দিঘল মেঘের দেশে-দশ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পথটা বেশ আঁকাবাঁকা। পাহাড়ের ঢাল কেটে পথটা করা হয়েছে বলে কোনো কোনো বাঁকে গাড়ির গতিবেগ ঘণ্টায় পঁচিশ-ত্রিশ কিলোমিটারে নামিয়ে নিয়ে আসতে হচ্ছে। রাকিব খুব ধীরস্থিরভাবেই গাড়ি চালাচ্ছে। পাহাড়ের পর পাহাড়। বাঁকের পর বাঁক। সবুজের পর সবুজ। দিগন্ত বিস্তৃত উপত্যকা।

গাড়ি চালাতে চালাতে রাকিব ভাবল, অপূর্ব সুন্দর নারীর দিকে যেমন বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। ওদের সৌন্দর্যে দৃষ্টি যেমন নিজ থেকে মুদে আসে, নিউজিল্যান্ডের সৌন্দর্যটা যেন রমণীর সৌন্দর্যের সেই অপূর্ব এক সবুজ রং। সত্যি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। দৃষ্টি নিজ থেকেই মুদে আসছে।

মোহকা নদী ছেড়ে গাড়িতে ওঠার পরই রাকিব ভেবে রেখেছিল, টিপোহইর কাছে বড় পাহাড়ের ওপর ভিউ পয়েন্টে সে একবার গাড়ি থামাবে। সেই ভিউ পয়েন্টে দাঁড়ালে কোনো স্পষ্ট দিনে অনেক দূরের নেপিয়ার শহরটা দেখা যায়। রাকিব ও এমেন্ডা একসময় সেই ভিউ পয়েন্টে গাড়ি থামাত। আর কোথাও গেলে ফেরার পথে এই ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে দুজনই একটা গম্ভীর নিশ্বাস নিত। ভাবত, আহা এসে গেছি। ওই তো নেপিয়ার শহর। তারপরই তো হেস্টিংস শহর! এক শ দশ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালিয়ে সেই টিপোহই পাহাড়টায় উঠতে ও নামতে সময় লাগে বিশ থেকে পঁচিশ মিনিট।

রাকিব অবশ্য আজ গাড়ি নিয়ে পাহাড়ের ওপর উঠে সেই ভিউ পয়েন্টের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ইচ্ছে করেই গাড়ি থামাল না। তার যে এখন তাড়া আছে, তা নয়। এখন বিকেল-দুপুরের সন্ধিক্ষণ মাত্র। হেস্টিংস শহরে গিয়ে সে রিনেই ভাবির বাসায় উঠবে। হোটেল-মোটেলের চেকিংয়ের ঝামেলা নেই। তবুও সে গাড়ি থামাল না। ভাবল, এত স্মৃতি নেড়ে কী লাভ? শুধু শুধুই কষ্ট পাওয়া। এ পথের প্রতিটা স্থানেই তো তার অসংখ্য স্মৃতি জমা হয়ে আছে। সে জানে, জীবনে প্রথম কিছু ঘটলে সেই প্রথম শব্দটা আজীবন মানুষকে তাড়া করে। প্রথম প্রেম। প্রথম বিয়ে। প্রথম স্ত্রী। প্রথম সংসার ও প্রথম সন্তান।

এমেন্ডা ছিল রাকিবের প্রথম স্ত্রী। আর ওটাই ছিল তার প্রথম সংসার। সে তার প্রথম সন্তানকেও হারিয়েছে এই হকস বে অঞ্চলে। আর কোনো বন্ধু কর্তৃক জীবনে প্রথম ধোঁকাটা খায়। ওটাও ছিল এই নেপিয়ার-হেস্টিংসে।

রাকিব গাড়ি টেনে চালিয়ে আর কোথাও না থেমে সরাসরি হকস বে অঞ্চলের নেপিয়ার শহরের কাছাকাছি চলে এল। নেপিয়ার শহরের অভিমুখে ঢোকার পথটা রাকিবের বেশ ভালো লাগে। ইসক ডেল বা ইসক ভ্যালির দিগন্ত বিস্তৃত আঙুরের বাগান। বাগানের দিঘল সারি। লাল-সবুজ-কালো রঙের আঙুরগুলো ঝুলে আছে কেমন বলগাহীন। ইসক ডেল নামটার সঙ্গে যেমন একটা ভারতের ছায়া আছে, তেমনই নেপিয়ার-হেস্টিংস শহরের নামকরণের সঙ্গেও বাংলার তথা ভারতবর্ষের ইতিহাস যুক্ত আছে।

চার্লস নেপিয়ারের নামে নেপিয়ার শহরের নাম রাখা হয়। চার্লস নেপিয়ার ছিলেন ভারতে ব্রিটিশ আর্মির চিফ ইন কমান্ড। যাঁর কমান্ডে সিন্ধু প্রদেশে যুদ্ধ হয়েছিল ও পরবর্তীতে সিন্ধু প্রদেশ ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ইউরোপিয়ান বসতির আগে নেপিয়ার শহরের নাম ছিল আহুরিরি। হেস্টিংস শহরের নামকরণও হয় বাংলার প্রথম ব্রিটিশ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের নামানুসারে। ইউরোপিয়ান বসতির আগে হেস্টিংস শহরের নাম ছিল কারামু। নেপিয়ার-হেস্টিংসের মধ্যবর্তী একটা ছোট্ট শহর। যেটার নাম করা হয়েছে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান লর্ড রবার্ট ক্লাইভের নামে। ক্লাইভ শহরের পাশ দিয়ে যে নদীটা বয়ে গেছে, সেই নদীটার নাম ক্লাইভ রিভার। নিউজিল্যান্ডের অন্যান্য নদীগুলো বেশ খরস্রোতা হলেও একটা ব্যাপার রাকিবকে অবাক করে, ক্লাইভ রিভার দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের ভরাট বানের কোনো নদীর মতো মনে হয়। যেন গোমতী-তিতাস নদী এখানটা দিয়ে বয়ে গেছে।
নেপিয়ার শহরে ঢুকে রাকিবের প্রথমেই মনে হলো, তার কিছু একটা খেয়ে নেওয়ার প্রয়োজন। সেই এগারোটার দিকে সে তাওপো লেকের পাড়ে বসে ম্যাকডোনাল্ডসের বার্গার চিপস খেয়েছে। কিন্তু এখনো তার দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি। এদিকে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে।

রাকিব আবার ফাস্ট ফুডের রেস্টুরেন্ট ম্যাকডোনাল্ডসের ড্রাইভ থ্রোতেই যাওয়ার চিন্তা করল। আপাতত তার হেস্টিংসে রিনেই ভাবির বাসায় যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। এত দিন পর সে হকস বে অঞ্চলে এসেছে, সে নিজে নিজে খানিকটা সময় কাটাতে চায়।

উইকএন্ড হলেও ম্যাকডোনাল্ডসের ড্রাইভ থ্রোতে আজ বেশ ভিড়। রাকিব বিগ ম্যাক বার্গার, চিপস ও ফ্রোজেন স্প্রাইট নিয়ে সরাসরি নেপিয়ারের মেরিন প্যারেডে চলে এল। মেরিন প্যারেডের স্থানে স্থানে সমুদ্রের দিকে মুখ করে পর্যটকেরা বসে আছে। খানিকটা দূরে দূরে বেঞ্চি পাতা। রাকিব বার্গার-চিপস নিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসল।

মেরিন প্যারেডে অনেক পর্যটক। গ্রীষ্মকাল বলেই পর্যটকদের এত ভিড়। সারা বিশ্ব থেকে পর্যটকেরা এ সময়টায় নিউজিল্যান্ডে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। নিউজিল্যান্ডের আয়ের একটা প্রধান অংশ আসে পর্যটন ব্যবসা থেকে।

যদিও রাকিব ও এমেন্ডা একসময় হেস্টিংসে বসবাস করত। কিন্তু বরাবরই রাকিবের ভালো লাগার শহর নেপিয়ার ছিল। ওরা প্রায় বিকেলেই কাজের শেষে নেপিয়ারে চলে আসত। বিশেষ করে গ্রীষ্মের বিকেলে এই মেরিন প্যারেডে এসে কোনো একটা বেঞ্চিতে বসে ওরা গায়ে গায়ে বসে সমুদ্রের ঢেউ দেখত। গানেট পাখির উঠানামা দেখত। দূরের জাহাজ দেখত। মাঝেমধ্যে দু-একটা পেঙ্গুইন ঢেউয়ের সঙ্গে তীরে উঠে এলে ওরা নুড়ি পাথর মাড়িয়ে ওটার দিকে দৌড়ে যেত।

নেপিয়ার শহরটা রাকিবের ভালো লাগার আরেকটা কারণ, শহরটা আর্ট ডিকো স্টাইলে গড়ে তোলা হয়েছে। ১৯৩১ সালের এক বিরাট ভূমিকম্পে শহরটা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। শহরের অনেকাংশ সমুদ্রে দেবে যায়। আবার অনেকাংশ নতুন করে ভেসে ওঠে। এখনো ভালো করে লক্ষ্য করলে নতুন ভূমি পুরোনো ভূমির সরু রেখাটা স্পষ্ট বোঝা যায়। পরে শহরটাকে আর্ট ডিকো স্টাইলে গড়ে তোলা হয়।

রাকিব বার্গার-চিপস শেষ করে ফ্রোজেন স্প্রাইটের কাপে চুমুক দিতে দিতে বেঞ্চে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আড়মোড়া ভাঙার মতো শরীরটা টেনে সে এদিক-ওদিক তাকাল। কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন প্যারেড বরাবরই অদ্ভুত সুন্দর অবয়ব নিয়ে রাকিবের সামনে ফুটে ওঠে। সারি সারি নরফক পাইন। মাঝেমধ্যে মোড়তার বন। পশ্চিমা বিশ্বে সমুদ্রের দিকে মুখ করে গড়ে ওঠার যে সংস্কৃতি, এর সবটাই নেপিয়ার শহরের এই মেরিন প্যারেডে বিদ্যমান। বিকেলের সূর্য এখন অদ্ভুত এক মায়াবী সৌন্দর্য নিয়ে হোটেল-মোটেল ও দোকানপাটের দিকে তাকিয়ে আছে। রোদটা যেন হলুদ কাঁচা সোনা রোদ।

এই মেরিন প্যারেডে রাকিবের কত স্মৃতি! বিকেলের নুড়ি পাথরের ওপর উচ্ছল ও চঞ্চল এমেন্ডাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। সন্ধ্যার পূর্বক্ষণ বা সূর্যাস্তের সময় তাদের দুজনের কাঁধে বা কোমরে হাত রেখে পশ্চিম দিকে মুখ করে বসে থাকা। কখনো এমেন্ডার মৃদু সুরে গুনগুন করে গান। আরও কত কী স্মৃতি! তারপর সাদিয়ার জন্ম। মেরিন প্যারেডের এই ফুটপাতে তারা দুজন দুপাশ থেকে সাদিয়ার দুই হাত ধরে হাঁটতে শেখানো। একদিন মেরিন প্যারেডের পাশেই সানকিনে গার্ডেনে মসৃণ ঘাসের ওপর সাদিয়ার নিজে নিজে প্রথম হাঁটা। এক পা, দুই পা, তিন পা! সাদিয়ার প্রথম বাবা বলে ডাকা-বাব্বা-আ!

রাকিবের চোখ ভিজে আসতে চাইল। কিন্তু সে কান্নাটা সংবরণ করে নিল। ভাবল, তার ভেতরের কান্নাটা ভেতরেই থাক। আড়াই বছরের একটা বাচ্চামেয়ে কেন ক্যানসারে মারা যাবে? আর সিরাজ? কিংবা এমেন্ডা?

দিঘল বিকেল। রাকিবের দিঘল ফুটপাত ধরে হাঁটা। নরফক পাইন গাছের ফাঁকে ফাঁকে বিকেলের রোদের ঝিকিমিকি খেলা। ফুটপাত, রাস্তা ও নুড়ি পাথরের সৈকতে শত শত পর্যটক, কিন্তু কোথাও কোনো শোরগোল নেই। সারি সারি গাছের ছায়ার মতোই যেন পরিবেশটা বেশ নিরিবিলি।

রাকিব দিঘল ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় পানিয়া অব দ্য রিফের কাছে এসে দাঁড়াল। মৎস্য কন্যা পানিয়া সমুদ্রের দিকে মুখ করে একটা পাথরের ওপর বসে আছে। একটা আস্ত মানুষের আকারে ব্রোঞ্জের মূর্তি। আদিবাসী মাউরিদের প্রেমের দেবী। বিকেলের রোদ সেই প্রেমের দেবীর গায়ে যেন গলে গলে পড়ছে।

রাকিব ব্রোঞ্জের মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে রইল। পানিয়া অব দ্য রিফের এই পানিয়ার গল্প সে প্রথম এমেন্ডার কাছেই শোনে।

মাউরি মিথে আছে, জলের দেবতা টেঙ্গারোয়ার একমাত্র কন্যা পানিয়া যৌবনে পদার্পণের পর এক সন্ধ্যায় সাঁতার কাটতে কাটতে সমুদ্র ছেড়ে ছোট্ট একটা নদী ধরে আহুরিরি শহরের উপকণ্ঠে চলে আসে। সেই আহুরিরি শহরেরটাই বর্তমানে আধুনিক নেপিয়ার।

নদীর ধারে ছিল একটা ঝরনা। ঝরনা ও নদীর এ পাশটা ছিল জনমানবহীন পাহাড়ি ভূমি। পানিয়া নদী ছেড়ে সেই ঝরনায় উঠে আসে। ঝরনার সুস্বাদু জল পান করে সে খুব তৃপ্ত হয়।
এরপর পানিয়া মাঝে মাঝেই সমুদ্র ছেড়ে ছোট্ট নদীটা ধরে সেই ঝরনার ধারে আসতে শুরু করে।

একদিন সে এক জ্যোৎস্নার রাতে ঝরনার জল খেয়ে তৃপ্ত হয়ে এর ধারেই আধা শোয়া হয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ছিল। ঠিক তখনই সে দূরে দেখে, মর্ত্যের এক যুবক তার দিকে এগিয়ে আসছে।

পানিয়া এর আগে এ রকম মর্ত্যের মানুষ দেখেনি। সে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।
সেই মর্ত্যের মানুষটা আর কেউ নয়, স্বয়ং আহুরিরি শহরের সর্দারে ছেলে। যার নাম করিটুকি।
করিটুকি ছিল যেমন লম্বা, তেমনই সুঠাম দেহের অধিকারী। তার গায়ের রং ছিল পরিষ্কার বাদামি। তার ছিল ঘাড় অব্ধি চুল, মায়াবী দুটি চোখ। সে মূলত সেদিন শিকার করা শেষে বাড়ি ফেরার পথে ঝরনার জলে তার তৃষ্ণা মেটাতে এসেছিল।

এদিকে করিটুকি ঝরনার ধারে পানিয়ার উপস্থিতি মোটেও টের পায়নি। সে এখানে কারও উপস্থিতি আশাও করেনি।

কিন্তু পানিয়া ঝরনার ধারে করিটুকির দিকে যারপরনাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। করিটুকিকে দেখে তার যেন চোখের পলক পরতে চাইছিল না। তার শরীরেও কেমন একটা শিহরণ জাগায়। এ শিহরণ কীসের, সে বুঝতে পারে না। এভাবে কিছুক্ষণ কাটে। প্রকৃতিতে জ্যোৎস্নায় আরও সয়লাব হয়ে যায়। নদীর জলে মাছের নৃত্য আরও বেড়ে যায়। রাতের স্তব্ধতা নেমে আসে চারিদিক।

মুগ্ধতা একটু কাটতেই পানিয়া পেছন দিক থেকে করিটুকির দিকে এগিয়ে যায়। ঘাড়ের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে ডেকে ওঠে, কিয়া অরা!

পেছনে কারও উপস্থিতি দেখে করিটুকি প্রথমে চমকে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণই যোদ্ধা করিটুকি ত্বরিত ঘুরে দাঁড়িয়ে পানিয়ার হাত মুচড়ে ধরে। কিন্তু চাঁদের ফকফকা আলোতে পানিয়াকে দেখামাত্রই সে অবাক-বিস্ময়ে তাকিয়ে হাত ছেড়ে দেয়। সে যেন তার চোখকে বিশ্বাস করাতে পারে না। তার সামনে এক অসম্ভব রূপবতী কন্যা এসে এভাবে দাঁড়াবে সে কল্পনায়ও আনতে পারিনি। সে কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু পরক্ষণ বিমূঢ়তা কাটিয়ে সে পানিয়াকে ভালো করে দেখে। জলে ভেজা শরীর। চাঁদের আলোতে ভেজা চুল ও চোখ চকচক করছে।

করিটুকি পানিয়ার কথার জবাবে বলে ওঠে, তিনা কই-ই!

নিঝুম রাত ও জ্যোৎস্নার আলোর মায়াবী আবহে করিটুকি প্রথম দেখাতেই পানিয়াকে ভালোবেসে ফেলে। সে তখনই জানতে পারে, পানিয়া জলের দেবতার কন্যা।

তারপর থেকে প্রতিটা ভরাট জ্যোৎস্নার রাতে করিটুকি ও পানিয়া মিলিত হতে শুরু করে। একরাতে জ্যোৎস্না ও চাঁদকে সাক্ষী রেখে তারা দুজন বিয়ে করে ফেলে।

ঝরনার ধারেই করিটুকি একটা ঘর বানায়। সেই ঘরে ওরা ভালোবাসার সংসার পাতে। এভাবে ওদের দিনগুলো চমৎকার একটা স্বপ্নের মতোই কাটতে শুরু করে। কিন্তু পানিয়াকে নিয়ে করিটুকির একটা সমস্যা হয়। পানিয়া সমুদ্রের কন্যা। সমুদ্রের অনেক নিয়মকানুনই তাকে মানতে হয়। তাই সে শুধু ভরাট জ্যোৎস্নার রাতেই আসতে পারে। বাকি দিনগুলো তাকে সমুদ্রে কাটাতে হয়।

এরই মধ্যে ওদের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু পুত্রের মাথায় একটাও চুল নেই। তাই করিটুকি তার ছেলের নাম রাখে মুড়মুড়। যার অর্থ চুলহীন মানুষ।

পানিয়া শুধুমাত্র ভরাট জ্যোৎস্নার রাতে সমুদ্র থেকে ডাঙায় উঠে এসে করিটুকি ও সন্তান মুড়মুড়ের সান্নিধ্য লাভ করলেও মুড়মুড় কিন্তু তার বাবার কাছেই থেকে যায়।

এভাবে মাস যায়, বছর যায়। একটা যুগও পেরিয়ে যায়। কিন্তু শুধুমাত্র ভরাট জ্যোৎস্নার রাতে মিলিত হওয়া এবং বাকি দিনগুলো পানিয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতে গিয়ে করিটুকি এক সময় হাঁপিয়ে ওঠে। একদিন করিটুকির ভেতর দুরভিসন্ধির জন্ম নেয়। সে মনে মনে আশা করে, স্ত্রী পানিয়া ও ছেলে মুড়মুড়কে সে সারাক্ষণ পাশে রাখবে। তাই সে একদিন আহুরিরির বিশিষ্ট জ্যোতিষ ও জ্ঞানী গণক টুহাঙ্গা কৌমটুয়ার কাছে যায়।

টুহাঙ্গা কৌমুটুয়া বিস্তারিত শোনে। চাঁদ-সূর্য দেখে গণনা করে করিটুকিকে উপদেশ দেয়, সে যদি তার স্ত্রী পানিয়াকে সমুদ্রের কোনো মাছ ভালো রান্না করে ঘুমন্ত অবস্থায় খাওয়াতে পারে, তবে তার স্ত্রী চিরদিনের জন্য ডাঙায় থেকে যাবে। কারণ, সমুদ্র দেবতা বা মৎস্যকন্যাদের মাছ খাওয়া একেবারেই নিষিদ্ধ। আর কেউ যদি ভুল করে খেয়ে ফেলে, তাহলে সে চিরজীবনের জন্য সমুদ্র বসবাসে নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। প্রয়োজনে তাকে মেরে ফেলা হবে।

টুহাঙ্গা কৌমটুয়ার উপদেশ মতে করিটুকি একদিন সমুদ্র থেকে মাছ ধরে এনে বিকেল অব্ধি রান্না করে। কিন্তু তার মাছ রান্না মোটেও ভালো হয় না।

সন্ধ্যার পরপর এক জ্যোৎস্নার রাতে নিয়মমাফিক পানিয়া সমুদ্র থেকে উঠে আসে। সে রাতের জ্যোৎস্না মোটেও নির্মল ছিল না। বারবার চাঁদের মুখে কেন জানি খণ্ড খণ্ড কালি মেঘ এসে ভিড় করছিল। করিটুকি নিজ থেকেও কেমন জানি বিব্রতবোধ করছিল। কী এক অজানা আশঙ্কা তার ভেতর বারবার ভিড় করছিল।

রাত বাড়তেই পানিয়া ও মুড়মুড় ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু করিটুকির চোখ ঘুম নেই। যদিও সে ঘুমের ভান করে পানিয়ার পাশে শুয়ে থাকে। ঠিক মধ্যরাতে সে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে আলো জ্বালিয়ে গোপন স্থান থেকে মাছের পাতিলটা বের করে নিয়ে আসে।

পানিয়া তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চাঁদের মুখের মেঘটা তখন খানিকটা দূরে। জানালা গলা চাঁদের আলো এসে সরাসরি তার মুখে এসে পড়ছিল। কী মায়াবী সুন্দর চেহারা! যেন চাঁদের আলোকে হার মানাচ্ছিল।

করিটুকি ঘুমন্ত স্ত্রীর মায়াবী চেহারার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বেশ সন্তর্পণে মাছের পাতিল থেকে কাঠের চামচে একটুকরো মাছ নিয়ে পানিয়ার মুখের কাছে নিয়ে আসে। তারপর সে আস্তে করে পানিয়ার মুখ হা করে মাছের টুকরোটা ঢালতে যায়। ঠিক তখনই জানালার পাশের ছোট্ট একটা গাছের ডাল থেকে রুরু বা প্যাঁচা কর্কশ স্বরে ডেকে ওঠে।

আসলে রুরু বা প্যাঁচাটা ছিল সমুদ্র দেবতার ছদ্মবেশী গুপ্তচর। সমুদ্র দেবতা টেঙ্গারোয়া মেয়ে পানিয়াকে চোখে চোখে রাখার জন্য সেই রুরু প্যাঁচাটাকে ডাঙায় পাঠিয়েছিল।

এমনিতেই রান্না মাছের গন্ধ। তার ওপর প্যাঁচার কর্কশ ডাক। পানিয়ার হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙতেই সে প্রথমে রান্না মাছের গন্ধে নাক ছিটকায়। কিন্তু চোখ কচলে যখন সে দেখে, তার প্রিয়তম স্বামী কাঠের চামচে রান্না করা মাছের টুকরো তার মুখে ঢালতে ব্যস্ত। তখন সে লাফিয়ে উঠে বিছানার একপাশে চলে যায়। পুরো পরিস্থিতিটা বুঝতে তার এক মুহূর্তও সময় লাগে না। সে চোখ বড় করে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য চোখে কতক্ষণ স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
তারপর পানিয়া আর দেরি করে না। বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে ছেলে মুড়মুড়কে কোলে তুলে নিয়ে দৌড়ে ঘর ছেড়ে ঝরনার ধারে চলে আসে। নদীতে তখন জোয়ারের টান। চারদিকে ভরাট জ্যোৎস্না যেন গলে গলে পড়ছিল। রাত পাখিরা সমস্বরে ডেকে ওঠে। নদীর জল থেকে স্বজাতি কেউ একজন তাকে আহ্বান জানায়, চলে আয় পানিয়া। চলে আয়। মানবজাতি বেইমান, মিথ্যাবাদী ও চতুর!

পানিয়া তৎক্ষণাৎ নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জোয়ারের টানে মুহূর্তেই সে ছেলে মুড়মুড়কে নিয়ে সাঁতরে সমুদ্রের জলে এসে পড়ে।

ওদিকে করিটুকির বিদীর্ণ হাহাকারে রাতের স্তব্ধতা থেমে যায়। তৎক্ষণাৎ সে বুঝতে পারে, সে মারাত্মক একটা ভুল করে ফেলেছে। সে করুণ আর্তনাদে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করে, পানিয়া! পা-নি-ইয়া!

চিৎকারটা ভারী হওয়ার আগেই করিটুকি দৌড়ে ঝরনা এবং নদীর সংযোগস্থলে চলে আসে। পানিয়াকে অনুসরণ করে নদীতে অনেকক্ষণ সাঁতার কাটে। কিন্তু পানিয়া জলের কন্যা। করিটুকি তার সঙ্গে সাঁতার কেটে পারবে কেন? পানিয়া তার ছেলে মুড়মুড় নিয়ে এক সময় গভীর সমুদ্রের তলদেশে চলে যায়।

এদিকে করিটুকি তখন সমুদ্রের জল দেখে। ঢেউয়ের পর ঢেউ দেখে। বিস্তীর্ণ জ্যোৎস্না দেখে। কিন্তু কোথাও তার স্ত্রী ও সন্তানের অস্তিত্ব খুঁজে পায় না।

পানিয়া সেই যে সমুদ্রে চলে যায়, তারপর সে আর কোনো দিন করিটুকির কাছে ফিরে আসেনি। এমনকি ছেলে মুড়মুড়ও তার বাবার কাছে ফিরে আসেনি।

করিটুকি তারপর অনেক দিন বেঁচেছিল। সে পরে আর কোনো দিন বিয়ে করেনি। এমনকি, বৈষয়িক-অবৈষয়িক সমস্ত কিছু থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। সে ছিল আহুরিরি সর্দারের একমাত্র ছেলে। বংশক্রমেই সেই সর্দার হতো। কিন্তু সে এর কিছুই হয়নি। সে সমুদ্রের পাড়ে সে একটা ছনের ঘর বানিয়ে সেখানে বসবাস করতে শুরু করে।

তারপর থেকে প্রতিটা ভরাট জ্যোৎস্নার রাতে সমুদ্রের ভরাট জোয়ারের দিকে তাকিয়ে করিটুকি সেই ছনের ঘরটায় পানিয়ার প্রতীক্ষায় বসে থাকত। সবকিছু হারিয়েও সে একটা আশা নিয়ে বসেছিল, একদিন হয়তো পানিয়া তার ভালোবাসার টানে ফিরে আসবে। সঙ্গে করে তাদের ছেলে মুড়মুড়কে নিয়ে আসবে। কিন্তু পানিয়ার আর ফিরে আসেনি।

একদিন করিটুকি সমুদ্রের ধারের সেই ছনের ঘরটায় মারা যায়।

পানিয়া অব দ্য রিফের কাছে এলে রাকিবের বরাবরই মনে হয়, পানিয়া যেন এক জীবন্ত মানুষ হয়েই বসে আছে।

রাকিব ভাবল, হয়তো অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের যুগে মাউরি আদিবাসীদের এই মিথ বা পানিয়া-করিটুকির ভালোবাসা মানুষজনের কাছে গাঁজাখুরি গল্প মনে হবে। এমনকি পানিয়ার মূর্তিটাও। কিন্তু যারা ভালোবাসার মানুষ তারা ঠিকই পানিয়া-করিটুকির ভালোবাসা হৃদয়ে ধারণ করবে।
মাউরি আদিবাসীরা পানিয়াকে তাদের প্রেমের দেবী হিসেবে বিশ্বাস করে। কোনো জ্যোৎস্নার রাতে সমুদ্রের পাড়ে ওরা আজও পানিয়াকে দেখতে পায় বলে দাবি করে। পানিয়া নাকি ভরাট জ্যোৎস্নার রাতে ডাঙায় উঠে আসে। সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে থাকে। এমনকি দূর থেকে ওরা অদৃশ্য করিটুকির গানও নাকি শোনে।

শুধুমাত্র মাউরি আদিবাসীরাই নয়, অনেক জেলে বা মৎস্যশিকারিরাও নাকি ভরাট জ্যোৎস্নার রাতে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে তাদের ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বসে দূর থেকে সমুদ্রের তীরে পানিয়াকে বসে থাকতে দেখেছে। পানিয়া নাকি হাঁটু গেড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে কারও ডাক শোনার ভঙ্গি করে বসে থাকে। ভঙ্গিটা এমন, সে যেন করিটুকির ডাক শুনছে। পরদিন সকালে সেখানে পানিয়ার সেই বসার স্থানে অসংখ্য ঝিনুকের খোসা পড়ে থাকতে দেখা যায়। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1558194