উইসকনসিনে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের কনভেনশন

কনভেনশনে অংশগ্রহণকারী রাসায়নিক ও প্রাণ-রাসায়নিক গবেষকেরা
কনভেনশনে অংশগ্রহণকারী রাসায়নিক ও প্রাণ-রাসায়নিক গবেষকেরা

উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশি রাসায়নিক ও প্রাণরাসায়িক বিজ্ঞানীদের দ্বিতীয় কনভেনশন হয়ে গেল উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের মিলওয়াকি শহরে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে আগত বিজ্ঞানীরা এই কনভেনশনে যোগ দেন। গত ১১ আগস্ট এ কনভেনশনের আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড বায়োকেমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ইন নর্থ আমেরিকা (বাকাবানা)।

উইসকনসিনে নিবন্ধিত এই অলাভজনক সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে ২০১৬ সালে। উত্তর আমেরিকায় কেমিক্যাল ও বায়োকেমিক্যাল বিষয়গুলোতে অধ্যয়নরত ও পেশাজীবী বাংলাদেশিদের উৎকর্ষসাধনের লক্ষ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, বিভিন্ন ধরনের মিটিং, পেশাগত যোগাযোগ, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, পেপার ও রিপোর্ট প্রকাশনার মাধ্যমে নেটওয়ার্কিং তৈরি করার জন্য কাজ করে সংগঠনটি। এ ছাড়া, বাকাবানা শিক্ষা, শিল্প ও পরিবেশ খাতে আমেরিকায় বসবাসরত এই সব পেশাজীবীদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা বাংলাদেশের সঙ্গে বিনিময়ের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করতে আগ্রহী। উল্লিখিত লক্ষ্যগুলিকে সামনে রেখে আয়োজন করা হয়েছিল এই কনভেনশন।

সারা দিনব্যাপী এই কনভেনশনের শুরুতে বাকাবানার সভাপতি ড. আবদুল মোমেন এবং দ্বিতীয় কনভেনশনের সভাপতি ও বাকাবানার প্রধান পরামর্শক ড. মাহমুন হোসেইন আগত শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেন। মাহমুন হোসেইন ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-মিলওয়াকির রসায়ন ও প্রাণ-রসায়ন বিভাগের একজন অধ্যাপক।

অনুষ্ঠানে মূল বক্তা ছিলেন ভার্জিনিয়ার জর্জ ম্যাসন ইউনিভার্সিটির রসায়ন ও প্রাণরসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল হুসসাম, টেক্সাসের সেরিয়াম ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা ড. টিম হোসেইন, ব্যালিফোর্নিয়ার ইন্নোসেন্স এলএলসির প্রেসিডেন্ট ও সিইও ড. কিশলয় গোস্বামী। বৈজ্ঞানিক বক্তা ছিলেন আরলিংটনের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের রসায়ন ও প্রাণরসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইফুল চৌধুরী, টেনেসির ভেন্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটির গবেষণা সহযোগী অধ্যাপক ড. জসিম উদ্দিন, ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-প্ল্যাটভিলের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ রাব্বানী। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন কনভেনশনের আহ্বায়ক ও বাকাবানার সাধারণ সম্পাদক ড. মোহাম্মদ রেজাউল করিম।

ড. হুসসাম ২০০৬ সালে খাবার পানি থেকে বিষাক্ত আর্সেনিক দূর করার জন্য টেকসই সনো ফিল্টার আবিষ্কার করেন। তাঁর এই ফিল্টার বাংলাদেশসহ ভারত ও পাকিস্তানে পানি বিশুদ্ধকরণে ব্যবহার করা হয়। তিনি বাকাবানার এই কনভেনশনে অ্যাকাডেমিক পেশার বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন। বিশেষত কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে ও কোন কোন বিষয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। উপস্থিত পিএইচডি শিক্ষার্থী ও পোস্ট ডকদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, একবার টেনিউর-ট্র্যাক সহকারী অধ্যাপক পদে চাকরি পাওয়ার পর কীভাবে কঠোর পরিশ্রম করে তা স্থায়ী করতে হয়। তিনি তার নিজস্ব গবেষণা বিষয়েও আলোচনা করেন।

কিশলয় গোস্বামী পিএইচডি শেষ করে বার্কলির ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় পোস্ট ডক করেন নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী অধ্যাপক ম্যালভিন ক্যালভিনের তত্ত্বাবধানে। এরপর তিনি ১৯৮৭ সালে শিল্প গবেষণা পেশায় নিয়োজিত হন এবং ধীরে ধীরে একজন শিল্প উদ্যোক্তায় পরিণত হন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী লতিকা গোস্বামী যৌথভাবে ২০০২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে ইন্নোসেন্স এলএলসি নামে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছেন। সামরিক, স্বাস্থ্যসেবা, মহাকাশ ও শক্তি উৎপাদনে ব্যবহারযোগ্য কোটিংস ও সেন্সর তৈরির ন্যানোটেকনোলজিকে কাজে লাগিয়ে তার শিল্প ইন্নোসেন্স এ পর্যন্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আবিষ্কার করেছে। যা আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ অনেকেই কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছে। কিশলয় গোস্বামী তার শিল্প-পণ্যগুলোর মধ্য থেকে কুয়াশা-নিরোধক আবরণী (FogGoTM coatings) নিয়ে আলোচনা করেন। যা কিনা গাড়ির জানালার কাচে বা চশমার কাচে ব্যবহার করা যাবে। তিনি এই কুয়াশা-নিরোধক আবরণীযুক্ত চশমার সাহায্যে উপস্থিত ছয়জন বিজ্ঞানীকে নিয়ে একটি প্রদর্শনী দেখান।

টিম হোসেইন একজন শিল্প-উদ্যোক্তা। তিনি সেরিয়াম ল্যাবরেটরিজ নামে একটি ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠা করেছেন টেক্সাসে। দীর্ঘ ৩৫ বছরেরও বেশি সময় তিনি রেডিও নিউক্লিয়ার ফিল্ডে কাজে করছেন। তার গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর মধ্যে নিউট্রন ইন্টারসেপ্টিং সেমিকন্ডাক্টর চিপ (NISC) ও নিউট্রন ডেপথ প্রোফিলিং (NDP) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি একাধিকবার আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি কমিশনে (IAEA) জাতিসংঘ কর্তৃক নির্বাচিত পরামর্শক দলে কাজ করেছেন। টিম হোসেইন তার এই দীর্ঘ পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন উপস্থিত বিজ্ঞানীদের সামনে। তিনি শিল্প খাতে পেশাগত জীবনের চ্যালেঞ্জ ও সফলতা লাভের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন। তিনি তার গুরুত্বপূর্ণ কিছু গবেষণা কাজও তুলে ধরেন।

বাকাবানার কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা। বাঁ থেকে শাহনেওয়াজ আলী, মোহাম্মদ রেজাউল করিম, মহব্বত আলী, তৌফিকুর রহমান, আবদুল মোমেন ও জুবায়ের আহমেদ খান
বাকাবানার কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা। বাঁ থেকে শাহনেওয়াজ আলী, মোহাম্মদ রেজাউল করিম, মহব্বত আলী, তৌফিকুর রহমান, আবদুল মোমেন ও জুবায়ের আহমেদ খান

সাইফুল চৌধুরী, জসীম উদ্দিন ও মোহাম্মদ রব্বানি তাদের গবেষণা কাজের ওপর আলোচনা করেন।

আলোচনা পর্বের শেষে আমেরিকায় স্থায়ী অধিবাসী ও বৈধভাবে কাজের অন্যান্য আইনি ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন ইয়ং অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস এলএলপির অভিবাসী আইনজীবী কেইট ইউড।

বিকেলে পোস্টার প্রদর্শনী পর্বে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত শিক্ষার্থীরা তাদের গবেষণা কাজ উপস্থিত বিজ্ঞানী ও পোস্টার বিচারকদের সামনে তুলে ধরেন। দুই ঘণ্টারও অধিক সময় ধরে চলা এ সেশনে উপস্থিত সকলের পারস্পরিক কাজ জানা ও বোঝাসহ পেশাগত নেটওয়ার্কিংয়ের এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়। পোস্টার প্রদর্শনীর পুরস্কার বিতরণীর সময় বিচারকমণ্ডলী বাংলাদেশি এই তরুণ বিজ্ঞানীদের গবেষণা কাজের প্রশংসা করেন। প্রথম হন পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যাকেজিংয়ের জন্য সেলুলোজ ন্যানো-ক্রিস্টাল কোটিংস নিয়ে গবেষণারত পিএইচডি গবেষক রিয়াজ আহমেদ চৌধুরী। দ্বিতীয় হন ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-মিলওয়াকিতে অর্গানোমেটালিক সিনথেসিস নিয়ে গবেষণারত পিএইচডি গবেষক জাওয়াদ বিন বেলায়েত। তৃতীয় হন ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-মিলওয়াকিতে ইন্ডোল অ্যালকালয়েড সিনথেসিস নিয়ে গবেষণারত পিএইচডি গবেষক মো. তৌফিকুর রহমান।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে মোহাম্মদ রেজাউল করিম সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। যারা কনভেনশনের বিভিন্ন কমিটিতে থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই কনভেনশনকে সফল করেছেন তাদের বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান তিনি। এ ছাড়া বাকাবানার জন্ম ও এর বিকাশে যে কার্যনির্বাহী কমিটি নেতৃত্ব দিচ্ছে তার সদস্যদের তিনি সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।

সদস্যরা হলেন মো. আবদুল মোমেন (সভাপতি), মোহাম্মদ রেজাউল করিম (সাধারণ সম্পাদক), মো. তৌফিকুর রহমান (সাংগঠনিক সম্পাদক), মো. জুবায়ের আহমেদ খান (অর্থ সম্পাদক) ও মো. শাহনেওয়াজ আলী (প্রচার সম্পাদক)।
...

মোহাম্মদ করিম: ম্যাডিসন, উইসকনসিন, যুক্তরাষ্ট্র।