শিক্ষা, শিক্ষক ও একটি জাতির গল্প-দুই

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

সময়টা ১৯৯৫ সাল। বাচ্চু স্যারের ক্লাসে প্রশ্ন করলাম, স্যার পড়াশোনার শেষ কোথায়?

স্যার বললেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শেষ আছে। কিন্তু মানুষ থাকতে হলে সারা জীবন পড়তে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হলো চার স্তরের। এই যে তোরা প্রাইমারিতে পড়ছিস, এরপরে যাবি হাইস্কুলে। সেখান থেকে কলেজ এবং সবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার এই প্রতিটি স্তর তোদের একেকভাবে এই চলমান জগৎ নিজেকে নিয়ে বেঁচে থাকার মতো করে যোগ্য করে তুলবে। এই বিষয়টিকে আমরা তুলনা করতে পারি একটি মাটির তৈরি আমের সঙ্গে। যা ন্যায্য মূল্যে তুই মেলা থেকে ক্রয় করে বাসায় যত্ন করে রাখিস। কিন্তু চিন্তা করে দেখেছিস, এই আমটি আসলে একটি মাটির দলা ছিল, যার মূল্য ছিল প্রায় শূন্য। কিন্তু এটিকে একটি নির্দিষ্ট আকৃতি ও রং মাখার ফলে তোর মতো একজন ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণই না শুধু, তোকে ক্রয় করতে বাধ্য করল।

তেমনিভাবে তোরা যখন এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলি তখন আমরা তোদের একটি মাটির দলা হিসেবেই গ্রহণ করেছি। এখন এই পাঁচ বছরে এটিকে আমরা আমের রূপে রূপান্তরিত করব। আমরা কাঠামো তৈরি করে দিই। কিন্তু ফিনিশিং দেওয়ার আগেই তোরা হাইস্কুলে চলে যাবি। হাইস্কুলে তোদের স্যারেরা সেই আমটিকে পুড়িয়ে শক্ত করবে। যে স্কুল যত যত্ন সহকারে পুড়িয়ে দেবে সেই স্কুলে শিক্ষার্থীদের ভিত তত শক্ত হবে। পোড়ানো সেই আমকে তখন কলেজের শিক্ষকেরা সুন্দর করে শিরীষ কাগজ দিয়ে ঘষে উঁচুনিচু অংশগুলোকে সমান করে এবং কোথাও কোনো ক্রুটি থাকলে তা পূরণ করে তোদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাতে তুলে দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সেই আমের ওপর সঠিক মাত্রাতে রং প্রয়োগ করে তোকে বাজারে বিক্রয়ের উপযোগী করে তুলবেন। এরপরে কেউ আবার আরও বেশি পড়াশোনা করে সেই রঙের ওপর নানা মাত্রার গ্লেজ দিয়ে নিজেদের দাম বাড়িয়ে নিবে। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ্য রাখবি, যে যাই করুক আমরা তোকে যে আমের রূপ দিয়েছি শেষ পর্যন্ত তুই সেই আমই থাকবি!’

গল্পটি এত সুন্দর করে স্যার ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, আজও হুবহু মনের মাঝে গেঁথে আছে। আর কতই না সুন্দরভাবে একজন শিক্ষার্থীকে সমাজের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষার প্রতিটি স্তরের ভূমিকা একটি মেলার দোকানে পড়ে থাকা একখানা আমের সঙ্গে তুলনা করে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করলেন। স্যারের শেষের বাক্যটিকে যদি ব্যাখ্যা করি, তাহলে দেখব আসলে আমাদের নিজেদের যে আকার ও আকৃতি, অন্য ভাষাতে বললে আমাদের নৈতিকতার ভিত্তি রচিত হয় সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে। শিক্ষার মানে এই বিদ্যালয়গুলো যত সামান্যই হোক না কেন, এই পর্যায়ের শিক্ষকদের নিবিড় পরিচর্যা একটি জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তা এই গল্পের কিংবা আমাদের দৈনন্দিন কার্যাবলিতে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়। আমরা কি দিতে পারছি এমন মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা? আমরা কি পেয়েছি এমন নৈতিক দৃঢ়তা সম্পন্ন শিক্ষক? আমরা কি পারছি প্রাথমিকের শিক্ষকদের সঠিক মূল্যায়ন করতে?

প্রশ্নগুলোর উত্তর মোটা দাগে বললে হবে না। আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছরের দ্বারপ্রান্তে এসেও আজও নিশ্চিত করতে পারিনি সমাজের সর্বাপেক্ষা নৈতিক ও শ্রদ্ধেয় মানুষটি হবে ওই সমাজের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক! অপরদিকে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গুণগত মানের অবনমন চোখে পড়ার মতো। আমরা আমাদের বিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষক পেয়েছি, বাচ্চু স্যার, বশীর স্যার, মন্তাজ স্যার কিংবা রেক্সনা ম্যাডাম এখনকার বাচ্চারা কি পাচ্ছে এমন শিক্ষক? তাঁদের ব্যক্তিত্বের কাছাকাছি ব্যক্তিত্বের শিক্ষক আমি অন্তত আমার এলাকাতে দেখি না। কারণ অত্যন্ত সহজ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অধঃপতন, চাকরির নিয়োগে দুর্নীতি, এসএসসি পাসের পরেই প্রাথমিকের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে পারার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এবং নিম্ন বেতন কাঠামোকেই হয়তো মূল সমস্যা হিসেবে আলোচনা করতে পারি।

জাপানে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সমান বেতন পান। বিশ্বাস হচ্ছে না? হবেও না কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হওয়ার চেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া কঠিন কাজ। কারণ জাপানিরা বিশ্বাস করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দায়িত্ব যার তার হাতে দেওয়া যাবে না। তাই স্নাতক পাসের পরে একটি বিশেষ কোর্সে ভর্তি হন শিক্ষক হতে ইচ্ছুক জাপানিরা। সেখানে তাঁরা শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা প্রদান ও শিক্ষক হিসেবে তাঁদের সমাজ গঠনে কী ভূমিকা রাখবেন এই সকল বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এরপরে ওই কোর্সে ভালোভাবে পাস করতে পারলেই কেবল কেউ প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার জন্য আবেদন করতে পারেন। অর্থাৎ মন চাইল আর এলাকার দালালকে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে গেল, এটা অসম্ভব। এই অসম্ভবের ফলাফল তাদের জাতীয় জীবনের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পারি।

সাপ্পোরোর AIST–তে যাওয়ার পথে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। প্রতিদিন সকালে খুব ভোরেই দেখতাম বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এসে গেট খুলে রাস্তাতে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের অভিবাদন জানাচ্ছেন। ওহাইও গোদাইমাস (শুভ সকাল)। শিক্ষার্থীরাও বলছে ওহাইও গোদাইমাস। একদিন দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেন এখানে সবার আগে এসে দাঁড়িয়ে থাক? তিনি বললেন—আমি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আমি যদি সবার শেষে আসি আর সবার আগে যাই তাহলে আমার অন্য শিক্ষকেরা কীভাবে নিয়মানুবর্তী হবেন? আর আমার শিক্ষার্থীরা এতে করে শিখতে পারছে যে যার যত বড় চেয়ার তাঁর তত বেশি দায়িত্ব।

আমি তার থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ল্যাবের দিকে যাত্রা করলাম আর মনে মনে ভাবতে থাকলাম আমাদের দেশে এমন শিক্ষক পেতে কত দিন লাগবে? বলা বাহুল্য, আমার অধ্যাপক ও হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার পরিচিত দশজন অধ্যাপক ওই বিদ্যালয়ের ছাত্র! আমি আমার অধ্যাপককে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওই ভদ্রলোক সম্পর্কে। অধ্যাপক বললেন, উনি আমার স্কুলের সিনিয়র এবং ওনার মতো নিয়মানুবর্তী হতে আমরা সবাই চাই! আশা করি এই উদাহরণ এতটুকু পরিষ্কার করেছে যে, কেন জাপানিরা এতটা দায়িত্ববোধ সম্পন্ন জাতি। আমার জানা মতে বাংলাদেশে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে এমন একজন প্রধান শিক্ষক আছেন। আর সহকারী শিক্ষকদের কথা না হয় নাই বললাম!

পরিশেষে বলব, যে শিক্ষক অর্থের বিনিময়ে বা অন্য কোনো দুর্নীতির আশ্রয়ে শিক্ষকতা পেশাতে যুক্ত হচ্ছেন কিংবা হতে বাধ্য হচ্ছেন অথবা উপযুক্ত নৈতিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ বাদেই শিক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন, তার কাছে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তুলে দিচ্ছি এমন একটি বয়সে যখন সে কাচা কাদামাটির মতো নরম ও যখন তার একটি সঠিক আকৃতি ধারণ করার কথা। সেই মেরুদণ্ডের হাড়ের ডিস্কের আকৃতি, যার আকৃতি ও আকার পুরো দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে একই রকম ডাইসে হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ একেক বিদ্যালয়ে একেক রকম ডাইস ব্যবহার করলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কাটানো সময়ের মাঝে এই ডিস্ককে সঠিকভাবে পোড়ানো অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলাফল আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়া অসৎ ও অর্থলিপ্সু চরিত্রগুলো।

অন্য দিকে, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পড়ানোর যে দায়িত্ব সেখানেও রয়েছে অনেক ধরনের গলদ। আদর্শ শিক্ষকের অভাবে সেই বিদ্যালয়গুলোও ধুঁকে ধুঁকে মরছে। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে আদর্শ আর বাস্তব শিক্ষক আবার কী? উত্তরটা দেব তৃতীয় পর্বে। আমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন আদর্শ শিক্ষক প্রয়াত মোফাজ্জল হোসেন স্যারের (সিনিয়র সহকারী শিক্ষক, বোরহানউদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ভোলা; স্যারের জন্য সকলের কাছে দোয়ার দরখাস্ত রইল) মতামত অনুসারে।
...

শেখ মাহাতাবউদ্দিন: প্রাক্তন শিক্ষক, সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও পোষ্টডক্টরাল গবেষক, হেনরি ফোর্ড হসপিটাল, মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন