ে বাসার দেয়ালে আঘাত করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই ভাইয়া ভাবি এসে আমাদের বললেন, আমি তোমাদের বলতে এসেছি, তোমরা ঠিক আছ তো? বাসা ভেঙে গেলে ঠিক করা যাবে কিন্তু তোমাদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। সেটা শুনে গিন্নি মনে অনেক জোর পেয়েছিল এবং দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মনের মধ্যে যে শঙ্কা কাজ করছিল সেটা দূরীভূত হলো। বৃষ্টি বাদলার দিনে আমাদের স্টেশনে নিয়ে যাওয়া-আসা, জরুরি প্রয়োজনে বাচ্চাদের স্কুল ও চাইল্ড কেয়ারে দিতে যাওয়া নিয়ে আসা সবই তারা করেন। তাদের ছোট ছেলে সজীব পরিবার নিয়ে তাদের সঙ্গেই থাকেন। তাদের নাতনি আমার মেয়ে তাহিয়ার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট হলেও ওরা ভালো বন্ধু। বিভিন্ন ছুটি ছাটায় আমরা ও সজীবরা মিলে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। অবশ্য এ ক্ষেত্রে আমরা সব সময়ই সজীবের স্ত্রী ফাহিমার শরণাপন্ন হই।

মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রত্যকটা সম্পর্ক তৈরিই হয় পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহানুভূতি ও পরমত সহনশীলতার ওপর ভিত্তি করে। হোক সেটা একই লিঙ্গের বা বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে বা একই দেশের বা অন্য দেশের মানুষের সঙ্গে। মানুষের সঙ্গে মানুষের এই সম্পর্কগুলোই আমাদের জানতে সাহায্য করে যে আমার পাশে বসে থাকা মানুষটাই এক অন্য পৃথিবী নিয়ে ভাবছে, যেটার খবর আমার কাছে নেই। একইভাবে আমার ভাবনাগুলোও তার জানা নেই। তাই যখন দুজন মানুষ একে অপরের সঙ্গে আলাপ করে তখন সৃষ্টির নিয়মেই একে অপরের আত্মীয় হয়ে যান। সব বিষয়ে যে তাদের মতো মিলবে এমন কিন্তু নয় বরং মতের অমিল থাকা সম্পর্কগুলো টেকে বেশি দিন। তবে বিনা শর্তে কে অপরের সঙ্গে মিশতে হবে স্বার্থহীনভাবে। আর প্রত্যেকটা সম্পর্কেরই একটা সীমারেখা থাকে। কোনো অবস্থাতেই সেটা অতিক্রম না করাই ভালো। সবচেয়ে ভালো হয় শুরুতেই একটা সীমারেখা টেনে নিলে। বোন সারা জীবন বোনই থাকবে। ঠিক একইভাবে বন্ধু-বান্ধবী, ভাই-ভাবি, দাদা-বৌদিও একই সম্পর্কের মধ্যে সারা জীবন বাঁধা থাকলে সেটা আর কখনোই ছুটে যাওয়ার ভয় থাকে না।
...

মো. ইয়াকুব আলী: মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>