হঠাৎ স্বর্ণকেশী!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমি অনীক। সাদামাটা বৈচিত্র্যহীন। একঘেয়ে চরিত্র। তার ওপর চেহারায় ভবঘুরে ভাব প্রকট। শুধু ভাবে নয়, আমি আসলেই ভবঘুরে। টাঙ্গাইলের ছেলে। স্কুল পেড়িয়েই ঘরছাড়া। ঢাকায় এসে পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি মেসে থেকে নটর ডেমে পড়েছি। তারপর বুয়েট আর বাউন্ডুলে হলজীবন। মাস্টার্সের সুযোগে আবারও নতুন করে ভবঘুরের ঝোলা কাঁধে জার্মানির মিউনিখে উড়াল দেওয়া। সেই পড়াশোনার পাটও চুকে গেছে দিনকয়েক হলো। ভিনদেশি এই শহরে কপাল গুনে একটা চাকরিও জুটিয়ে ফেলা হয়েছে। সামনের মাস থেকে কাজ শুরু। এ মাসটা তাই বেকার।

সময়ের অভাবে পড়ে থাকা কাজের একটা লিস্ট বানিয়েছি। লিস্টের তিন নম্বরে আছে দাঁতের ডাক্তার দেখানো। আজকে সকাল সাড়ে দশটায় টারমিন। টারমিন মানে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। জার্মানি আসা অবধি টারমিনে টারমিনে জীবন অতিষ্ঠ। ইউনিভার্সিটিতে থিসিসের প্রফেসরের সঙ্গে দুই মিনিট কথা বলব। অফিসের দরজায় কড়া নেড়েই সেরে নেওয়া যায়। কিন্তু না, তার জন্যও টারমিন লাগবে। অতিমানবীয় প্রফেসর তার অতি ব্যস্ত ক্যালেন্ডার থেকে সপ্তাহ দু-এক পর দয়া করে সময় দিলেও দিতে পারেন। কিংবা নতুন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলব, তো সবচেয়ে কাছের টারমিনই তিন সপ্তাহ পর। ঘোড়ার ডিম! মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়।

ভয় ভয় লাগছে। দাঁতের ডাক্তারের ব্যাপারে আমার মধ্যে সহজাত ভীতি কাজ করে। বছর দু-এক আগে একরকম বাধ্য হয়ে গিয়েছিলাম ডেন্টিস্টের কাছে। চারটা আক্কেলদাঁত একসঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাড়ি ফুঁড়ে ভীষণ বেকায়দায় বের হয়ে আসছে। পুরো আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেলাম। এই ছাব্বিশ বছর বয়সে এত আক্কেল আমি কই রাখি। যা হোক, ঠিক হলো, দুই দফায় দুই দিনে দুটো করে দাঁত তোলা হবে। তো প্রথম দফার দিনে হাসিখুশি সরল চেহারার ডাক্তার মশাই সাঁড়াশির মতো দেখতে কলিজা হিম করা বস্তুটি মাত্র হাতে নিয়েছেন আর সঙ্গে সঙ্গে আমি গাঁক গাঁক করে অস্ফুট স্বরে ইংরেজিতে আপত্তি জানালাম।

সবে তখন জার্মানিতে এসেছি। জার্মান জ্ঞান বলতে ওই গুটেন মর্গেন পর্যন্তই। জার্মান ডাক্তার আমার চিঁ চিঁ শুনে থমকে গেলেন। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, ‘দেখো, তুমি কী বলছ, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার ইংরেজি বেশি সুবিধের না। আমি আসলে ঘোড়ার ডাক্তার।’ এই পর্যায়ে আমি চরম অবিশ্বাস নিয়ে তার দিকে তাকালাম। কোনো মতে বললাম, কী বল তুমি, ঘোড়ার ডাক্তার মানে কী? উত্তরে তিনি হড়বড় করে বললেন, ‘আমি আসলে ঘোড়ার দাঁতের ওপর বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। মাত্র কয়েক বছর হলো আরও পড়াশোনা আর ডিগ্রি যোগ করে মানুষের দাঁতের ডাক্তারির লাইসেন্স নিয়েছি। এখনো সপ্তাহে তিন দিন মিউনিখের আশপাশের খামারগুলিতে ঘুরে ঘুরে ঘোড়ার দাঁত তুলি। আর বাকি দুই দিন এই চেম্বারে বসি।’ এই পর্যায়ে বিস্ময়ে চোয়াল হাঁটুতে নেমে এল আমার। ওদিকে ডাক্তার বলেই চলেছেন, ‘ঘোড়ার সঙ্গে তো আমার জার্মান, ইংরেজি কোনোটাই বলতে হয় না। কিন্তু এখন তোমার মতো অনেক বিদেশি রোগী আসে। আমার খুব সমস্যা হয় কথা বুঝতে। তুমি কী আমাকে কোনো উপদেশ দিতে পার যে, কেমন করে আমি আরেকটু ভালো ইংরেজি শিখতে পারি? আর হ্যাঁ, কী যেন বলছিলে তুমি, আবার বল তো? কোনো সমস্যা?’

আমার মনে হলো ঝেড়ে একটা দৌড় দেওয়া উচিত। একদম পেছন ফেরা যাবে না। কিন্তু আত্মায় কুলাল না। তার বদলে আমি দাঁত তোলার উঁচু চেয়ারের প্রখর আলোর নিচে তবদা খেয়ে বন্ধ চোখে নিরুপায় বসে থাকলাম।

সেই রোমহর্ষক ঘটনাই এখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাবছি, যাব নাকি, থাক আজকে। ডাক্তার যদি দাঁত ধরে নাড়াচাড়া দিয়ে অবস্থা আরও বেগতিক করে দেন! শক্ত একটা যবের রুটি খেতে গিয়ে নিচের দাঁতের আণুবীক্ষণিক একটা অংশ ভেঙে গেছে। জার্মান রুটিও বটে। মাথায় মারলে মাথা ফেটে যেতে পারে। বাঙালির ছেলে, কেন যে পাউরুটি ফেলে কাঠের টুকরা চিবাতে গেলাম! বাংলা ভাষার ব-বর্গিয় একটা গালি মনে আসছে। হলে আর মেসে থাকার সুবাদে বঙ্গীয় ব-আর চ-বর্গিয় বিশেষ শব্দভান্ডারের ওপর ভালো দখল আছে। ঢোঁক গিলে বিশাল শক্তিশালী বাংলা গালিটা গিলে ফেললাম। বাইরে থেকে দাঁতটা দেখলে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু জিভের ডগায় একটা অস্বস্তিকর অমসৃণতা সারাক্ষণ উপস্থিতি জানান দিয়ে যাচ্ছে। নাহ যাই, কারণ এই টারমিন নেওয়া হয়েছে ১৩ দিন আগে। আজ না গেলে দেখা গেল তিন মাস পর আবার টারমিন পাওয়া যাবে। তত দিনে দেখা যাবে টিস্যু পেপারে মুড়ে দাঁত হাতে নিয়ে ঘুরছি। সুতরাং, যা থাকে কপালে, যাবই যাব আজকে। যা হয় হবে, হক মাওলা!

ডাক্তারের চেম্বার বাসা থেকে খুব একটা দূরে না। লিন্ডউর্ম ষ্ট্রাসে ৫২। ষ্ট্রাসে মানে স্ট্রিট বা রাস্তা আর কী। মিনিট বিশেকের হাঁটা পথ। মাথার ওপর এক আকাশ রোদ। হেঁটে যেতে খারাপ লাগবে না। আর সমস্যা তো দাঁতে, পায়ে তো নয়, প্রবোধ দিলাম নিজেকে। কানে হেডফোনটা গুঁজে বেরিয়ে পড়লাম। ধীর লয়ে বেজে চলছে এড শিরান। গানের নাম ফটোগ্রাফ। গানটার ভেতর এক ধরনের বিভ্রম আছে। বিভ্রম আমার ভালো লাগে।

ফুটপাথ ধরে আমার পাশেই হাঁটছেন আরেকজন। অল্পবয়সী এক তরুণী। বয়স পঁচিশেক হবে হয়তো। আমি অন্যমনস্ক। কিন্তু তার খুঁড়িয়ে চলা আমার দৃষ্টি এড়াল না। তার বাম হাতে ক্রাচ, ডান পায়ে অতিকায় প্লাস্টার। প্লাস্টার নিয়ে হাঁটাচলার সুবিধার জন্য হাঁটু পর্যন্ত মেডিকেল বুট। আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম, প্লাস্টার আর মেডিকেল বুট, সব মিলিয়ে এই তরুণীর ডান পায়ের ওজন কত হতে পারে। পাঁচ, দশ, নাকি পনেরো? আমার পায়ের হালকা স্নিকার্সের তুলনায় তো নিশ্চিত বেজায় ভারী। কিন্তু হাঁটার গতিতে আমরা সমান। আমার তাড়া নেই, তাই কচ্ছপ গতিতে হাঁটছি। হঠাৎ কীসে যেন একটা ধাক্কার মতন খেলাম। তাল সামলাতে সামলাতে খেয়াল করলাম ফুটপাথ মেরামতের কাজ চলছে। ব্যারিকেডের মতো দিয়ে রেখেছে ফুটপাথের এক পাশটা জুড়ে। সাইনবোর্ডও একটা বসিয়ে দিয়েছে। তাতে লেখা—বাউষ্টেলে, মানে কন্সট্রাকশন সাইট। নির্মাণ কার্য চলিতেছে আর কী। আর আমি অন্ধ সেই সাইনবোর্ডটাতেই ধাক্কা খেয়েছি। একেই বলে চোখের মাথা খাওয়া। আর ভাউ রে ভাউ, জার্মান বাউষ্টেলেও বটে। বাংলাদেশে তাও তো শুধু বর্ষাকালেই আল্লাহর দুনিয়ার সব খনন কাজ আর সৌন্দর্য বর্জনের, এই কী বলি, মানে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ চলে। আর এই জার্মান দেশে বছর জুড়েই লেগে থাকে বাউষ্টেলের হাউ কাউ। মনে মনে গজগজ করছি আর সঙ্গে মুখ দিয়েও এক দুইটা গালি সুযোগ পেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বেমক্কা। ভীষণ বিরক্তি নিয়ে সতর্কভাবে হাঁটতে শুরু করেছি। বাউষ্টেলের গুষ্টি কিলানো বাদ দিয়ে অন্য দিকে মন দেওয়ার চেষ্টা করা যায় কিনা ভাবছি।

প্লাস্টার কুমারী আমার ক্ষণিকের বিরতিতে কিছুটা এগিয়ে গেছেন। তার চোখ, কান, মাথা সব ঢাকা হালকা নীল রঙের একটা সুতির টুপিতে। এই আগস্টের ত্রিশ ডিগ্রির সকালে কোন পাগলে টুপি পরে বের হয়। পায়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার মাথাটাও গেছে। আর আমি তাকে অল্পবয়সী তরুণীই বা ভাবছি কেন। পাশ দিয়ে, সামনে দিয়ে হেঁটে চলায় তার চেহারাটা তো একবারও চোখে পড়েনি। পঁচাত্তুরে বুড়িও তো হতে পারে। হাত থেকে ক্রাচ পড়ে গেলে তুলে দিতে গিলে খ্যাঁক করে উঠবে। এ রকম তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে আমার ঝুলিতে।

একবার বাসস্টপে অপেক্ষা করছি। বাস এল। আমি উঠতে যাচ্ছি। আমার সামনে এক নানির বয়সী ভদ্রমহিলা। হাতে বিরাট পেটমোটা বাজারের থলি নিয়ে বাসে উঠতে তার বেশ কষ্টই হচ্ছে। আমি ভদ্রতা করে হাত বাড়িয়েছি থলেটা বা তার হাতটা-যেটাই এগিয়ে দেবে, ধরব বলে। আমাকে হতভম্ব করে বুড়ি নানু চিল-চিৎকার দিয়ে উঠলেন। আমাকে প্রায় একরকম ধাক্কা মেরে এক ঝটকায় বাসে চেপে বসলেন। আমি ঘাবড়ে গিয়ে কেমন ক্যাবলা হয়ে থমকে গেলাম। বাসচালক মনে হয় এমন খিটখিটে জার্মান বুড়োবুড়ির দল আর আমার মতো নির্বোধ ভিনদেশি যুবক দেখে অভ্যস্ত। তিনি আমাকে সহাস্য ইশারায় যেন বলার চেষ্টা করলেন—‘হালকাভাবে নাও আর চুপটি করে বসো। এমনটি যেন আর করো না, নইলে কিন্তু কাম্মে দেবে, হাহাহা...।’ আসলেই, বলা যায় না, দিলেও দিতে পারে কামড়ে। আমি ভয়ে কাঁচুমাচু দিয়ে হাত গুটিয়ে সেই যে ঝিম ধরে জানালার পাশের সিটে গিয়ে বসলাম, আজ পর্যন্ত ভুলেও কারও দিকে হাত বাড়িয়ে দিইনি।

প্লাটারকুমারী, থুক্কু প্লাস্টারনানুর নীল টুপি আমাকে টক ঝাল স্মৃতিটা আবার মনে করিয়ে দিল। তাই পড়ে থাকা ইট বালু, যন্ত্রপাতিতে সরু হয়ে আসা ফুটপাথে আমি তার থেকে দুই হাত নিরাপদ দূরত্বে সন্তর্পণে হাঁটছি। রোদেলা আকাশে হঠাৎ কোত্থেকে এক টুকরো ছাইরঙা মেঘ এসে জুটেছে। আর আজব ব্যাপার হলো, এই মেঘ আমার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। কই যেন পড়েছিলাম, যদি যাও বঙ্গে, কপাল যায় সঙ্গে। মেঘ ব্যাটা কী কপাল হয়ে সঙ্গে সঙ্গে আসছে নাকি আজকে। কিন্তু আমি তো বঙ্গে নেই, আমি আছি জঙ্গে, মানে জার্মান মুলুকে। কিন্তু এই বঙ্গ প্রবাদে বিশ্বাসী মেঘটা থেকে আচমকা একটা বাংলা বৃষ্টি নামলে সমূহ বিপদ। এই পথে বাস-ট্রামের লাইন নেই। আর সঙ্গে ছাতাও নেই। কাকভেজা হয়ে ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছাতে হবে। কেয়া মুশকিল! আনমনে হাত চলে গেল সাত দিনের না কাটা দাঁড়িতে আর কপাল বেয়ে নেমে আসা অবাধ্য চুলের ভিড়ে। মেঘ-বৃষ্টি, কাক-বক কী সব ভাবছি, এমন সময়ে কিছু একটা পতনের শব্দে চিন্তার ঘোর কেটে গেল। মুহূর্তে সামনে তাকিয়ে দেখি প্লাস্টার কন্যার ক্রাচ মাটিতে আছড়ে পড়েছে। (চলবে)

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: মিউনিখ, জার্মানি।