কালো-ফরসা ও সাদা-কালো

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কালো ছেলে হিসেবে কিশোর বয়সে আমার নিজেকে বড় অভাগা মনে হতো। গায়ের রং ফরসা করার জন্য ওই বয়সে আমার শরীর ও মুখমণ্ডলে লাক্স সাবান দিয়ে খুব ঘষামাজা করতাম। আমার এখনো মনে আছে, জালি দিয়ে ঘষতে ঘষতে একবার আমার মুখের চামড়া উঠে গেয়েছিল। ঘষতে ঘষতে কিছুক্ষণ পর বুঝলাম আমার গালের চামড়া জ্বলছে। বেশ কিছুদিন আঁচড়ের মতো কালো দাগ নিয়ে মুখ লুকিয়ে লুকিয়ে বন্ধুদের এড়িয়ে চলতে হয়েছিল। এত সাবধানে চলতে গিয়েও অনেকের নজর এড়াতে পারিনি। তখন বন্ধুদের কী উত্তর দিয়েছিলাম তা আজ মনে পড়ছে না। তবে মুখের এই দাগ নিয়ে অনেক দিন আমার অস্বস্তিতে কেটেছিল বটে।

কালো ছেলেদের দুঃখ আমি বুঝি। আমার গায়ের রং কালো হওয়ার কারণে যৌবনেও কম যন্ত্রণা পোহাতে হয়নি। কোনো সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সংকীর্ণতা অনুভব করতাম। আমাদের সময়ে আজকালের মতো ছেলেদের স্টাইল করার তেমন জোগান ছিল না। অর্থাৎ ব্রান্ডের কাপড়-চোপড়, জুতা ও পারফিঊম ইত্যাদি তেমন পাওয়া যেত না। বিশ্বায়নের কারণে ও ইন্টারনেটের বদৌলতে পশ্চিমা স্টাইল তড়িৎ গতিতে আমাদের দেশে পৌঁছে যাওয়ার কারণে কালো মেয়েদের পাশাপাশি কালো ছেলেদের সুবিধা বেশি হয়েছে বলে আমার মনে হয়। পশ্চিমা স্টাইলের জোরে কালো ছেলেদের এখন অসুন্দর লাগে না। মানুষের ধ্যান ধারণা পাল্টাচ্ছে। এক সময় নাটকের প্রধান চরিত্রের মানুষ ছিল গতরে সাদা। ফরসা না হলে নাটকে ছেলেদের চান্স মিলত না আর মেয়েদের এখনো প্রশ্নই আসে না। একটি নাটকে অভিনেতা হাসান মাসুদকে প্রধান চরিত্রে দেখে অবাক হয়েছিলাম। বর্তমানে নাটকে কালো ও অসুন্দর নায়ক দেখা গেলেও আমাদের সিনেমার নায়ককে ফরসা ও সুন্দর হতেই হবে। এখনো বাংলাদেশের কোনো সিনেমার নায়ককে কালো ও অসুন্দর আমার নজরে আসেনি। আমার মনে হয় সিনেমা সেক্টরে তা পরিবর্তন হতে আরও সময় লাগবে। তবে হলিউড ও বলিউডে নায়ক সুন্দর ও অসুন্দরের মধ্যে সীমাবদ্ধতা নেই। এ ক্ষেত্রে হলিউডকেই অগ্রজ বলা যেতে পারে।

লেখক
লেখক

পশ্চিমা দেশে আসার পর মনের মধ্যে লালন করে রাখা কালো-সাদা এবং সুন্দর ও অসুন্দরের বিষয়ে নতুন করে চিন্তার অবকাশ পেয়েছি। লন্ডনের রাস্তা দিয়ে একজন অপরূপাকে কালো ও অসুন্দর একজন ছেলের হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাওয়া স্বাভাবিক বিষয়। নিশ্চয় আমাদের সমাজে এখনো সে দৃশ্য বিরল বলতে আমার কুণ্ঠাবোধ হচ্ছে না। এখানে এসে প্রথম প্রথম ভাবতাম, সুন্দরী মেয়েগুলোর মাথা খারাপ নাকি! অনেক বছর এখানে অবস্থানের পর বুঝতে পারলাম বিষয়টি সংস্কৃতির মিশ্রণের কারণে হয়েছে। মাল্টি কালচারের কারণে তাদের ধ্যান ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। এখানেও এক সময় সাদা-কালোর বিভেদ চরমে ছিল। সময়ের আবর্তে তা পরিবর্তন হয়েছে। রেসিজমের কথা যদি বাদ দিই, তাহলে পশ্চিমা দেশগুলোতে সাধারণের মধ্যে সাদা-কালোর বিভেদ তেমন দেখা যায় না। হাজার হাজার মিশ্র রঙের মানুষের (পুরুষ-নারী) জোড়া লন্ডনে দেখা যায়।

মূলত ফরসা ও কালো মানুষের বিভেদ আমাদের সমাজে আজকের নয়, এই বিভেদ আজীবন থাকবেই। দীর্ঘকাল লন্ডনে বসবাস করার পর বুঝতে পারলাম, সাদা-কালোর ফারাক এই সমাজ থেকেও কখনো মুছে যাওয়ার নয়।

মোহাম্মদ আবদুল মালেক: লন্ডন, যুক্তরাজ্য। ইমেইল: <[email protected]>