দিঘল মেঘের দেশে-বারো

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ব্লাফ হিলের চূড়াতে ঘুরতে এসেই রাকিব প্রথম এমেন্ডার কাছ থেকে প্রথম প্রেমের প্রস্তাব পায়। তারা দুজন বিয়ের সিদ্ধান্তও নেয় এক গোধূলি লগ্নে-এই ব্লাফ হিলে। সাদিয়ার প্রথম জন্মদিনে সারাটা দিন এই ব্লাফ হিলেই কাটিয়েছিল। সিরাজ যখন বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে বেইমানি করে এমেন্ডাকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়, সেদিন বিকেলে এই ব্লাফ হিলের চূড়ায় বসে সে অনেক কেঁদেছে। তার এই কান্না সেদিন কেউ দেখেনি। সাদিয়া মারা যাওয়ার পর তাকে কারামু রোডের সমাধিতে দাফন করে রাকিব সরাসরি এই ব্লাফ হিলের চূড়ায় উঠে এসেছিল। সেদিন কী কান্নাটাই না সে কেঁদেছিল!

আজ অবশ্য রাকিব ব্লাফ হিলের চূড়ায় বেশিক্ষণ বসেনি। সে ভেবেছিল, এখানে বসে আজ প্রশান্ত মহাসাগরের ভেতর সূর্যটা ডোবার দৃশ্য দেখবে। প্রশান্ত মহাসাগরের ব্লাফ হিলের ঠিক পাদদেশের কাছে বলে এখানে বসে সূর্যাস্ত দেখার অনুভূতিই আলাদা। আকাশের সমস্ত লালিমাকে যেন ব্লাফ হিলের চূড়ায় বসে হাত দিয়ে ধরা যায়। চারদিকে একধরনের গোলাপি আভা ফুটে ওঠে।

কিন্তু নদীর কথা মনে পড়তেই রাকিব গাড়ি নিয়ে চূড়ায় উঠে বেশিক্ষণ না বসে আবার নেমে গেল। হেস্টিংস শহরের উদ্দেশে যেতে যেতে নদীকে নিয়ে ভাবতে বসল। নদী কী সত্যি তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে? নয়তো সে তার সঙ্গে এত দূরে এই হকস বে অঞ্চলে আসার কথা বলেছিল কেন? কোন বিশ্বাসে?

রাকিব আরও ভাবল, তার একটা কবি মন আছে। মেয়েদের মন নিয়ে তাদের কাজ। কবিরা বুঝতে পারেন, একটা মেয়ে কখন তাদের ভালোবাসে বা কখন বাসে না। যদিও রাকিব জানে, নদী ও তার পথ দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার নিজের পথটা অনেকটাই নির্মোহ, দিকহীন ও প্রকরণহীন। আর নদী ক্রমাগত ওপরে ওঠার সিঁড়ি ডিঙাচ্ছে। নদীর আশা ও নির্ভরতা অনেক। নদীর ভেতর আরেকজন মানুষ অহরহ বসবাস করে। তিনি তার মা।

নদীকে যে রাকিবের ভালো লাগে না, তা নয়। বরং তাকে সকাল সন্ধ্যায় ভালোবাসতেই ইচ্ছে করে। তার এই নিঃসঙ্গ জীবনটা সত্যি একজন সঙ্গী চায়। নদীর মতো সঙ্গী। কিন্তু সে নিজে তো একজন পোড় খাওয়া মানুষ। আজীবন পোড় খেতে খেতে এ পর্যন্ত উঠে এসেছে। একসময় তো রাকিব নির্জীবই হয়ে গিয়েছিল। আজকাল তাই কাউকে কাছে পেতে তার ভয় হয়। সে ভালোবাসতে ভয় পায়।
ব্লাফ হিল থেকে নেমে পুরোনো হাইওয়ে টু কারামু রোড ধরে রাকিব নেপিয়ার ছেড়ে হেস্টিংসের অভিমুখে যাচ্ছে। রিনেই ভাবির বাসায় যাওয়ার পথটা এখান দিয়েই সহজ। সরাসরি কারামু রোড দিয়ে গিয়ে ওমাহো রোডে মোড় নিলেই হিরিটাঙ্গা স্ট্রিট। তারপর বরিস ফোর্ড রোড। বরিস ফোর্ড রোড থেকে বামে গেলেই রডনি স্ট্রিট। রডনি স্ট্রিটের ছয় নম্বর বাসাতেই রিনেই ভাবি থাকেন।
এ পথের সবটাই রাকিবের চেনা। পুরো পাঁচটা বছর সে এই হেস্টিংসে থেকে গেছে। হেস্টিংসে এসে প্রথম সে এই রিনেই ভাবির বাসাতেই উঠেছিল। পরে এমেন্ডাকে বিয়ে করে আলাদা বাসা নেয়।

পুরোনো হাইওয়ে টু ধরে যেতে যেতে রাকিব দেখল, রাস্তার দুপাশে অনেক আপেল অরচার্ড গড়ে তোলা হয়েছে। আগে এ পাশটায় এত আপেল অরচার্ড ছিল না। আঙুরের বাগান ছিল। হয়তো আঙুরের বাগানগুলো তুলে দিয়ে আপেল অরচার্ড করা হয়েছে।
দুই পাশের দিঘল বিস্তৃত আপেল গাছের সারির মধ্যে দিয়ে পথটাকে রাকিবের কাছে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। বিকেলের কাঁচাসোনা রোদ যেন সরু রেখা করে রাস্তার ওপর এসে পড়ছে। প্রকৃতির সর্বত্র নরম উষ্ণতা। গ্রীষ্মের দখিন-দুয়ারি বাতাস সবুজের ওপর নরম স্পর্শ দিচ্ছে। আকাশটা বেশ পরিষ্কার নীল।

রাকিব জানে, হেস্টিংস শহরকে বলে হয় দ্য ফ্রুট বল অব নিউজিল্যান্ড। হেস্টিংসের আবাসিক এলাকা শেষ হতেই শহরটার চারপাশে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য ফলের বাগান। আপেল, এপ্রিকট, প্লাম, পিয়ার্স, ম্যান্ডারিন ও পার্সিমন কত জাতের ফলের বাগান! আর আঙুরের বাগান তো মাইলের পর মাইল।

রাকিব কারামু রোড ধরে হেস্টিংস শহরে ঢুকল। সেই চির চেনা সেন্ট অবেন স্ট্রিট, মেথুন স্ট্রিট ও সাউথল্যান্ড স্ট্রিট। তারপরই রডনি স্ট্রিট।

রডনি স্ট্রিটে এসে রিনেই ভাবির বাসার ড্রাইভওয়েতে উঠতেই রাকিব দেখল, রিনেই ভাবি বাসার সামনেই। তিনি বাসার সামনের বাগানে গোলাপের ছোট ছোট ডাল কাটছেন। সঙ্গে খুব সম্ভব তার ছোট মেয়ে কোহিনূর।

গাড়ি দেখামাত্রই রিনেই ভাবি এগিয়ে এলেন। কোহিনুর যথাস্থানে দাঁড়িয়ে রইল।

রাকিব গাড়ি থেকে নামতেই রিনেই ভাবি তার দিকে এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ?

রাকিব মৃদু হেসে বলল, ভালো। আপনারা?

: সেই একই রকম। মাঝখান থেকে সময় যাচ্ছে আর বয়স বাড়ছে।

: হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। বয়সটা কী আর থেমে থাকবে?

এরই মধ্যে কোহিনূর রিইে ভাবির পেছনে এসে দাঁড়াল। রিনেই ভাবি তাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, কোহি, চিনতে পেরেছিস? তোর রাকিব আংকেল।

কোহিনূর যেন কিছুটা লজ্জা পেল। বলল, হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি।

রাকিব বলল, তুমি তো বেশ লম্বা হয়ে উঠেছ।

কোহিনূর আবারও খানিকটা লজ্জা পেল।

রিনেই ভাবি বললেন, হ্যাঁ, ওই তো, সে তার বাবার মতো লম্বা হবে।

কোহিনুরের বাবা মানে, হাসানুজ্জামান হাসান। রাকিবের রিনেই ভাবিকে হাসানুজ্জামান হাসানের কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু কী ভেবে সে কথাটা চেপে গেল। ভাবল, পরে সময় ও সুযোগ মতো জিজ্ঞেস করবে।

রাকিব গাড়ির পেছন খুলে তার ছোট্ট লাগেজটা বের করতেই রিনেই ভাবি কোহিনূরকে বললেন, কোহি, নেতো, তোর আংকেলের কাছ থেকে লাগেজটা হাতে নে। ¾

কোহিনূর বিনা বাক্যেই রাকিবের কাছ থেকে লাগজেটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়াল।

রাকিব বলল, আহা, থাক না। মাত্রই তো ছোট্ট একটা লাগেজ।

রিনেই ভাবি ব্যস্ত হয়ে বললেন, না না রাকিব, তুমি ওর হাতে দাও।

রাকিব তার লাগেজটা কোহিনূরের হাতে দিল।

কোহিনূর লাগেজটা নিয়ে সামনে হাঁটছে। রিনেই ভাবি ও রাকিব পেছনে।

কোহিনূরের দিকে তাকিয়ে রাকিবের ভালো লাগল। ভাবল, দীর্ঘদিন কোনো বাঙালির সঙ্গে না থেকেও রিনেই ভাবি কেমন বাঙালি সংস্কৃতিটা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। মেয়েকে দিয়ে ঠিকই লাগেজটা বয়ে নিচ্ছেন। হাসানুজ্জামান হাসান তো রিনেই ভাবিকে ছেড়ে চলে গেছেন কত বছর আগে।

ড্রাইভওয়ে ছেড়ে সদর দরজা দিয়ে বাসায় ঢুকতে ঢুকতে রাকিব জিজ্ঞেস করল, ভাবি, পুতুল কোথায়?

রিনেই ভাবি বললেন, ও, পুতুল তো কাজে। সে কাউন্টডাউন সুপার মার্কেটে চেক আউটে কাজ করে। তুমিও তো এক সময় সেই সুপার মার্কেটে কাজ করতে।

: সিটি সেন্টারের পাশের সেই কাউন্ট ডাউনটা?

: হ্যাঁ, সেটাই।

: সে কী চেক আউটে কাজ করে? নাকি ভেতরে?

: চেক আউটে।

: এমেন্ডাও তো এক সময় চেক আউটে কাজ করত।

রিনেই ভাবি হাসলেন। তবে মলিন হাসি। বললেন, এমেন্ডা! তার সঙ্গে তো তোমার আগামীকালই দেখা হবে।

রাকিব মাথা ঝাঁকাল।

রিনেই ভাবির বাসায় রাকিবকে সেই পুরোনো রুমটাই দেওয়া হলো। যে রুমটাতে রাকিব প্রথম হেস্টিংসে এসে থেকেছিল। অনেকগুলো বছর! রুমটা অবশ্য আগের মতো নেই। আগে রুমটার রং ছিল ছাই রঙের। এখন সবুজ রং করা হয়েছে। আসবাবপত্রগুলোও পরিবর্তন করা হয়েছে।

রাকিব মৃদু হেসে বলল, আমার আগেরই সেই রুমটা, তাই না ভাবি?

রিনেই বললেন, হ্যাঁ, এ রুমটাতে এখন কোহি থাকে।

রাকিব স্মিত হেসে বলল, তাই!

রিনেই ভাবি হঠাৎ ঘড়ি দেখে ব্যস্ত হয়ে বললেন, রাকিব, তুমি ফ্রেস হও। আচ্ছা, তুমি কি এখন ডিনার করে ফেলবে?

রাকিবও ঘড়ির দিকে তাকাল। দেখল, প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। এখনো সূর্য ডুবতে ঘণ্টাখানেক বাকি। যদিও এ দেশিরা আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে ডিনার করে ফেলে।

রাকিব বলল, এখন ডিনার করতে ইচ্ছে করছে না ভাবি। পুতুল কাজ থেকে কয়টার সময় আসে? সে আসুক, তারপর ডিনার করি?

রিনেই ভাবি মৃদু হেসে বললেন, পুতুলের অপেক্ষা করে লাভ নেই রাকিব। আজ শনিবার। কাজ থেকে ফিরে হয়তো কিছু না খেয়েই নাইট ক্লাবে চলে যাবে। তুমি এখন ডিনার করতে চাচ্ছ না, অসুবিধা নেই। চা খাবে তো?

: চা না। কফি থাকলে কফি দেন। ব্ল্যাক কফি।

: ব্ল্যাক কফি খাওয়া শিখেছ কবে থেকে?

: হা-হা-হা। অনেক কিছুই খাওয়া শিখে গেছি।

: মদ-টদ খাও না তো?

: ওগুলো খাই না। অফিসের কোনো পার্টি বা অনুষ্ঠান থাকলে কালেভদ্রে খাই। তবে নেশা নেই।

: তাই ভালো। তোমার ভাইকেও শিখাতে পারিনি। এখন আমার বড় মেয়েটা মদ-নেশা ধরেছে।

: কে, পুতুল?

: হ্যাঁ, আর কে?

রাকিব মাথা ঝাঁকাল। কিছু বলল না। রিনেই ভাবি এ দেশি হয়েও কখনো মদ খাননি। এ দেশি অনেকের মতো অনাচারে মত্ত থাকেন না। তাকে দেখে মাঝেমধ্যে মনে হয়, তিনি যেন সত্যিকারের বাঙালি বধূ হওয়ার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বাঙালি বরটাই তাকে চিনতে পারেনি।

রিনেই ভাবি নিজ থেকেই বললেন, আচ্ছা, আমি কফিই বানিয়ে দিচ্ছি। কফির সঙ্গে কি বিস্কুট বা কিছু একটা খাবে? তুমি আসবে বলে একটা ইন্ডিয়ান দোকান থেকে চানাচুর এনে রেখেছি। কফির সঙ্গে চানাচুর দেই?

রাকিব মৃদু হেসে বলল, এখন ওসবের কিছুই খাব না। শুধু কফি দেন।

রিনেই ভাবি সায় দিয়ে কিচেনে চলে গেলেন। পেছনে পেছনে কোহিনূরও চলে গেল।

রাকিব বাইরের কাপড়চোপড় ছেড়ে একটা টি-শার্ট ও থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ল। বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় আধা শোয়া হয়ে মোবাইলে ফেসবুক দেখতে শুরু করল। ফেসবুকে নিউজ ফিডে নদী একটা পোস্ট শেয়ার করেছে। তেমন কিছু নয়, তত্ত্বমূলক একটা পোস্ট।

রাকিব অবশ্য ফেসবুকে বেশি সময় কাটায় না। নদীর মধ্যেও সে এই অভ্যাসটা দেখেছে। ফেসবুকে সময় বেশি কাটায় না। কখনো কখনো সময় কাটানোর জন্য ফেসবুকে ঢোকে।

রাকিব কোনো কিছু না ভেবেই ফেসবুক বন্ধ করে দিল। ঠিক তখনই রিনেই ভাবি কফি নিয়ে রুমে ঢুকলেন। কফির কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, রাকিব, তুমি কফি খাও। আমি দশ মিনিটের জন্য বাইরে যাচ্ছি। এই যাব আর আসব। পুতুলকে কাজ থেকে পিক করতে হবে।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, পুতুলের কাজ শেষ হবে কখন?

রিনেই ভাবি বললেন, এই নয়টায়। সাইন আউট করে বের হতে হতে নয়টা পাঁচ বাজে।

: পুতুল গাড়ি চালানো শেখে নাই?

: আর বলো না। শিখেছে। একটা গাড়িও কিনেছিল। গাড়িটাই যত নষ্টের মূল হয়ে দাঁড়ায়।

: কেন, কী হয়েছে?

: এই আর কী, মাস দু-এক আগে ড্রিংক অ্যান্ড ড্রাইভে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আট মাসের জন্য লাইসেন্স হারিয়েছে। মাত্র দুই মাস গেছে। আরও ছয় মাস গাড়ি চালাতে পারবে না। এমনিতে রেস্ট্রিকটেড লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালাত। তার ওপর এই ঝামেলা। এখন দেখ, আমার একটা কাজ বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন প্রতিদিন তাকে কাজে নামিয়ে দিয়ে আসতে হয়। কাজের শেষে তাকে আবার পিক করে নিয়ে আসতে হয়।

রাকিব বলল, ও, তাই!

রিনেই ভাবি যেতে যেতে বললেন, তা আর কী বলি? তুমি কফি খাও। আমি দশ মিনিটের মধ্যেই আসছি। কাছেই তো।

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল। মুখে কিছু বলল না।

রিনেই ভাবি চলে যেতেই রাকিব কফির কাপ হাতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। রুমের জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল। জানালার ডান পাশেই বাসার পেছনে যাওয়ার একটা দরজা। দরজাটা ভেজানো।

রাকিব জানালা থেকে সরে এসে দরজাটা খুলল।

রাকিব যখন এ বাসায় ছিল তখন দরজার সামনে ছোট্ট সিঁড়ি বাদে আর তেমন কিছু ছিল না। লনের পাশে এলোমেলো কিছু সিলভারবিট সবজি বাগান ছিল। কিন্তু আজ দরজা খুলে সে দেখল, সেই সিলভারবিট সবজি বাগানটা আর নেই। আর দরজার সামনে ছোট্ট সিঁড়ির বদলে এখন বেশ প্রশস্ত একটা ডেক বানানো হয়েছে।

রাকিব কফি কাপ হাতে ডেকে এসে দাঁড়াল।

রিনেই ভাবির বাসাটা রডনি স্ট্রিটের বেশ ওপরে বলে ডেকে দাঁড়িয়ে বেশ খানিকটা দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। মেথুন স্ট্রিট, চার্লস স্ট্রিট, সাউথ ল্যান্ড রোড। সেন্ট অবেন স্ট্রিটেরও খানিকটা এই ডেক থেকে দেখা যাচ্ছে। রাকিব এমেন্ডাকে নিয়ে সেই সেন্ট অবেন স্ট্রিটেই থাকত।

এদিকে বাইরে এখন পড়ন্ত বিকেল। বিকেলের তির্যক রোদ হেলে পড়েছে ডেকের সর্বত্র। রডনি স্ট্রিট আবাসিক এলাকার ভেতর সবচেয়ে ছোট রাস্তা বলে গাড়ির আসা যাওয়া খুব কম। রাকিব কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে কখনো দূরে তাকাচ্ছে, কখনো কাছে।
কোহিনূর পেছন থেকে এসে জিজ্ঞেস করল, আংকেল, একটা চেয়ার এনে দেব?

রাকিব তাড়াতাড়ি বলল, না না কোহিনূর, আমার দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগছে। ডেকটা মনে হয় নতুন করা হয়েছে?

: হ্যাঁ, নতুন। মাস কয়েক আগে পুতুলের এক বন্ধু বানিয়ে দিয়েছে। ওর বন্ধু একজন বিল্ডার।

: তাই! ভালোই হয়েছে। তোমরা এই ডেকে মাঝে-মধ্যে বারবিকিউ করতে পারবে।

: আমরা এরই মধ্যে দুইবার বারবিকিউ করেছি।

: দারুণ! ¾ রাকিব হাসল।

কোহিনূরও স্মিত হাসল। কিছু বলল না।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায় লেখাপড়া কর?

: হেস্টিংস হাইস্কুলে।

: কোন গ্রেডে?

: নাইন।

: আর পুতুল?

: পুতুল তো আর লেখাপড়া করে না। বছর দুই আগে ছেড়ে দিয়েছে।

: কেন?

: তার লেখাপড়া করতে ভালো লাগে না, তাই।

: ও আচ্ছা।

: আংকেল, আপনার কিছু কি লাগবে?

: না, কিছু লাগবে না।

কোহিনূর মাথা ঝাঁকিয়ে ভেতরে চলে গেল।

রাকিব কোহিনূরের পথের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ভাবল,¾ সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ কত বড় হয়ে গেছে?

রাকিব যখন প্রথম কোহিনূরকে দেখে তখন তার বয়স ছিল চার কী সাড়ে চার বছর। সেই সাড়ে দশ বছর আগের ঘটনা। পুতুলের বয়স ছিল তখন নয় বছর। এখন পুতুল নিশ্চয়ই অনেক বড়? হয়তো এখন সে উনিশ-সাড়ে উনিশ বছরের পূর্ণাঙ্গ যুবতী।
রাকিবের মনে আছে, সে কোহিনূরকে কাঁধে তুলে ও পুতুলের হাত ধরে রডনি স্ট্রিট, মেথুন স্ট্রিট, চার্লস স্ট্রিট, সাউথল্যান্ড স্ট্রিট ও সেন্ট অবেন স্ট্রিট ধরে হাঁটত। পুতুল সারাক্ষণই স্টেক পাই খেতে চাইত। আর কোহিনূর চাইত আইসক্রিম।

রাকিব একটা ব্যাপার বুঝতে পারে না, এমন ফুটফুটে দুটো মেয়েকে রেখে হাসানুজ্জামান হাসান কীভাবে দূরে চলে গেলেন? রিনেই ভাবির কথা বাদই দেওয়া যায়। তিনি ইউরোপিয়ান সাদা। পাকিহা মহিলা। কোনো বাঙালি যদি তার বিদেশি স্ত্রীর সঙ্গে সংসার করতে না চায়, সে কোনো না কোনো একটা বাহানা বের করে চলে যায়। তার ফ্ল্যাটমেট আতিক, বর্তমানে বাংলাদেশে। এক বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করেছে। কোন এমপির ভাগনি না কী! সেই আতিক একসময় ভ্যাবিয়ান নামে এক ইউরোপিয়ান সাদা মেয়েকে এ দেশে নাইট ক্লাবে নাচতে গিয়ে পটিয়ে বিয়ে করেছিল। পরে নিবুজিল্যান্ডের পারমানেন্ট রেসিডেন্সি হওয়ার পর অযথাই তিন-চারবার ঝগড়া করে ভ্যাবিয়ানকে ছেড়ে চলে যায়। আর কখনো পিছে ফিরে তাকায়নি। সফিউল নামে আরেক বাঙালি ভদ্রলোক। যিনি হ্যালি নামে এ দেশি সাদা এক মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করছিলেন। বিয়ের পর হ্যালি নাম পরিবর্তন করে হালিমা হয়েছিল। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর হালিমা হিজাব করত। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। সাতটা বছর একসঙ্গে সংসার করেছিল। কিন্তু তারপরও সফিউল ভদ্রলোক একদিন বলা নেই কওয়া নেই উধাও।

আজ সেই হালিমা আবার হ্যালি হয়েছে। হিজাব ছেড়ে স্কার্ট বা মিনি স্কার্ট পরে। প্রতি উইকএন্ডে নাইট ক্লাবে যায়। আর প্রতিনিয়ত সে নিজেকে অভিশাপ দেয়। সফিউল ভদ্রলোককে অভিশাপ দেয়। কখনো কখনো বাংলাদেশকে অভিশাপ দিয়ে বসে।

রিনেই ভাবি অবশ্য সেই হ্যালির মতো নন। তিনি আজও কোনো বাঙালি পেলে নিজের লোক মনে করেন। যেকোনো ব্যাপারে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন। তিনি তার নামের পেছনে এখনো স্বামীর নাম হিসেবে হাসান ব্যবহার করেন। রিনেই পলিয়াস ন্যাথেলি হাসান।

রাকিব ভাবল, রিনেই ভাবি কী এখনো আশা করেন যে একদিন হাসান ভাই তার কাছে ফিরে আসবেন? কিংবা হাসান ভাইকে খুঁজে বের করে তিনি তার কাছে ফিরে আনবেন? একটা অপেক্ষা। দীর্ঘ অপেক্ষা।

রিনেই ভাবি তার মেয়েদের পিতৃত্বের পরিচয়ে তাদের নামের পেছনেও হাসান নামটা যুক্ত করেন। রাকিব বরাবরই দেখে আসছে, ইউরোপিয়ান সাদা মহিলা হয়েও রিনেই ভাবির মধ্যে বাড়তি কোনো অহংকার নেই। তিনি যেকোনো সংস্কৃতি, যেকোনো পরিস্থিতি ও যেকোনো সমাজে নিজেকে সুন্দর খাপ খাইয়ে নিতে পারতেন। তিনি মনেপ্রাণে চেষ্টা করতেন হাসানুজ্জামান হাসানকে সুখী করতে। তিনি নিজেও খ্রিষ্টান ধর্ম ছেড়ে মুসলমান হয়েছিলেন এই হাসানুজ্জামান হাসানের জন্যই। কিন্তু তারপরও হাসানুজ্জামান হাসান চলে গেছেন!

রাকিব ভেবে পেল না, হাসানুজ্জামান হাসান চলে গেলেন কেন? রিনেই ভাবি তো দোষ করার মতো এমন কোনো মহিলা নন? আর হাসানুজ্জামান হাসানও তো রিনেই ভাবিকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন? ভালোবেসে রিনেই ভাবিকে ডাকতেন-রুনা লায়লা।

যদিও রিনেই ভাবি কিছুটা মোটা ধাঁচের ছিলেন। কিন্তু মোটেও তিনি রুনা লায়লার মতো ছিলেন না। কিন্তু তবুও হাসানুজ্জামান হাসান ভালোবেসে এই নামে ডাকতেন।

রুনা লায়লার গান হাসানুজ্জামান হাসানের খুব পছন্দ ছিল। তিনি যখন রিনেই ভাবিকে রুনা লায়লা বলে ডাকতেন, তখন রিনেই ভাবি খুব লজ্জা পেতেন। পরে রিনেই ভাবি রুনা লায়লার গাওয়া দুই-তিনটা বাংলা গান শিখে নিয়েছিলেন। এই বৃষ্টি ভেজা রাতে, তুমি চলে যেও না, এই বৃষ্টি ভেজা রাতে!...পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম, বন্ধু ভাগ্য হইল না!

রাকিব ভাবল, রিনেই ভাবির সত্যি বন্ধু ভাগ্য হয়নি। নয়তো হাসানুজ্জামান হাসান চলে গেলেন কেন? ছোট সংসার। অদ্ভুত সুন্দর দুটো ছোট মেয়ে। আর সুন্দর একটা ঘর।

রাকিবের মনে আছে, তখন এমেন্ডার সঙ্গে তার সংসার জীবনের দ্বিতীয় বছর চলছিল। এক বিকেলে দুজন কাজ থেকে ফিরে রিনেই ভাবির ফোন পায়। ফোনের ওপাশে রিনেই ভাবির সে কী কান্না!

খবরটা খুব ছোট্ট ছিল। হাসানুজ্জামান হাসান নেই। তিনি অস্ট্রেলিয়া না কোথায় চলে গেছেন। হাসানুজ্জামান হাসানের এক বন্ধু ফোনে রিনেই ভাবিকে এই খবরটা দিয়েছিলেন।

খবরটা শুনে প্রথমে রাকিবের মোটেও বিশ্বাস হয়নি। এমেন্ডারও অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়েছিল। কিন্তু খবরটা সত্যিই ছিল। সেই হাসানুজ্জামান হাসান অস্ট্রেলিয়াতেই চলে গিয়েছিলেন। তারপর কোনো দিন আর তিনি পুতুল, কোহিনূর বা রিনেই ভাবির কোনো খবর নেননি।

পুতুল কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে রাকিব খেয়াল করেনি। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখল, পুতুল ডেকের একপাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। সেই পুতুল আর এই পুতুল এক নয়। বেশ লম্বা ও দিঘল তনুর হয়েছে। কিন্তু গায়ের রং মিশ্র। বাঙালি মেয়ের মতো ডাগর ডাগর চোখ ও দিঘল কালো চুল। রাকিবের মনে হলো, এত সুন্দরী কোনো মেয়ে হয়? (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন।