দিঘল মেঘের দেশে-সাত

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে তারা হাঁটছে। সেই সাড়ে দশটার দিকে এসেছে। এখন প্রায় সাড়ে বারোটার ওপরে বাজে। শিমুল ভাবি ভদ্রমহিলার ওপর বিরক্ত না হলেও নদী মনে মনে খুব বিরক্ত হচ্ছে।

নদী বুঝতে পারছে না, একটা সাধারণ ব্রা ও প্যান্টির জন্য ভদ্রমহিলার এত ঘোরাঘুরির কী আছে? সেই সেন্টার প্লেস শপিং সেন্টার থেকে ডাউন টাউন প্লাজা। হ্যামিল্টন সেন্ট্রালের কে মার্ট হয়ে ওয়ার্ড স্ট্রিটের ওয়্যার হাউস ক্লথিং সুপারমার্কেট। ভদ্রমহিলা হ্যামিল্টন সিটি সেন্টারের কোনো শপিং সেন্টার ও ক্লথিং সুপার মার্কেট বাদ দেননি। এখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিরাপার টি আওয়া শপিং সেন্টারে যাবেন। তিরাপার টি আওয়া শপিং সেন্টার হ্যামিল্টন সিটি সেন্টার থেকে প্রায় ২১ কিলোমিটার দূরে।

নদী নিজে নিজে মাথা নাড়ল। ২১ কিলোমিটার দূরে যাওয়া কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়। ভদ্রমহিলার গাড়ি আছে। শিমুল ভাবি ভদ্রমহিলার সঙ্গে যাচ্ছেন। কিন্তু নদীর যেতে ইচ্ছে করছে না। বরং ভদ্রমহিলার সঙ্গে ঘুরতে তার বিরক্ত লাগছে।

নদী ব্রা ও প্যান্টির রকমটা ঠিক বুঝতে পারছে না। একবার শুনেছে, ভদ্রমহিলা নাকি এমন এক ধরনের ব্রা ও প্যান্টি খুঁজছেন যেটা পেট, কোমর ও বুককে শক্ত করে শরীরের সঙ্গে চেপে রাখে। এটা কেউ পরলে তাকে দেখতে নাকি অনেকটা শুকনো দেখায়। ভদ্রমহিলা সেন্টার প্লেসে একটা পেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা আবার তার সাইজের হয়নি।

নদী মনে মনে হাসল। ভাবল, আহা, ভদ্রমহিলার সাইজে না হওয়ারই কথা। তার যে বেঢপ শরীর। ভুঁড়ি তো নয় যেন পোয়াতি গাইয়ের পেট!

শিমুল ভাবির সঙ্গে ভদ্রমহিলার বেশ ওঠাবসা। একই সার্বাবে খুব কাছাকাছি বাসা। শিমুল ভাবিদের বাসা ফিন্সলি স্ট্রিট আর ভদ্রমহিলার বাসা নটিংহ্যাম ড্রাইভে। দুই বাসার দূরত্ব পাঁচ শ মিটার হবে। ফিন্সলি স্ট্রিট থেকে বের হয়ে ডানে মোড় নিলেই নটিংহ্যাম ড্রাইভের ওপর বাসাটা। নদী প্রায় প্রতিদিন ভদ্রমহিলার বাসার সামনে দিয়ে ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়।

ভদ্রমহিলার নামটা অদ্ভুত। বেবুন। সবাই তাকে বেবুন ভাবি নামেই ডাকে। নদী ভদ্রমহিলার পুরো নাম জানে না। নদী প্রথম যখন ভদ্রমহিলার নাম শোনে, তখন সে ভেবেছিল ভদ্রমহিলার নাম বুঝি বেগুন ভাবি।

বেগুন কারও নাম হয় বলে নদীর জানা ছিল না। পরে সে শোনে, বেগুন নয়, বেবুন ভাবি। কোনো মহিলার নাম বেবুন, ওটাও নদী কখনো শোনেনি।

ভদ্রমহিলার স্বামী ডাক্তার। একটা ক্লিনিকে জিপি হিসেবে বেশ বড় বেতনে চাকরি করেন। তাদের হ্যামিল্টনে শেয়ার উড পার্কের বাড়িসহ তিনটা ফ্রি হোল্ড বাড়ি আছে। ভদ্রমহিলার দুই মেয়ে। এক মেয়ে দক্ষিণ দ্বীপের ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল সায়েন্সে পড়ে। ওখানে হোস্টেলে থাকে। আরেক মেয়ে এখনো হাইস্কুলে। বেশ গোছালো পরিবার। কিন্তু ভদ্রমহিলার স্বামী ডা. হাবিবের কথাবার্তার ধরন বেশ অশোভন। তিনি যে একজন ডাক্তার, কথাবার্তায় এর রেশ কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না। আর ভদ্রমহিলা যেন অশোভন কথাবার্তায় তার স্বামীর চেয়ে আরও এক ডিগ্রি ওপরে।

ভদ্রমহিলা এমনিতে কিছুই করেন না। ছোট মেয়েটাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে টইটই করে ঘুরতে বের হন। মাঝেমধ্যেই শিমুল ভাবিকে সঙ্গী করেন। আজ এই শপিং সেন্টার তো, কাল ওই শপিং সেন্টার। এক সপ্তাহে ইভেন্ট সিনেমায় তো, পরের সপ্তাহে হইটস সিনেমায়।

আর শিমুল ভাবিও ভদ্রমহিলার সঙ্গে বেশ মিলে চলেন। কোনো সপ্তাহে ভালো কিছু রান্না করলে খাবার আদান-প্রদান করেন। গাড়িতে বসে ভারতীয় বাংলা সিরিয়াল নিয়ে কথার তুমুল খই ফোটান। হিন্দি সিনেমা কোনোটা বাদ দেন না। শাহরুখ খানের সিনেমা হলে তো কথাই নেই। হ্যামিল্টনের কোনো সিনেমা হলে শাহরুখ খানের নতুন মুক্তি পাওয়া ছবি না দেখালে গাড়ি চালিয়ে অকল্যান্ডে চলে যান। হ্যামিল্টন থেকে অকল্যান্ডের দূরত্ব এক শ বিশ কিলোমিটার হলেও গাড়িতে মাত্র এক ঘণ্টা পনেরো মিনিট লাগে।

নদী বুঝতে পারে, বেবুন ভাবি শিমুল ভাবিকে সহজ-সরল পেয়ে ব্যবহার করছেন। তার টইটই করে ঘোরার জন্য একজন সঙ্গী প্রয়োজন। তাই শিমুল ভাবিকে নিয়ে যান। কিন্তু শিমুল ভাবি তা বুঝতে পারেন না। অন্ধের মতো অনুসরণ করেন। তবে নাজমুল আহসান ভদ্রমহিলাকে খুব একটা পছন্দ করেন না। তিনি মাঝেমধ্যেই অভিযোগ করেন, ভদ্রমহিলার জন্যই নাকি তার সংসারের কোনো একটা কাজ হয় না। নাজমুল আহসান সময় ও সুযোগে ডা. হাবিবকেও আড়ালে অপদার্থ গরু বলে গালি দেন।

হ্যামিল্টন সেন্ট্রালের কার পার্কের দিকে ওরা এগোচ্ছিল। নদী একটু পেছনে সরে আস্তে করে শিমুল ভাবিকে ডাকল, ভাবি।

শিমুল ভাবি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই নদী বলল, ভাবি, আমি আর আপনাদের সঙ্গে যেতে চাচ্ছি না।

শিমুল ভাবি ভলল, কেন, খারাপ লাগছে?

নদী বলল, নাহ, খারাপ লাগবে কেন? আসলে আমার অ্যাসাইনমেন্টের একটু কাজ আছে।

: আমরা বেশিক্ষণ সময় নেব না। টি আওয়া শপিং সেন্টার থেকে ঘণ্টা খানিকের মধ্যেই ফিরে আসব।

: আসলে আমি ওখানে যেতে চাচ্ছি না।

বেবুন ভাবি একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে?

শিমুল ভাবি বললেন, নদীর অ্যাসাইনমেন্ট আছে।

বেবুন ভাবি মুখ একটু বাঁকা করে বললেন, শনিবারে কীসের অ্যাসাইনমেন্ট?

নদী বলল, শনিবারে আমাদের ল্যাব খোলা থাকে। আমাদের ইউনিভার্সিটির সেন্ট্রাল লাইব্রেরিটাও খোলা থাকে।

বেবুন ভাবি বললেন, হয়েছে, হয়েছে। আমরাও বিশ্ববিদ্যালয় পার করে এসেছি।

নদী কিছু বলল না।

শিমুল ভাবি বললেন, ও যেতে চাচ্ছে যাক। আমরা তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।

নদী বলল, ভাবি, অসুবিধা নেই। সামনেই তো বাস ডিপো। সেখান থেকে বাসে করে হ্যামিল্টন ইস্টে চলে যাব।

বেবুন ভাবি কথাটা টেনে নিয়ে বললেন, হ্যামিল্টন ইস্টে কেন? সেই ছেমড়াটার বাসায় যাবে?

নদী বলল, ভাবি, আপনি কী যে বলেন!

বেবুন ভাবি বললেন, আমি ঠিকই বলছি। তোমার ইউনিভার্সিটি তো হিলক্রেস্টে। তুমি হ্যামিল্টন ইস্টে যাবে কেন?

নদীর ভেতরে-ভেতরে মেজাজ খারাপ হলো। তারপরও সে মুখ একটা কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল, ভাবি, হ্যামিল্টন ইস্টে আমার একজন টিচার থাকেন।

শিমুল ভাবি সায় দিয়ে বললেন, জি ভাবি, হ্যামিল্টন ইস্টে নদীর এক টিচার আছেন। তিনিই নদীর স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বলেই তিনি নদীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, নদী, কী যে নাম তার?

নদী আস্তে করে বলল, নিকোলাস রজারসন।

বেবুন ভাবি আর কথা বাড়ালেন না।

নদী ওদের থেকে বিদায় নিয়ে ট্রান্সপোর্ট সেন্টারের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

হ্যামিল্টন সেন্ট্রাল শপিং সেন্টার থেকে বাস ডিপোটা খুব একটা দূরে নয়। একেবারেই পাশে। ব্রাইস স্ট্রিটের ওপর ইনফরমেশন সেন্টার ও বাস ডিপো। কাচ ও অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমের ওপর ট্রান্সপোর্ট সেন্টারটা দাঁড়িয়ে আছে। একপাশে বড় করে লেখা আই। অর্থাৎ ইনফরমেশন সেন্টার। একপাশে ইন্টার সিটি বাসগুলো এবং অন্যপাশে লোকাল বাসগুলো দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকটা লোকাল বাসের সামনে ইলেকট্রনিকস বোর্ডে সার্বাবের নাম ও বাস নম্বর লেখা আছে।

নদী ট্রান্সপোর্ট সেন্টারে এসে হ্যামিল্টন ইস্ট ও হিলক্রেস্ট সার্বাবের বাসটার দিকে এগিয়ে গেল। সে শিমুল ভাবি বা বেবুন ভাবির কাছে তার শিক্ষক প্রফেসর ড. নিকোলাস রজারসনের বাসায় যাবে বললেও আসলে সে রাকিবের বাসায়ই যাবে। পুরো দুই সপ্তাহ ধরে রাকিবের সঙ্গে তার দেখা নেই। ফোনে অবশ্য বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে।

অবশ্য নদী যে প্রফেসর নিকোলাস রজারসনের বাসায় যাবে না, তা নয়। রাকিবের বাসা থেকে বের হয়ে সময় ও সুযোগে সে একবার প্রফেসর রজারসনের বাসায় ঢুঁ মারবে। কাছেই তো বাসা। রাকিব না যেতে চাইলে সে জোর করবে না। একাই যাবে।

আর বাকি দিনটা নদী হ্যামিল্টন ইস্টেই কাটাবে বলে ভাবছে। রাকিবের বাসা থেকে সে যদি প্রফেসর রজারসনের বাসায় যায়, ওখান থেকে ফিরে পুরো বিকেলটা সে রাকিবের সঙ্গে ওয়াইকাটো নদীর পাড়ে হেঁটে কাটাবে। রাকিবের প্রিয় স্থান হায়াস প্যাডকে সে বসে থাকবে। ডকে নেমে সে নদীর জল স্পর্শ করবে। জলে ভাসা হাঁসগুলো কাছে এলে সে এমনিই শব্দ করবে হিস হিস, হিস হিস। হাঁসগুলো প্যাক প্যাক করে শব্দ তুলবে। সে তখন রাকিবের দিকে তাকিয়ে হাসবে হি-হি, হি-হি।

হ্যামিল্টন ইস্টের বাসটা ছাড়তে আরও পঁয়ত্রিশ মিনিটের মতো সময় লাগবে। উইকএন্ডে এটা একটা সমস্যা। সার্বাবের বাসগুলো প্রতি এক ঘণ্টা পরপর ছাড়ে।

নদী একটু ভাবল এই পঁয়ত্রিশ মিনিট সে কী করবে। পাশেই অনেকগুলো সারি সারি স্টিলের বেঞ্চ পাতা। অনেকে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকে বসে আছে। একেকটা সার্বাবের লোকাল বাসগুলো একেক সময় ছাড়ে।

নদী সিদ্ধান্ত নিল, সে এই পঁয়ত্রিশ মিনিট ট্রান্সপোর্ট সেন্টারের ভেতর ক্যাফেটেরিয়ায় বসে কাটাবে। সে এখনো দুপুরের খাবার খায়নি। মাঝখানে বেবুন ভাবি ও শিমুল ভাবির সঙ্গে ডাউন টাউন প্লাজার ফার্স্ট ফুডের দোকান ওপোরটো থেকে গ্রিল চিকেনের একটা পিস খেয়েছে। শিমুল ভাবিও এক পিস চিকেন নিয়েছিলেন। কিন্তু বেবুন ভাবি এদিকে স্লিম হওয়ার জন্য ভিন্ন ধরনের ব্রা ও প্যান্টি খুঁজছেন, অথচ ওপোরটোতে তিনি গ্রিল চিকেনের পিস খেয়েছেন চারটা। খেতে খেতে বেবুন ভাবি বলেছেন, আহা, ওপোরটোর গ্রিল চিকেন, আমার সবচেয়ে ফেবারিট। আমি একাই আস্ত একটা গ্রিল চিকেন খেয়ে ফেলতে পারি!

নদী দুপুরে আর কিছু না খেলেও তার তেমন ক্ষুধা নেই। এগারোটা-সাড়ে এগারোটার দিকে সে ওপোরটো থেকে যে গ্রিল চিকেনের একটা পিস খেয়েছে, ওটাতেই তার ক্ষুধা অনেকটা মিটে গেছে। পরে তার ক্ষুধা লাগলে সে রাকিবকে নিয়ে কারি পট ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে ঢুকবে। সেখানেও যদি না যায় সে রাকিবের বাসায় একটা কিছু বানিয়ে খাবে। আপাতত তার ট্রান্সপোর্ট সেন্টারের ক্যাফেটেরিয়ায় এক কাপ কফি খেতে ইচ্ছে হলো।

নদী ক্যাফেটেরিয়ার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বেবুন ভাবির কাছে তার মিথ্যে বলার কারণটা সে নিজে নিজেই ব্যাখ্যা করল। একে তো সে বেবুন ভাবিকে মোটেও পছন্দ করে না। তার ওপর বেবুন ভাবির কথা বলার ধরনটা একেবারেই অসহ্যকর। প্রথম যখন বেবুন ভাবির সঙ্গে নদীর পরিচয় হয়, তখন তিনি প্রথম পরিচয়েই বলে ওঠেন, ওমা, এ কী কথা রে, তোমাকে তোমার মা-বাবা একা এভাবে বিদেশ পাঠিয়ে দিলেন?

নদী সেদিন প্রতি উত্তরে বলেছিল, আমার বাবা নেই। আমার মা আমাকে বিদেশ পাঠিয়েছেন।

বেবুন ভাবি বলেছিলেন, তোমার মা-ই বা কেমন? তোমাকে একা পাঠালেন?

নদী কিছু বলার আগেই নাজমুল আহসান কথা টেনে নিয়ে প্রতিবাদ জানান, ভাবি, আপনি এটা কী কথা বলছেন? আজকাল কী মেয়েরা বিদেশ এসে লেখাপড়া করে না? এভাবে ডিসকারেজ করাটা মোটেও ঠিক না। আপনার মেয়েও তো ডানেডিন শহরে ওটাগো ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। আপনারা কি সেখানে থাকেন?

বেবুন ভাবি বলেন, তবুও তো।

নাজমুল আহসান জিজ্ঞেস করেন, তবুও কী?

বেবুন ভাবি কথা না বাড়িয়ে চুপ হয়ে যান।

নদীর বাবা নেই। কেউ তার মাকে নিয়ে ছোট করে কথা বললে সে তাকে মোটেও পছন্দ করে না। নদী কাউকে ছেড়ে দিয়েও কথা বলে না। কিন্তু সেদিন নতুন বলে বেবুন ভাবিকে নদী কিছু বলেনি। এ ছাড়া নাজমুল আহসান তার হয়ে বেবুন ভাবিকে কিছু বলে দিয়েছেন বলে সে চুপ ছিল।

ট্রান্সপোর্ট সেন্টারের ভেতর বেশ প্রশস্ত স্থান নিয়ে ক্যাফেটেরিয়াটা। ক্যাফেটেরিয়ায় তেমন মানুষজন নেই। এসব ক্যাফেটেরিয়ায় লেকজন সকালে বা বিকেলে বেশি কফি খেতে আসে। দুপুরে তেমন মানুষ ঢোকে না।

নদী একটা কফির কথা বলে চেয়ার টেনে বসল। ব্যাগটা আরেকটা চেয়ারে রেখে সে হাত দুটো ভাঁজ করে টেবিলের দিকে ঝুঁকে বসল। দুপুর প্রায় একটা পাঁচ বাজে। এখনো বাস ছাড়তে পঁচিশ মিনিট বাকি। তার হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে। কফিটা শেষ করেই সে বাসে উঠতে পারবে। ওদিকে ওয়েটার কফি একটু তাড়াতাড়ি দিয়ে গেলেই হয়। সাধারণত বাসে কফির কাপ বা খাবারদাবার নিয়ে ওঠা নিষেধ।

নদী ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরে-বাইরে দৃষ্টি দিয়ে টেবিলের ওপর পড়ে থাকা একটা ফ্লায়ার হাতে নিল। হ্যামিল্টনের ওয়াইপা ডেল্টার ফ্লায়ার। হ্যামিল্টনের নিচে ছোট্ট করে লেখা কিরিকিরোয়া।

কিরিকিরোয়া মাউরি শব্দ। ইউরোপিয়ানদের বসতির আগে হ্যামিল্টনের আদি নাম ছিল ওটা। হ্যামিল্টন নামটা রাখা হয়েছে জন ফাইন চার্লস হ্যামিল্টনের নাম অনুসারে। যিনি ব্রিটিশ নেভি অফিসার ছিলেন এবং তাওরাঙা শহরের কাছে গেট-পা গ্রামে মাউরি যোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন।

নদী কিরিকিরোয়া শব্দটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে রাকিবের কথা ভাবতে বসল। রাকিবের কাছ থেকেই সে এসব ইতিহাস-টিতিহাস শোনে। রাকিবের সঙ্গে পরিচয়ের আগে তার এসব ইতিহাস জানার প্রতি মোটেও আগ্রহ ছিল না। সারা জীবন বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিল বলে ইতিহাস-রাজনীতি তাকে টানত না। তার মা কবি। তাই হয়তো কবিতার প্রতি একটা অন্যরকম টান আছে। ভেতরগত টান। মার প্রতি ভালোবাসার টান।

নদী ফ্লায়ারটা টেবিলের একপাশে রাখতে রাখতে কেমন আনমনা হয়ে গেল। সে রাকিবের কথা ভাবতে শুরু করল। কিন্তু আজকাল সে রাকিব সঙ্গে চলতে চলতে, পাশাপাশি ওয়াইকাটো নদীর তীরে হাঁটতে হাঁটতে ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, সাহিত্যে-সংস্কৃতির প্রতি কেমন আকৃষ্ট হয়ে উঠছে। এখন তার সাহিত্য ও সংস্কৃতির কথা শুনতে ভালো লাগে। ইতিহাসের কথা শুনতে ভালো লাগে। রাজনীতি ও দর্শনের কথা শুনতে ভালো লাগে। বিশেষ করে তার রাকিবের কথা শুনতে ভালো লাগে।

নদী ভাবল, রাকিবের কথা বলার ধরনটাই অন্যরকম। কথা বলার সময় একধরনের গাম্ভীর্য দিয়ে সে কঠিন বিষয়টা সহজ করে তোলে। পরিবেশটাকে নিজস্ব করে নেয়।

এ ছাড়া রাকিবের যে ব্যাপারটা নদীকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে সেটা হলো, তার ব্যক্তিত্ব ও অহংকার। অনেক ছেলেরা আছে, যারা মেয়ে দেখলেই ছোঁক ছোঁক করে। সুযোগ পেলেই ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলে। কিন্তু রাকিবের মধ্যে সে মোটেও এ রকম কোনো আচরণ দেখেনি। রাকিবের কথা বলার মধ্যে একটা নির্দিষ্ট সীমা ও শালীনতা বজায়ে রাখে।

এদিকে বরং নদী নিজে বরাবর হাসি-ঠাট্টা করে। মাঝেমধ্যে বেফাঁস কথা বলে ফেলে। মজা করতে গিয়ে দুই-একটা অশোভন কথাও বলে ফেলে। তখন রাকিব মিটমিট করে হাসে। কোনো জবাব দেয় না। আবার কথাটাকেও বাড়তে দেয় না।

একজন ওয়েটার কফি নিয়ে এল। সঙ্গে পিরিচে একটা মাসম্যালো। নদী ওয়েটারকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাত বাড়িয়ে কফির কাপ নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বাইরে তাকাল। আকাশের প্রায় সমস্তটাই নীল। এলোমেলো যতটুকু ছেঁড়া মেঘ, তা বেশ দূরে দূরে। ট্রান্সপোর্ট সেন্টার থেকে একেকটা সার্বাবের বাস ছাড়ছে। মানুষজন গিয়ে সেসব বাসগুলোতে উঠছে। হ্যামিল্টন ইস্টে বাস ছাড়তে এখনো ঢের সময় বাকি।

নদী ভাবল, এমন দিনের বিকেলে নদীর পাড়ে হাঁটতে কী না ভালো লাগবে!

নদী রাকিবকে একটা ফোন দেওয়ার কথা ভাবল। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বেরও করল। কিন্তু কী ভেবে সে ফোন দেওয়া থেকে বিরত হয়ে গেল। তার তৎক্ষণাৎ রাকিবের গম্ভীর গলাটার কথা মনে পড়ল। গত দুই সপ্তাহ ধরে নদী যতবার ফোন দিয়েছে ততবারই সে তার গম্ভীর গলা শুনেছে।

নদী ভাবল, রাকিবের কী হয়েছে? নদী কী রাগ করার মতো কিছু করেছে? ফোনের ওপাশে রাকিবের গম্ভীর গলায় শুনে প্রথম প্রথম নদী তেমন গা করেনি। কিন্তু পরে আরও দুই-তিন বার ফোন দিয়ে বুঝতে পেরেছে, কোথাও কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।

নদী নিজেকে নিজে অনুসন্ধান করতে শুরু করল। ভাবল, হ্যাঁ, এটা ঠিক যে সে মাঝেমধ্যে বেশ হাসিঠাট্টা করে দু-একটা উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলে। কিন্তু রাকিব তো এর আগে এসব নিয়ে কখনো রাগ করেনি? এ ছাড়া রাকিবের রাগ হওয়ার মতো সে তেমন কিছু বলেছে বলে মনে পড়ল না। তবে কী তার শিক্ষক প্রফেসর নিকোলাস রজারসন কোনো অপমানমূলক কথা বলেছেন? কিংবা কটূক্তি?

ধ্যাত! নদী কফির কাপে চুমুক দিয়ে মোবাইলটা আবার ব্যাগে রেখে দিল। ভাবল, সরাসরি বাসায় গিয়ে দেখা করলেই ভালো হবে। বাসায় অথবা নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে নদী রাকিবকে কথাটা জিজ্ঞেস করবে।

নদী কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবল, রাকিব নিশ্চয়ই আজ তার অপেক্ষায় বসে আছে? গত শনিবারে নদী রাকিবের বাসায় আসতে পারেনি। এখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটির একটা পিকনিকে কারাপিরো লেকে গিয়েছিল। কী সুন্দর লেকটা! চারপাশে অসংখ্য সবুজের মধ্যে লেকের সবুজ জল। আর মুগ্ধ করা পাহাড়ের ঢাল। কৃষকদের বাংলোগুলো যেন ঝুলে আছে সেই পাহাড়ের ঢালে। লেকের জলে অসংখ্য হাঁস আর ওয়াটার বাইকের ভট ভট শব্দ। নদীর তখন রাকিবের কথা খুব করে মনে পড়ছিল।

নদী অবশ্য ফোনে রাকিবকে তাদের সঙ্গে কারাপিরো লেকে যেতে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু রাকিব গম্ভীর গলায় না করেছে। তার নাকি ওসব কমিউনিটির অনুষ্ঠান বা পিকনিক ভালো লাগে না।

তারপর পুরো এক সপ্তাহ কীভাবে যে চলে গেল! নদী অ্যাসাইনমেন্টের কাজে সত্যি খুব ব্যস্ত ছিল। তারপরও সে চেষ্টা করেছে ফোনে কথা বলতে। সে-ই ফোন দিয়েছে। রাকিব একবারও ফোন দেয়নি।

কফি শেষ করে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বের হতেই বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেল। সে বাসে উঠল। বাসে যাত্রী মাত্র ছয়জন।

বাসে হ্যামিল্টন ইস্টে যেতে বিশ মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু আজ প্রায় পঁচিশ মিনিটের ওপরে লেগে গেল। বাস থেকে ওয়েলিংটন স্ট্রিটে নেমে হেঁটে রাকিবের বাসায় পৌঁছতে আরও তিন-চার মিনিট লাগে।

নদী ধীর পায়ে রাকিবের বাসায় এসে পৌঁছাল। ড্রাইভওয়ে থেকে নদী বাসার দিকে তাকিয়ে দেখল, বাসার দরজা-জানাল সব বন্ধ। পর্দাগুলো টেনে দেওয়া। বাসার সামনে রাকিবের গাড়িটা নেই।

নদীর আশঙ্কা হলো, রাকিব নিশ্চয়ই বাসায় নেই। তারপরও সে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এল।

রাকিবের বাসায় কলিংবেল নেই। নদী দরজায় নক করল। একবার, দুবার, তিনবার। কিন্তু বাসার ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই।

নদী ঘড়ি দেখল। দুটোর ওপরে বাজে। সে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে রাকিবকে ফোন দিল। ওপাশে ফোনে রিং হচ্ছে-কিরিরিত, কিরিরিত, কিরিরিত। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর রাকিব ফোন ধরল। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: