টরন্টোয় অরুন্ধতীর বই নিয়ে পাঠশালার আলোচনা

বই নিয়ে আলোচনা করছেন সেরীন ফেরদৌস
বই নিয়ে আলোচনা করছেন সেরীন ফেরদৌস

টরন্টোর দর্শন-সমাজ-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান চর্চাকেন্দ্র পাঠশালার বিষয়ভিত্তিক নিয়মিত আলোচনায় অনুষ্ঠিত হয়েছে অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ বইয়ের ওপর আলোচনা। গত বৃহস্পতিবার (২০ সেপ্টেম্বর) এগলিনটন স্কয়ারের টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরিতে বইয়ের ওপর আলোচনা করেন সেরীন ফেরদৌস। এতে বই প্রেমিক অনেক শ্রোতার সমাগম ঘটে। আসরটি সঞ্চালনা করেন পাঠশালার সংগঠক ফারহানা আজিম শিউলী।

পাঠশালার বর্ষপূর্তির বিশেষ আয়োজন হিসেবে এবারের আসরে গত সাত আসরের পোস্টার ও আলোচিত বইগুলোর ছবি প্রদর্শিত হয়।

বইয়ের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে সেরীন ফেরদৌস বলেন, উপন্যাসে অরুন্ধতী এক বিস্তীর্ণ জনজীবনের গল্প বলেছেন। যেখানে টাকা-পয়সা, ক্লাস, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্রযন্ত্রের তৈরি করা খাঁচায় আবদ্ধ মানুষগুলো দেয়ালের বাইরে আসতে চাইছে। প্রতিটা দেয়াল জ্বলছে- কখনো তা ভৌগোলিক সীমারেখা, যেমন কাশ্মীর, কখনো তা আদিবাসী অরণ্য, কখনো তা মাটির নিচের প্রাকৃতিক সম্পদ, সামাজিক লিঙ্গভেদ, কখনো তা ব্যক্তির নিজের সঙ্গে নিজের অস্তিত্বের দ্বন্দ্ব। উপন্যাসের চরিত্রেরা খুঁজছে নিজেদের, খুঁজছে নিজেকে।

তিনি বলেন, ট্রান্সজেন্ডার আনজুম আর স্থপতি তিলোত্তমাকে ঘিরে এগিয়ে যাওয়া দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস বইটির প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। এর ভেতরেই মানুষ ছোট ছোট সুখ খুঁজে খুঁজে বাঁচে। নিজের মতো করে দেশ, জীবন, মুক্তি আর সম্পর্কের মানে খুঁজে নেয়। সমাজের সিল ছাপ্পর মারা ভূমিকা অস্বীকার করে মৃতদের গোরস্থানে এসে জীবনের তরে বাসা বাঁধে আনজুম; আইডেনটিটি খুঁজতে থাকা নানা প্রান্তের কিছু মানুষও এসে জড়ো হয় সেখানে।

আলোচনায় আগত সাহিত্য অনুরাগীরা
আলোচনায় আগত সাহিত্য অনুরাগীরা

বইটিকে সমসাময়িকতার এক অনবদ্য দলিল হিসেবে মন্তব্য করে সেরীন ফেরদৌস বলেন, নিজ দেশের তো বটেই, এমনকি বৈশ্বিক রাজনীতি কী তীব্রভাবে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজের, বিশেষ করে নিচের তলার মানুষদের কীভাবে প্রভাবিত করে, তার নির্মম ও তীব্র সুখের বর্ণনা পাঠককে ওই জগতেই থাকতে বাধ্য করে পাঠ চলাকালে। অরুন্ধতী নিজেই বলেন, ‘একটি গোল্ডফিশের যৌনজীবনও রাজনৈতিক।’

সেরিন বলেন, ২০ বছর সময় পার করে ১০ বছর লাগিয়ে লেখা এ উপন্যাসে বারবার এই প্রশ্ন করেছেন তিনি, হাউ টু রাইট এ শ্যাটারড স্টোরি? টু বিকাম এভরিবডি। নো। টু বিকাম এভরিথিং! হ্যাঁ, উপন্যাসের চরিত্ররা তাই মানুষের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রাণী, উদ্ভিদ, মৃত মানুষ ও প্রাণহীন অবজেক্টও। সবগুলো দেয়ালই পলকা, এপার-ওপার আসা যাওয়া চলে নিত্য।

সেরীন ফেরদৌস বলেন, বিশ্বের ৩০টির মতো দেশে একযোগে প্রকাশিত হওয়া এ উপন্যাসের শেষে তারা-জ্বলা এক রাতে ছোট্ট গুবরে পোকাটি চারপা আকাশের পানে দিয়ে শুয়ে আকাশকে ঠেকিয়ে রাখতে চায় পতন থেকে, কারণ তত দিনে মিস উদয়া জিবীন নামের ছোট্ট শিশুটি এসে গেছে ট্রান্সজেন্ডার আনজুমের কোলে। তাকে রাষ্ট্রযন্ত্রের কবল থেকে চুরি করে আনে কোনো দিন মা হতে না-চাওয়া তিলোত্তমা! কবরস্থানে মৃতদের পাশাপাশি জীবনের ফুলকিও জ্বলে ওঠে।

আলোচনায় তিনি বলেন, তাহলে সুখ কী? সুখের মন্ত্রণালয় কী? সুখ মুহূর্ত মাত্র, সুখ ক্ষণে ক্ষণে আসে, সুখ মোড়ে মোড়ে নানা রূপে আসে, সুখ এসেই হারিয়ে যায় আবার নতুনরূপে আসবে বলে। সুখের উৎস হতে পারে নিজেকে পাওয়া, নিজেকে জানা। সুখ হতে পারে নিজের চারপাশের সমস্ত দেয়ালে আগুন লাগিয়ে দেওয়া!

প্রসঙ্গত, বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত অরুন্ধতী রায়, তাঁর প্রথম ফিকশন ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ লেখার দুই দশক পর লেখা উপন্যাস দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস সারা দুনিয়ায় সাড়া ফেলেছে, আগ্রহ তৈরি করেছে অগণিত পাঠকের মধ্যে। তাই এই বইটি নিয়ে 'পাঠশালার আয়োজনেও অভিনব সাড়া মিলেছে টরন্টোর সাহিত্যমোদীদের কাছ থেকে। অতি জটিল পথে আবর্তিত গল্পটিকে সেরীন খুব মুনশিয়ানায় বোধগম্যের ভেতর নিয়ে এসেছেন।সেরীন ফেরদৌসের স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীল উপস্থাপনায়, পাঠশালায় অংশগ্রহণকারীরাও অবলীলায় ভ্রমণ করেছেন পুরোনো দিল্লি, পুরোনো দিল্লির গোরস্থান থেকে নতুন দিল্লির জীবনযাত্রায়, আবার সেখান থেকে কাশ্মীরের উপত্যকায়, পর্বতে—যেখানে যুদ্ধই শান্তি কিংবা শান্তিই যুদ্ধ।

আলোচনার পর এক প্রাণবন্ত প্রশ্নোত্তর পর্বে আগত সাহিত্য অনুরাগীদের সঙ্গে মিলিত হন সেরীন ফেরদৌস। বিজ্ঞপ্তি।