দিঘল মেঘের দেশে-আট

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তাওপো-নেপিয়ার শহরের মাঝখানের স্টেট হাইওয়ে ফাইভকে নিউজিল্যান্ডের উত্তর দ্বীপের সবচেয়ে রিমোট রোড হিসেবে ধরা হয়। প্রায় দেড় শ কিলোমিটার রাস্তার কোথাও কোনো ছোটবড় শহর নেই। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে তিন-চারটা গ্রাম পড়ে। আর স্টেট হাইওয়ের ওপর দুই-তিনটা গ্রাম্য বাজার।

তাওপো-নেপিয়ার রাস্তার শুরুটা হয়েছে সারি সারি পাইন গাছের দিঘল বিস্তৃত বন দিয়ে। এই পাইন গাছের বন মানুষের তৈরি। তারপর শুরু হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা হাজার বছরের পুরোনো বিশাল কাইমানোয়া বন ও ফিরিনাকি বন। এই বনগুলোতে শত শত বছরের পুরোনো গাছ এখনো স্পর্শহীন রয়ে গেছে। এই বনগুলোতে অসংখ্য হরিণ বসবাস করে।

ফিরিনাকি বনের ভেতরই ওয়াইপোঙ্গা জলপ্রপাত ও অদ্ভুত সুন্দর সাদাজলের মোহকা নদী।

রাকিব ওয়াইপোঙ্গা জলপ্রপাত ও মোহকা নদীর কাছে গাড়ি থামাবে আগেই ভেবে রেখেছিল।

ডেজার্ট রোড শেষে স্টেট হাইওয়ে ফাইভ ধরে খানিকটা যেতেই ফিরিনাকি বন। মানুষের তৈরি দিঘল পাইন গাছের বন শেষ হয়ে ফিরিনাকি বনের শুরুতে ওয়াইপোঙ্গা জলপ্রপাত। অবশ্য ওয়াইপোঙ্গা জলপ্রপাত দেখার জন্য স্টেট হাইওয়ে ফাইভ ছেড়ে এক কিলোমিটার ভেতরে যেতে হয়। গাড়ি নিয়ে সরাসরি জলপ্রপাতটার কাছাকাছি চলে যাওয়া যায়। তবে গাড়ি পার্ক করার পর হুট করে জলপ্রপাতটা দেখা যায় না। কিন্তু এর গর্জন শোনা যায় শো শো, শো শো। এক শ-দেড় শ মিটার হাঁটলেই যখন জলপ্রপাতটা দৃষ্টিগোচর হয়, তখন মনে হয় যেন অনেকগুলো পাথরের ভেতর থেকে প্রচণ্ডবেগে জল বের হচ্ছে। পাথরগুলোর চারপাশে ফার্ন ও সোনালতা এমনভাবে বিছিয়ে রয়েছে যে, জলপ্রপাতের উৎসস্থল দেখাই যায় না।

রাকিব ওয়াইপোঙ্গা জলপ্রপাতে প্রথম এসেছিল প্রায় দশ বছর আগে। তখন এমেন্ডার সঙ্গে তার নতুন সম্পর্ক। তাদের তখন নতুন বিয়ে হয়েছে। তখন দুজনেরই ছিল প্রবল তারুণ্য।

রাকিবের মনে আছে, ওয়াইপোঙ্গা জলপ্রপাতের এই কার পার্কে এক ইউরোপিয়ান ভদ্রলোকের সঙ্গে তার পরিচয় ও কথাবার্তার পর সে কোনো কারণ ছাড়াই ভদ্রলোকের কাছ থেকে নিয়ে সিগারেট টেনেছিল। রাকিব এর আগে কখনো ধূমপান করেনি। সেদিনই ছিল তার প্রথম সিগারেট টানা। এরপরে সে শেষ কবে সিগারেট টেনেছিল, তার মনে নেই। কিন্তু সেদিন তাকে সিগারেট ফুকতে দেখে এমেন্ডার সে কী নাক ফোলানি! পরের এক ঘণ্টা এমেন্ডা তার সঙ্গে কথাই বলেনি।

যদিও নিউজিল্যান্ডের শতকরা সত্তর ভাগ মেয়ে ধূমপান করে, কিন্তু এমেন্ডার কখনই সিগারেট ফুকত না। তার সামনে কেউ ধূমপান করুক এটাও সে পছন্দ করত না। এই গুণটা বাদেও এমেন্ডার আরও অনেক গুণ ছিল যা রাকিবকে মুগ্ধ করত। এমেন্ডার কখনই অ্যালকোহলের আসক্তি ছিল না। সে নাইট ক্লাবিং মাঝেমধ্যে করত ঠিকই। কিন্তু খুব একটা পছন্দ করে যে নাইট ক্লাবে যেত, তা নয়। খুব অল্প বয়স থেকে কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল বলে সাংসারিক হয়ে উঠতে তার দেরি হয়নি। আর তার সবচেয়ে বড় যে গুণটা ছিল, তার ভেতর মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল অফুরান। কারও অতি সাধারণ দুঃখের কাহিনি শুনে সে কেঁদে ফেলত।

রাকিব গাড়িটা পার্ক করে এসে ওয়াইপোঙ্গা জলপ্রপাতের কাছে দাঁড়িয়ে ভাবল, আজ থেকে সাড়ে পাঁচ বছর আগে সিরাজ নিশ্চয়ই এমেন্ডার কাছ থেকে সেই সুযোগটা নিয়েছিল? সুযোগ ও সুযোগ সন্ধানী! সিরাজের চেয়ে সুযোগ সন্ধানী আর কে হতে পারে?

রাকিব নিউজিল্যান্ডে এসে কত যে বহুমাত্রিক মানুষের সন্ধান পেয়েছে! শুধু বাঙালিদের মধ্যেই নয়, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসী প্রত্যেকটা মানুষ ও প্রত্যেকটা কমিউনিটির মধ্যেই সে এই বহুমাত্রিক ভাব দেখেছে। এদের মধ্যে সম্পর্কের কোনো গভীরতা নেই, ভালোবাসার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সর্বত্র শুধু মুখোশ আর মুখোশ।

ওয়াইপোঙ্গা জলপ্রপাতে বরাবরই লোকজন কম হয়। তাওপো শহরের পাশে হোকা জলপ্রপাত অনেক সুন্দর ও সুবিশাল বলে ওখানটাতেই ভিড় জমে বেশি। এই জলপ্রপাতটায় সাধারণত তাওপো-নেপিয়ার আসা-যাওয়ার পথের কিছু যাত্রী থেমে দেখে যায়।

রাকিব ওয়াইপোঙ্গা জলপ্রপাতের পাশে বেশিক্ষণ দাঁড়াল না। গাড়িতে গিয়ে উঠে বসেই গাড়ি স্টার্ট দিল।

এদিকে দুপুর খানিকটা হেলে পড়েছে। কিন্তু চারদিকে রোদের তীব্রতা বেশ। আকাশের মেঘগুলোর বেশ দূরে দূরে। রাকিব গাড়ি চালাতে চালাতে যত দূর দৃষ্টি যায় ফিরিনাকি বনের সর্বত্র তাকাল। উঁচুনিচু পাহাড় ও দিগন্ত বিস্তৃত উপত্যকা। পাহাড়ের গায়ে হাজার হাজার বছরের গাছ। গাছগাছালির কোথাও কোনো ফাঁক নেই। দৃষ্টির ভেতর শুধু ঢেউখেলানো সবুজ আর সবুজ।

ওয়াইপোঙ্গা জলপ্রপাত থেকে মোহকা নদীটা খুব বেশি দূরে নয়। গাড়িতে মাত্র দশ-পনেরো মিনিটের পথ। মোহকা নদীর ওপর বিশাল লম্বা একটি পাকা সেতু। সেতুর দুই প্রান্তেই উঁচু পাহাড়। রাকিব তার গাড়িটা মোহকা নদীর একপাশে পার্ক করে পাকা সেতুটার ওপর উঠল।

ফিরিনাকি বনের এ পাশটাতেও হাজার বছরের পুরোনো গাছ, অসংখ্য ফার্ন, সোনালতা ও ক্যাবেজ গাছ বিছিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে মোহকা নদীর দুই পাড়ে চিরল পাতার ক্যাবেজ গাছ ও ফার্ন গাছ বেশি। আর নদীর দিকে পাহাড়ি ঢাল যেন হাজার বছর পেছনে নিয়ে যায়। রাকিব হাঁটতে হাঁটতে সেতুর প্রায় মাঝ বরাবর এসে দাঁড়াল। শনিবার বলে স্টেট হাইওয়ে ফাইভে গাড়ির আসা-যাওয়া খুব।

রাকিব সেতুর রেলিঙে ঝুঁকে মোহকা নদীর এপাশ-ওপাশ দেখল। তার একবার ইচ্ছে, কোনো ভরাট জ্যোৎস্নার রাতে মোহকা নদীর এই পাকা সেতুটার ওপর দাঁড়াবে। প্রকৃতির মাঝে সে চাঁদের আলোতে গা ভেজাবে। রাকিব শুনেছে, রাতে নাকি অসংখ্য চিত্রা হরিণ মোহকা নদীতে জল খেতে আসে।

রাকিব মোহকা নামটার মধ্যে একটা আবেশ খুঁজে পায়। এখানটায় আসলেই তার বরাবর মনে হয়, এ যেন পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো একটা নদী। নদীর দুই পাশে উঁচু পাহাড় আর সবুজ প্রান্তর ঝুঁকে রয়েছে। মাঝখানে স্বচ্ছ জল বয়ে গেছে তির তির, তির তির। মোহকার নদী এই সেতুটায় দাঁড়ালে একজন কাঠখোট্টা মানুষও বলে উঠবে, আহা, পৃথিবী এত সুন্দর কেন?

রাকিব এমেন্ডাকে নিয়ে আসা-যাওয়ার পথে বেশ কয়েকবার এই পাকা সেতুটায় এসে দাঁড়িয়েছে। সেতুটা পাহাড়ের চূড়াকে সংযুক্ত করেছে বলে, আর নদীটা অনেক নিচ দিয়ে চলে গেছে বলে সেতুতে দাঁড়িয়ে কেউ জোরে শব্দ করলে এর স্পষ্ট প্রতিধ্বনি হয়। একটা বাক্য বললে পুরো বাক্যটা কয়েকবার করে ফিরে আসে। এমেন্ডাও এই সেতুটায় এলে জোরে শব্দ করত। নদীর দিকে মুখ করে বলত, আই লাভ ইউ রাকিব, আই লাভ ইউ রাকিব, আই লাভ ইউ রাকিব। হি–হি–হি, হি–হি–হি, হি–হি–হি।

এমেন্ডার বলা কথাগুলো নদীর জল ও দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়ের গায়ে লেগে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসত। একটা বাক্য তিন-চারটা বা পাঁচ-ছয়টা হতো। হাসিটা কেমন ভৌতিক ধ্বনি নিয়ে ফিরে আসত। রাকিবও এমেন্ডার সঙ্গে সঙ্গে হাসত। দুজনের হাসির ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে পরিবেশটা মুখর হয়ে উঠত। নদীর ধারের গাছের পাখিরা উড়ে যেত ফর ফর শব্দ তোলে।

রাকিব মোহকা নদীর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবল, আজ তার সেই হাসি কোথায়? আর ভালোবাসা?

রাকিব জানে না, সে এমেন্ডাকে কতটুকু ভালোবেসেছিল। তবে তার সেই পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে অনেক সুখ ছিল। অনেক আনন্দ ছিল। তারুণ্যে ভরা একটা যৌবন ছিল। আর সেই যৌবনের উপভোগ ছিল শতভাগ। পাঁচটা বছরের প্রায় পুরোটা সময়ে তাদের জীবনটা ছিল প্রতিটা ভোরের সৌন্দর্যের মতো। তাদের সুখ ছিল প্রতিটা বিকেলের গোধূলির মতো। তাদের সংসারটা ছিল প্রতিটা সন্ধ্যার নিস্তব্ধতায় একে-অপরকে আপন করে পাওয়ার মতো!

সংসার জীবনের আড়াই বছরের মাথায় এমেন্ডার পেটে নতুন মানুষের জানান দেয়। ঠিক নয় মাস পর ওদের ভালোবাসার সম্পদ সাদিয়ার জন্ম হয়। ওদের সেন্ট অবেন স্ট্রিটের সেই বাসা। তাদের ছোট্ট সংসার। তাদের মেয়ে সাদিয়ার মিষ্টি হাসি। সাদিয়ার প্রথম হামাগুড়ি। প্রথম হাঁটি হাঁটি পা পা। প্রথম কথা বলা। প্রথম জন্মদিন। তারপর?

রাকিব নিজে নিজে মাথা ঝাঁকিয়ে ভাবল, তারপর সাদিয়ার যখন এক বছর, তখন এমেন্ডার ল ফার্মের চাকরিটা হয়। রাকিব থেকে যায় সুপার মার্কেটের চাকরি নিয়েই। তারপরই শুরু হয় জীবনের সংঘাত।

অবশ্য ওদের সংসার জীবনের সেই সংঘাত যে এমেন্ডার ল ফার্মের চাকরিটা দিয়ে শুরু হয়, তা নয়। সংঘাত শুরু হয় অন্য কারণে। যা রাকিব প্রথম প্রথম কিছুই বুঝতে পারেনি। যখন বুঝতে পারে, তখন সব শেষ।

সিরাজ বন্ধু হয়েই রাকিবের বাসায় ঢুকেছিল। বন্ধু! আহা বন্ধু!

রাকিবের মুখে একদলা থুতু এসে জমা হলো। সেতুর নিচে প্রশস্ত নদীর জল। কিন্তু সে সেই নদীর জলে থুতুটা ফেলতে অস্বস্তিবোধ করতে শুরু করল।

যদিও রাকিব ও সিরাজ একই বিষয় বা একই ফ্যাকাল্টির ছিল না। তবুই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বলে ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। রাকিব ভালোকিছু রান্না করলে সিরাজকে বাসায় ডেকে নিয়ে আসত। সিরাজও মাঝেমধ্যে এমেন্ডা ও তাকে বাসায় ডেকে নিয়ে বা রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাওয়াত। এ ছাড়া নেপিয়ার ব্লাফ হিল, হেভলুক নর্থের টিমাতা পিক ও কেইপ কিডন্যাপারে দু-তিনবার ভ্রমণ। এক-দুবার নেপিয়ার মেরিন প্যারেডে গিয়ে বসে থাকা। ব্যস এটুকুই। এর বাইরে সাদিয়ার প্রতি সিরাজের স্নেহ ও ভালোবাসা একটু বেশিই ছিল। কিন্তু এমেন্ডার প্রতি?

রাকিব মাথা নাড়ল। ভাবল, নাহ, এর বাইরে আর এমন কিছু হয়নি যে সিরাজ এমেন্ডার সম্পর্ক সে আঁচ করতে পারবে।

রাকিবের প্রথম প্রথম বিশ্বাসই হয়নি সিরাজের সেই শ্যামলা চেহারা, নিষ্পাপ হাসি ও মধুর বন্ধুত্বমূলক আচরণের পেছনে ভেতরে ভেতর সে বিরাট একটা শয়তান নিয়ে বসবার করে। যে শয়তানের কারণে একজনের দাম্পত্য জীবন ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। একটা শিশু তার পিতৃত্বের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে মাত্র আড়াই বছর বয়সে মারা যায়!

এমেন্ডার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর রাকিব নিজে নিজে অনেক কেঁদেছে। তার এই কান্না দেখার মতো ছিল না। সেই সিরাজ তাকে কাঁদিয়েছে। তাদের সেই বিচ্ছিন্নতায় সে এমেন্ডাকে যতটুকু না দোষ দেয়, এর চেয়ে বেশি দোষ দেয় সিরাজকে। এমেন্ডা তো এ দেশি। ওদের মধ্যে সম্পর্কের বিচ্ছেদ কোনো ব্যাপারই নয়। নিউজিল্যান্ডের সমাজটাই এভাবে গড়ে উঠেছে। তার সংস্কৃতিও সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু সিরাজ?

রাকিব মোহকা নদীর জলের দিকে তাকিয়ে আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ভাবল, হ্যাঁ, সিরাজ। সেই সিরাজই দায়ী। সে তো বাঙালি। একজন বাঙালি হয়ে আরেকজন বাঙালির সংসার ভেঙে তছনছ করে দেওয়া?

এমেন্ডা এখনো হেভলুক নর্থের সেই ল ফার্মেই কাজ করে। আজ এত দিন পর কাল ওদের আবার দেখা হবে! কিন্তু সেই সিরাজ এখন কোথায়? নিশ্চয়ই সে নিউজিল্যান্ডে নেই। থাকলে সে কোনো না কোনোভাবে জানত। চলার পথে এত দিনে কোথাও না কোথাও দেখা হতো। নিশ্চয়ই সে অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস করছে। হয়তো ওখানে কারও সংসার ভাঙছে। আবার এটাও হতে পারে, অস্ট্রেলিয়া গিয়ে বাংলাদেশ থেকে কোনো মেয়েকে বিয়ে করে এনে সংসার পেতেছে। বাঙালি ছেলেরা তো অনেকেই এই কাজটা করে। নিজেদের নিউজিল্যান্ডের অপকর্ম লুকিয়ে রাখার জন্য অস্ট্রেলিয়া গিয়ে বসবাস করে। পরে বাংলাদেশ থেকে নতুন করে কোনো মেয়েকে বিয়ে করে এনে ওখানে সংসার পাতে।

স্টেট হাইওয়ে ফাইভ ধরে গাড়ি তেমন আসা-যাওয়া না করলেও মোহকা নদী ধরে খানিকক্ষণ পর পর ঠিকই স্পিড বোট যাচ্ছে। এই স্পিড বোটগুলো পর্যটকদের নদীটা ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য ভাড়া করা। রাকিব দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই দুটো স্পিড বোট সেতুর নিচ দিয়ে গেল। সে সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে নদীর স্রোতের বিভাজন দেখল। পাড়ে নদীর জলের আছড়ে পড়ার শব্দও শুনল, ছলাৎ ছলাৎ, ছলাৎ ছলাৎ।

এ সময় রাকিবের মোবাইলটা বেজে উঠল। তার মোবাইলটা হাতেই ছিল। মোহকা নদীর ছবি তুলবে বলে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। রাকিব মোবাইলে স্ক্রিনে দেখল, নদীর ফোন। কিন্তু ধরবে কী ধরবে না একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেল। কয়েকবারে রিং বাজতেই ফোন ধরল। আস্তে করে গম্ভীর গলায় বলল, হ্যালো।

নদী ফোনের ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় বলল, হ্যালো রাকিব ভাই, আমি নদী।

: তোমার নম্বর আমার মোবাইলে অনেক আগে থেকেই সেভ করা আছে।

: হি–হি–হি। ওভাবে বলবেন না তো। আমি তা জানি। আসলে আমি বলতে চাচ্ছি, আমি আপনার বাসার সামনে।

: তুমি আমার বাসার সামনে?

: হ্যাঁ, কিন্তু আপনার বাসা তো লক করা।

: আমি বাসায় নাই। বাসা তো লক করাই থাকবে, তাই না?

: হি–হি–হি, তা ঠিক। কিন্তু আপনি কোথায়?

: আমি অনেক দূর।

: অনেক দূর মানে, কত দূর?

: বললাম তো, অনেক দূর।

: ও, আচ্ছা। আমি তাহলে শুধু শুধু আসলাম।

: তুমি বাসায় আসার আগে একটা ফোন দিয়ে আসতে?

: কেন, ফোন দিয়ে কেন?

: না মানে। ফোন দিয়ে আসলে তো আমার বাসার সামনে থেকে ঘুরে যেতে হতো না।

: আমি কি সব সময় ফোন দিয়ে আসি?

: তা আসনি।

: বহুবার আমি ফোন না দিয়েও এসেছি।

রাকিব কিছু না বলে ফোনের ওপাশে চুপ হয়ে গেল।

নদীর মেজাজ এবার কিছুটা খারাপ হয়ে গেল। ভাবল, রাকিব ভাই হঠাৎ ফোন দিয়ে আসার কথা বলছেন কেন?

নদী যে কোনো দিন রাকিবের বাসায় ফোন দিয়ে আসেনি, তা নয়। তবে বেশির ভাগ শনিবারেই সে ফোন না দিয়ে সময় মতো এসে হাজির হয়েছে। আর রাকিব তার জন্য অপেক্ষায় থেকেছে।

দুজনই কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ। কিন্তু দুজনই মোবাইল কানে ধরে রেখেছে বলে ওদের কানে যেন একধরনের শো শো বাতাসের শব্দ ঢুকছে।

রাকিবই আগে কথা বলল, আমি তোমাকে শুধু শুধু ঘুরে যাওয়ার জন্য এ কথা বলছি। আমি অন্য কিছু মনে করে বলিনি।

নদী একটু ভারী গলার জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় এখন?

: আমি মোহকা নদীর ওপর একটা ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছি।

: মোহকা নদী? সেটা আবার কোথায়?

: স্টেট হাইওয়ে ফাইভে।

: স্টেট হাইওয়ে ফাইভ কোথায়?

: তাওপো থেকে নেপিয়ার-হেস্টিংস যাওয়ার যে পথ, সেটাই স্টেট হাইওয়ে ফাইভ।

: ও, সেটা তো অনেক দূর?

: হ্যাঁ, অনেক দূর। হ্যামিল্টন থেকে প্রায় আড়াই শ কিলোমিটার দূর।

: এত দূর! আপনি ওখানে কী করছেন?

: আমি ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে মোহকা নদীর স্রোত দেখছি।

: দেখুন, আপনি ঠাট্টা করবেন না। আপনি এখন কোথায়?

: আমি ঠাট্টা করছি না। আমি সিরিয়াস।

: দাঁড়ান, আমি ভিডিও কল দিচ্ছি।

: ভিডিও কল কেন?

: দেখি, আপনি কোন মোহকা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছেন।

: আমি মোহকা নদীর তীরে নয়, মোহকা নদীর ঠিক মাঝখানে ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। তোমাকে ভিডিও কল দিতে হবে না। আমি মিথ্যা বলছি না।

নদী আবার চুপ হয়ে গেল।

বাইরের রোদটা হঠাৎ করেই মিইয়ে এল। হয়তো সূর্যের মুখে মেঘ করেছে। তবে কালি মেঘ যে নয় তা বোঝা যাচ্ছে প্রকৃতির সাদা ভাব দেখে। নদী রাকিবের দরজার সামনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থেকেই আকাশের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টি আকাশ পর আকাশ ছাড়িয়ে বহুদূর গিয়ে থামল। এ এক অদৃশ্য দৃষ্টি।

রাকিব বলল, আমি এ জন্যই বলেছি তুমি ফোন দিয়ে আসলে ভালো হতো।

: আপনি ওখানে কখন গেছেন?

: আমি সকাল আটটায় হ্যামিল্টন ছেড়েছি।

: এখন তো দুটোর ওপরে বাজে।

: হ্যাঁ, আমি তাওপো লেকের পাশে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়েছি।

: হঠাৎ এত দূরে গেলেন?

: হঠাৎ নয়। সোমবারেই পরিকল্পনা করে রেখেছি।

: গত সোমবার?

: হ্যাঁ, গত সোমবারে।

: আমাকে তো একবারও বলেননি?

: তোমার সাথে তো পুরো দুই সপ্তাহ দেখা হয়নি। কীভাবে বলব?

: অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু ফোনে তো বলতে পারতেন?

: আসলে ও কথা মাথায় আসেনি।

: আমি কিন্তু নিউজিল্যান্ডে এত দূর কোথাও যাইনি। আমাকে নিয়ে গেলেও পারতেন। এটা কি ডে-ট্যুর?

: না, ডে-ট্যুর নয়। আমি ওভার নাইট করব।

: ও আচ্ছা। ওভার নাইট হলে আমি যেতাম না।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, কেন?

নদী একটু বিব্রত গলায় বলল, না মানে, আমি ভেবেছিলাম ডে-ট্যুর। আসলে আমি ওভার নাইট থাকি কী করে?

রাকিব বলল, আমি আসলে নেপিয়ার-হেস্টিংস যাচ্ছি।

: ওটা তো মনে হয় আরও দূর।

: হ্যাঁ, হকস বে অঞ্চলে। হ্যামিল্টন থেকে প্রায় সাড়ে তিন শ-পৌনে চার শ কিলোমিটার।

: অফিসের কাজে যাচ্ছেন?

রাকিব বলল, অফিসের কাজে শনিবারে কেউ যায় না। আমি একটা পার্সোনাল কাজে যাচ্ছি।

নদী জিজ্ঞেস করল, কীসের পার্সোনাল কাজ?

রাকিব একটু গম্ভীর গলায় বলল, কারও পার্সোনাল কাজের কথা জিজ্ঞেস করতে নেই।

নদী একটু আহত গলায় বলল, ও! (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন