কালো মেয়ের উপাখ্যান

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কালো গায়ের রঙা মানুষের প্রতি বরাবরই আমার একটা দুর্বলতা ছিল ও আছে। আমার নিজেরও ইচ্ছে ছিল কোনো এক কালো ছেলেকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়া। অবশ্য আমার এমন সিদ্ধান্তে আব্বা ও মায়ের ছিল ঘোর আপত্তি। অথচ মজার বিষয় হলো তাদের দুজনেরর আব্বাই অমাবস্যা রাতের অন্ধকারের মতো কালো ছিলেন। এই কালো হওয়ার দোষে যে তারা তাদের আব্বাকে আব্বা বলে ডাকেননি বা ভালোবাসেননি এমনটা কিন্তু নয়। বরং উল্টোটা করেছেন, ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছে। তবু আমার বেলায় ছিল তাদের নিষেধাজ্ঞা, তাই তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ না ঘটিয়ে উজ্জ্বল বর্ণের ফারুক হোসেনের গলায় ভালোবেসেই মালা পরিয়েছিলাম। ফারুক হোসেন মানুষ হিসেবে খুবই ভালো। তাঁকে নিয়ে বলার আছে অনেক কিছু। যেহেতু, আজকের লেখাটা ফারুক হোসেনকে নিয়ে নয়, তাই এর বেশি কিছু বলতে চাই না।

এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। পয়লা বৈশাখের বিকেলবেলায় অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের অভিভাবক সমতুল্য এমি আপু আর রিপন ভাইয়ার হঠাৎ আহ্বানে সাড়া দিয়ে, আমি ও আমার মেয়ে রওনা হলাম সিডনি অলিম্পিক পার্কের বৈশাখী মেলায়। মেলায় গিয়ে মনে হলো এ যেন এক টুকরো বাংলাদেশ। বিদেশের মাটিতে একসঙ্গে এত বাঙালি দেখে বাংলাদেশ অনুভব, সত্যি অন্যরকম অনুভূতি। এ ছাড়া, বাঙালি চাহিদার সকল সামগ্রীর সমাবেশ লক্ষ্য করলাম এই মেলায়। বাহারি রকমের খাবারের দোকান থেকে শুরু করে শাড়ি, চুড়ি, গয়নাগাটি, বই, হাওয়াই মিঠাই, নাগরদোলা কী নেই মেলায়। একেই বলে বাঙালি ঐতিহ্য, স্বল্প পরিসরে সকল কিছুর সন্নিবেশ। অথচ, এত কিছু দেখে কোথাও আমার চোখ আটকাল না, হঠাৎ চোখ আটকে গেল গ্যালারিতে বসা এক কালো মেয়ের দিকে।

সাদা জমিন কালো পাড়ের শাড়িতে এত অল্প সাজেও যে কাউকে নিখুঁত সুন্দর লাগতে পারে সেটা একমাত্র যার দেখার মতো চোখ আছে সেই দেখতে পাবেন অন্যথায় নয়। এমন সৌন্দর্যের বর্ণনা রবিঠাকুর ও শরৎ বাবু তাদের অনেক লেখনীতে হাজারো উপমার মাধ্যমে প্রকাশ করে গেছেন বইয়ে পড়েছি। তাই এ নিয়ে আমি আর কিছু বলতে চাই না। আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে ওই মুহূর্তে শুধু রবীন্দ্রনাথের দুটো লাইন মনে এল—‘কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।’ মনে হলো, রবিঠাকুর যথার্থই বলে গেছেন।

সত্যিই তো মেয়েটির গায়ের বর্ণের কারণেই সে এত সুন্দরী। নিজেকেই নিজে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, আল্লাহ কি কালো মেয়েদের মুখশ্রীতে দুনিয়ার সকল মায়া-মোহ ঢেলে দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন? তা না হলে এদের চেহারায় চুম্বকীয় শক্তির মতো ভালোবেসে কাছে পাওয়ার এমন আকর্ষণবোধ জাগে কেন! এ জন্য নিশ্চয় গায়ের গৌড় বর্ণই দায়ী। এ মেয়েটিও হয়তো সে দলের একজন লাস্যময়ী লাবণ্যলতা। যে কারণে আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। মেয়েটির বয়স বত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে হবে। দেখলাম, গভীর মনোযোগ দিয়ে সে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখছে। সে দেখছে অনুষ্ঠান আর আমি দেখছি তাঁকে। তাঁর চাহনি, বসার ভঙ্গিমা, ঠোঁটের কোণের হাসি সবকিছুতে এত মায়া, এত সারল্য ছিল, যা দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। পাঠক আমাকে ভুল বোঝার আগেই বলে নেই, হ্যাঁ, আমি মেয়ে আর আমার এই দেখার অন্য কোনো মানে নেই। আমি বরাবরই সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে কার্পণ্যবোধ করি না। সে সৌন্দর্য কালো, শ্যামা কিংবা গোলাপ রাঙা নারীকুলের হোক আর পুরুষকুলের।
বলছিলাম মেয়েটির কথা। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল মেয়েটিকে বলে আসি. ‘তুমি খুব সুন্দর, তুমি কী জান, ঠিক এই মুহূর্তে তোমাকে নিয়ে আমি রবিঠাকুরের কৃষ্ণকলির মতো না হলেও আমার মতো করে একটা অনবদ্য কবিতা লিখে ফেলতে পারব।’

কাজল বরণ মেয়েগো তুমি, দিঘল কালো চুল,
তোমার রূপের হাতছানিতে পাগল মানবকুল।
এমন রূপটা দেখার দোষে
যদি, কেউ হয়ে যায় দোষী,
কন্যা, দোষ দেব না তাকে আমি,
তুমিই বরং ঘরে থাকো, থাকো অহর্নিশি।

লেখিকা
লেখিকা

অনেকেই আছেন অযাচিত হয়ে কথা বলা পছন্দ করেন না। তাই আড়ষ্টতা, জড়তায় দূর থেকেই দেখলাম মেয়েটিকে। তাঁকে আমার কিছুই বলা হলো না। আমার ভাবনার অবসান ঘটাতে ততক্ষণে দেখতে নয়নাভিরাম ফরসা, মেয়েটির বর হাতে একগাদা খাবার প্যাকেট নিয়ে এসে পাশে বসল। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মেয়েটির মুখে অতি আহ্লাদে খাবার তুলেও দিল। দেখেই বোঝা গেল ওদের ভালোবাসার গভীরতা। আমি মন থেকে মানি, সত্যিকারের ভালোবাসা বোঝাতে মুখে ঢাকঢোল পেটাতে হয় না, টুকরো টুকরো এমন ঘটনাই যথেষ্ট। ওরা জানতেও পারল না, ওদের অজান্তেই ওরা আমাকে কত সুন্দর একটা মুহূর্ত উপহার দিল।
অবশ্য মেয়েটিকে দেখে হুট করেই আমার মাথায় আর একটা চিন্তা জেঁকে বসেছিল। সেটা হলো, কেন আমাদের দেশে পাত্রপাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পছন্দ ব্যতিরেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উভয় পরিবারের সদস্যদের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে তন্ন তন্ন করে ফরসা রঙের ছেলেমেয়ে খুঁজে বের করা। তাদের এমন ভাব যেন কালো রঙের ছেলেমেয়েদের বিয়ে হওয়ার দরকার নেই। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয়, আমি যদি সবার মনের মধ্যে ঢুকে এমন নেতিবাচক মনোভাবের ইতি ঘটিয়ে আসতে পারতাম!
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পারি না, আমি অনেক কিছুই পারি না। পারি না বলেই হয়তো আজ আমাকে আমার মতো করে কালো মেয়ের উপাখ্যান লিখতে হলো।

লাভলী ইয়াসমিন: গজফোর্ড, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া।