দিঘল মেঘের দেশে-ষোলো

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জাহিদের ঘুম ভাঙল ফোনের শব্দে। তার মোবাইলটা বাজছে। জাহিদ চোখ কচলে টি টেবিল থেকে মোবাইলটা হাতে নিল। মোবাইলের স্ক্রিনে দেখল, সাইদ আহমেদের ফোন।

জাহিদ ফোন রিসিভ করতে করতে মনে মনে একটু বিরক্ত হলো। এত সকালে সাইদ ভাইয়ের ফোন? আজ তো তার কাজ নেই। তারপরও ফোন কেন? জাহিদ ঘুম জড়ানো গলায় বলল, হ্যালো।

ফোনের ওপাশ থেকে সাইদ আহমেদ অধিকারসুলভ ধমকের গলায় বললেন, হেই মিয়া, তুমি এখনো ঘুমাচ্ছে কেন?

জাহিদ জিজ্ঞেস করল, কয়টা বাজে?

সাইদ আহমেদ বললেন, সাড়ে সাতটা বাজে।

: ধুর, কী বলেন?

: ঘড়ি দেখ।

জাহিদ দেয়াল ঘড়িটা দেখল। ঠিকই সাড়ে সাতটা বাজে। সে ধড়ফড় করে উঠে বলল, আরে সাড়ে সাতটাই তো বাজে। এত বেলা হয়ে গেছে?

সাইদ আহমেদ বললেন, জাহিদ, আজ যে একটু কাজে যেতে হবে। ডিক জনসন অরচার্ডের মালিক রিচার্ড ফোন দিয়েছিলেন। এগারো নম্বর ব্লকে কাল লন মোয়িং করবে। এ জন্য আজ যদি তোমরা ব্লকটা শেষ করে দাও, তাহলে ভালো হয়। আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব।

: সবাই কি যাচ্ছে?

: হ্যাঁ, মোটামুটি সবাই আসছে।

: রোববারেও কাজ?

: কী করব বলো? আসো ভাই, প্লিজ। সাড়ে আটটায় কাজ শুরু করলেও হবে। একটার মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে। হাফ বেলা কাজ। আজ অন্য ব্লক না ধরলেও হবে। কাল এসে নতুন ব্লক ধরবে।

জাহিদ বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি সাড়ে আটটার আগেই চলে আসব।

সাইদ ভাই বললেন, থ্যাংক ইউ। আমি অ্যান্ড্রুকে ফোন দিচ্ছি। সে অবশ্য আসবে না। আমাকেই তোমাদের সঙ্গে থাকতে হবে। তুমি আসো। বলেই তিনি ফোন কেটে দিলেন।

জাহিদ মোবাইলটা সামনের টি-টেবিলে রাখতে রাখতে শরীরের আড়মোড়া ভাঙল। মাথার ওপর লাইটটা তখনো জ্বলছে। লাইট না নিভিয়েই সে লাউঞ্জের সোফাতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। তার এ রকমটা যে হয় না, তা নয়। মাঝেমধ্যেই সে টিভি দেখতে দেখতে লাইট না নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু গত রাতের ব্যাপারটা অবশ্য আলাদা। জাহিদ গতরাতে আজমল হোসেনের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে সোফায় বসে ছিল। সোফায় বসে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিল।

শরীরের আড়মোড়া ভেঙে সোফা ছেড়ে দাঁড়াতে গিয়ে জাহিদের হঠাৎ মনে পড়ল, আচ্ছা, আজমল স্যার কী বাসায় এসেছেন? এসে থাকলে কখন এসেছেন। নিশ্চয়ই জাহিদ ঘুমিয়ে আছে দেখে তিনি ডাক দেননি।

জাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকাল। কিন্তু না, কাল সে নেপিয়ারের যে সি-ফুড রেস্টুরেন্ট থেকে খাবারগুলো এনেছে ওগুলো এখনো টেবিলের ওপরই পড়ে আছে।

জাহিদ বাথরুমের দিকে না গিয়ে আজমল হোসেনের রুমের দিকে এগিয়ে গেল। তার রুমের দরজা খোলাই। জাহিদ আজমল হোসেনের রুমে দেখল, তার বেড ফাঁকা। এর মানে আজমল স্যার গতরাতে ফেরেননি?

জাহিদ মনে মনে বেশ বিরক্ত হলো। ভাবল, কী মুশকিল! তারপর বাথরুমে গিয়ে ঢুকল।

বাথরুম সেরে হাতমুখ ধুয়ে জাহিদ আবার লাউঞ্জে ফিরে এল। লাউঞ্জের লাইটটা নিবিয়ে দিয়ে সে জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দিল। আজকের দিনটা বেশ চমৎকার। চারদিকে চকচকে রোদ বিছিয়ে রয়েছে। সকালের নরম রোদ। সেই নরম রোদের দিকে তাকিয়ে আজমল হোসেনের জন্য জাহিদের মন খারাপ হয়ে গেল। ভাবল, তিনি কোথায় গিয়ে রাতটা কাটালেন? আর যেখানেই রাত কাটিয়েছেন, সেখান থেকে একটা ফোন দিলেই তো পারতেন?

জাহিদ জানালা থেকে সরে এসে কাজের কাপড়চোপড় না পরে নাশতা খাওয়ার জন্য ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। আপাতত সে গতরাতে সি-ফুড রেস্টুরেন্ট থেকে আজমল হোসেনের জন্য আনা খাবারগুলো দিয়ে সকালের নাশতাটা সারবে। এগুলো আর ফ্রিজে রাখা ঠিক হবে না। নষ্ট হয়ে যাবে। আর আজমল স্যার কখন আসেন তার ঠিক নেই।

জাহিদ খাবারগুলো একটা প্লেটে নিয়ে মাইক্রোওয়েভে গরম করতে দিল। আজ যেহেতু একবেলা কাজ হবে তাই সে অরচার্ডে দুপুরে খাবার নেওয়ার কথা চিন্তা করল না। মাইক্রোওয়েভে প্লেটটা ঘুরছে ওঁ-ওঁ-ওঁ শব্দ করে।

জাহিদ মাইক্রোওয়েভের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে কিচেনের জানালা গলে বাইরে তাকাল। সকালের রোদের একটা সরু রশ্মি জানালার কাচ গলে ভেতরে এসে পড়ছে। সেই রশ্মিতে অসংখ্য ত্রসরেণু উড়ছে। জাহিদ সেই ত্রসরেণুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছুদিন আগেও সে নিজের জীবনটাকে এই ত্রসরেণুর সঙ্গে তুলনা করত। উড়ছে তো উড়ছেই। কোনো নির্দিষ্ট স্থিতি নেই। কিন্তু আজ সে নিজের জীবনটাকে এই ত্রসরেণুর সঙ্গে তুলনা করল না। তার জীবনে একটা মোড় এসেছে। সে এখন নিউজিল্যান্ডে স্থায়ী বসবাসকারীদের একজন। সোনার হরিণ তার হাতে।

আজ কাজ থেকে ফিরে জাহিদ তার মাকে ফোন দেবে। সম্ভব হলে সে আজ শিরিনের সঙ্গেও কথা বলবে। শিরিনের সঙ্গে তার গত তিন-চার দিন ধরে কথা হয় না।

জাহিদ নাশতাটা একটু তাড়াতাড়িই শেষ করল। যদিও তার তাড়া নেই। সবে আটটা বাজে। কাজের কাপড়চোপড় পরে আটটা দশ বা সোয়া আটটার মধ্যে বের হলেই হবে। রিভার ব্যাংকে ডিক জনসন অরচার্ড। কাছেই তো। হেস্টিংস শহরের একেবারে ধার ঘেঁষে। গাড়ি ড্রাইভ করে দশ মিনিটও লাগে না।

জাহিদ কাজের কাপড়চোপড় পরে আটটা দশের আগেই বের হয়ে গেল। আটটা বিশেই সে ডিক জনসন অরচার্ডে চলে এল। এসে দেখল আপেল বাগানের শ্রমিকেরা আর কেউ না এলেও সাইদ আহমেদ ঠিকই এসে গেছেন। তিনি তার গাড়িতে হেলান দিয়ে সিগারেট টানছেন।

জাহিদ তার কলেজের শিক্ষক বলে আজমল হোসেনের সামনে সিগারেট না টানলেও সাইদ আহমেদ বা অন্যদের সামনে সিগারেট টানতে দ্বিধা করে না। সে সাইদ আহমেদের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজেও একটা সিগারেট ধরাল। আয়াস করে সিগারেটটা কিছুক্ষণ টানল।

সাইদ আহমেদ জিজ্ঞেস করলেন, আজমল স্যারের খবর কী?

জাহিদ সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, আজমল স্যার এখনো বাসায় ফেরেননি।

: এর মানে, আজমল স্যার রাতে বাইরে ছিলেন?

: জি, সাইদ ভাই।

: ফোন-টোন দিয়েছিলেন?

: ফোন দেবেন কী, মোবাইলই তো নেননি।

: ও, তাই তো। তিনি যে কী করেন!

: জি, সাইদ ভাই! আচ্ছা, আজমল স্যারের জন্য আপেল পিকিংয়ের আগে একটা কাজের ব্যবস্থা করা যায় না?

: আপেল থিনিংয়ের কাজ?

: আর কী কাজ করবেন তিনি?

: কাজ ব্যবস্থা করা তো কোনো ব্যাপার না। আমার তো ওয়ার্কার দরকারই। কিন্তু তিনি থিনিংয়ের কাজ বোঝেন না। অথচ এই কাজটাই আপেল বাগানের সবচেয়ে সহজ কাজ।

: জি, ওটাই। আজমল স্যারের যে কী হয়েছে?

: বয়স, জাহিদ বয়স! অল্প বয়সে একটা মানুষ যেকোনো ব্যাপারে চাপ নিতে পারে। কিন্তু বয়স হলে পারে না। আজমল স্যারের এখন রিটায়ারমেন্টে যাওয়ার কথা। উনষাট-ষাট বছর বয়স তার।

: উনষাট-ষাট বছর নয়। আটান্ন বছর।

: ওই একই কথা। এ বয়সে তিনি অরচার্ডে কঠিন কাজ করছেন। এই কাজটাও তার কাছে কঠিন হতো না যদি তার নিউজিল্যান্ডে পারমানেন্ট রেসিডেন্সি থাকত। মানসিকভাবে স্থিরতা থাকলে কোনো কঠিন কাজই কাজ মনে হয় না। কিন্তু আজমল স্যারের তো সেটাও নেই।

জাহিদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন সাইদ ভাই।

এরই মধ্যে বাগানের সব শ্রমিকেরা গাড়ি নিয়ে একে একে অরচার্ডে ঢুকে তাদের গাড়িগুলো পরপর পার্ক করতে শুরু করেছে। সাইদ আহমেদ কথা থামিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। জাহিদ যথাস্থানেই দাঁড়িয়ে রইল।

আজ মোট বারোজন আপেল বাগানে কাজ করতে এসেছেন। এদের সবাই বাঙালি। এ দেশি বা সামোয়া-কুক দ্বীপের শ্রমিকেরা সাধারণত শনি-রোববারে কাজ করে না।

জাহিদ সিগারেট শেষ করে অন্যান্য শ্রমিকদের দিকে এগিয়ে গেল।


সতেরো

সকালে রাকিবের ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতে হতে পৌনে নয়টা। ডাইনিং রুমে এসে দেখল, রিনেই ভাবি ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসে আছেন।

রাকিব আরেকটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, গুড মর্নিং ভাবি।

রিনেই ভাবি রাকিবের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তার হাসিটা কিছুটা মলিন, কিছুটা মায়ার। বললেন, গুড মর্নিং। বসো, আমি তোমার জন্য বসে আছি।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, আপনি এখনো নাশতা করেননি?

: না, ভাবলাম একসঙ্গে নাশতা করি।

: কেন? নয়টা বেজে গেছে?

: আমি যে সব সময় অন টাইমে নাশতা করি, তা নয়। মাঝেমধ্যে কোহিনূরকে স্কুলে দিয়েই নাশতা করি। আর আজ তুমি আছ।

: তারপরও—বলেই রাকিব নাশতার সরঞ্জাম দেখে চোখ কপালে তুলল। বলল, ভাবি, এত নাশতা বানিয়েছেন কেন?

রিনেই ভাবি মৃদু হেসে বললেন, এত নাশতা কই? বাড়তি নাশতা বলতে বিফ স্টেক।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, এগুলো?

: ও, এই চিনি-চালের পায়েস? আর কতক্ষণ সময় লাগছে এগুলো বানাতে। হাসান চিনি-চালের পায়েস খুব পছন্দ করত। মাঝখানে অনেক দিন বানাইনি। আজ ঘুম থেকে উঠে ভাবলাম একটু চিনি-চালের পায়েস বানাই। দেখি কেমন হয়। মনে হয় ভালোই হয়েছে।

: ভাবি, আপনি না! আর ব্রেড টোস্ট ভালো কথা। ক্রামপ্যাড তেলে ভেজেছেন কেন? আবার ডিম পোঁচও।

: তুমি যখন আমাদের বাসায় থাকতে তখন ক্রামপ্যাড হালকা তেলে বেজে ডিম পোজ দিয়ে খেতে মনে নেই?

: জি ভাবি। মনে আছে। আপনি তো নাশতার আইটেম না বানিয়ে পুরো লাঞ্চের আইটেম বানিয়েছেন।

: আরে খাও তো। দুপুরে কোথায় না কোথায় খাও? আচ্ছা, তুমি আরেকটা দিন থেকে গেলেও তো পারতে। এত দিন পর একদিনের জন্য এলে?

: নেক্সটে আসলে সময় নিয়ে আসব ভাবি। আগামীকাল আমার অফিস আছে। আমি হয়তো এমেন্ডার সঙ্গে দেখা করে আরও দুই-এক জায়গায় গিয়ে সরাসরি হ্যামিল্টন চলে যাব। কাল সকাল নয়টায় আমার অফিস। বলেই জাহিদ কী মনে করে জিজ্ঞেস করল, ও হ্যাঁ, ভাবি, আপনাকে একজনের কথা জিজ্ঞেস করব। আপনি কী আজমল হোসেন নামে কাউকে চেনেন? বাংলাদেশি। চার-পাঁচ বছর ধরে হেস্টিংসে আছেন।

: চিনি তো। এখানকার বাঙালি কমিউনিটির কয়েকটা অনুষ্ঠানে তাকে দেখেছি। ওল্ড ম্যান। কী সব ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত সমস্যায় আছেন। দেশে যেতে পারছেন না।

: জি জি, তিনিই।

: তুমি তাকে চেনো কীভাবে?

: তিনি আমার কলেজের শিক্ষক ছিলেন। সরাসরি শিক্ষক নয়। তিনি সায়েন্সের শিক্ষক ছিলেন। আর আমি ছিলাম আর্টসের ছাত্র। তারপরও একই কলেজের ও একই এলাকার। ভাবছি হেস্টিংসে এলাম। আজমল স্যারের সঙ্গে একবার দেখা করে যাই।

: তাহলে তো ভালোই।

: জি ভাবি। আচ্ছা, আপনার কাছে কি আজমল স্যারের কোনো ফোন নম্বর আছে বা বাসার ঠিকানা?

: না, জানি না তো। আসলে তার সঙ্গে সেভাবে মেশা হয়নি। তুমি চাইলে দুই-একজনকে ফোন করে তার ফোন নম্বর বা বাসার ঠিকানাটা নিতে পারি।

রাকিব বলল, হুম, থাক তাহলে। আর ঝামেলা করে লাভ নেই। আপনি আবার কাকে ফোন দেবেন। দেখা করার ইচ্ছে হয়েছিল, এই যা। তেমন ইম্পর্ট্যান্ট না।

রিনেই ভাবি মাথা ঝাঁকালেন।

রাকিব ক্রামপ্যাড ডিম পোজ দিয়ে খাচ্ছে। একটা বিফ স্টেকও নিয়েছে। রিনেই ভাবি টোস্ট ব্রেড খাচ্ছেন। তার প্লেটেও একটা বিফ স্টেক।

রিনেই ভাবি জিজ্ঞেস করলেন, এমেন্ডার সঙ্গে তোমার কখন দেখা হবে?

রাকিব বলল, সে তো বলেছে সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে তার অফিসে যেতে। তখনই যাব।

: বুঝলাম না, সে এই রোববারেও কেন তার অফিসে যেতে বলেছে? মিনিমাম কার্টিসি বলে একটা কথা আছে। সে তোমাকে তার বাসা যেতে বলতে পারত?

: এমেন্ডা হয়তো ভেবেছে আমাকে তার বাসায় যেতে বললে আমি যাব না, তাই।

: এটা আবার কোন কথা? তুমি কী তার বাসায় যেতে না?

: হয়তো যেতাম। তার বাসায় গেলে কী এমন সমস্যা হতো? তবে অফিসে যেতে বলেছে বলে খারাপ হয়নি। শর্টকাটে সাক্ষাৎ করে আসতে পারব। তার বাসায় যেতে বললে হয়তো সে লাঞ্চের ঝামেলা করত।

: তা না হয় করত।

: থাক ওসব কথা ভাবি।

রিনেই ভাবি মাথা ঝাঁকালেন। আর কিছু বললেন না। নাশতা খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, ভাবি, কোহিনূর ও পুতুলকে দেখছি না?

রিনেই ভাবি বললেন, কোহিনূর হয়তো আমার রুমে। স্কুলের কী সব হোম ওয়ার্ক করছে। পুতুল পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।

: পুতুলের আজ ডিউটি নেই?

: আছে তো। দুপুর একটা থেকে শুরু হবে। নয়টা পর্যন্ত ডিউটি।

: ভাবি, পুতুলের একটা বিয়ে দেন।

: এই বয়সে?

: কেন, অসুবিধা কী?

: এই বয়সে সে কী বিয়ে করবে?

: এমেন্ডা তো করেছিল। আমি যখন এমেন্ডাকে বিয়ে করি তখন তার বয়স ছিল একুশ কী বাইশ। পুতুলের তো এ রকমই বয়স হয়েছে?

: তা হয়েছে, কিন্তু...।

: কিন্তু কী?

: রাত তিনটায় তুমি দেখনি, সে কী অবস্থায় নাইট ক্লাব থেকে ফিরেছে?

: হ্যাঁ, দেখেছি। এ জন্যই তো বলছি। বিয়ে করে সেটেল্ড হলে এসব আর করবে না।

: তুমি তো মনে হয় তোমাদের কালচারের দৃষ্টিকোণ থেকে বলছ।

রাকিব হেসে ফেলল। একটু শব্দ করে হাসি। বলল, ঠিক তা নয়। তবে আপনি যেহেতু বলছেন আমি তা মেনে নিলাম। আমি না হয় আমাদের কালচারের দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি। কিন্তু একটা কথা কী, পুতুল তো আমাদের বাঙালি কালচারেরই একজন, তাই না?

রিনেই ভাবি মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, হু, তা বলতে পার। তার বাবা যেহেতু বাঙালি।

: তাহলে সমস্যা কী?

: রাকিব, আর ইউ সিরিয়াস?

রাকিব আবারও হাসল। বলল, না, আমি এমনিই কথার কথা বললাম।

রিনেই ভাবি বললেন, আমিও তাই ভাবছি। কারণ তোমার এই কথাটা অ্যাবসার্ড কথা। এ দেশে বাবা-মায়েরা তোমাদের দেশের বাবা-মার মতো ছেলেমেয়েদের জন্য বিয়ে ঠিক করে না। কী যে বলে, অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ? এখানে ছেলেমেয়েরা সব সময় নিজেদের পছন্দে বিয়ে করে। ওরা ঠিক করে নেয় কখন ওরা বিয়ে করবে। জোরজবরদস্তির তো প্রশ্নই আসে না। অনেক সময় এমন হয়, এ দেশে বাবা-মারা শুধু বিয়েতে অতিথির মতো অ্যাটেন্ড করে। এর বেশি কিছু নয়।
রাকিব বলল, আমি জানি। সাড়ে দশ বছর ধরে এ দেশে আছি। এখন দেখছি, আপনিও আমার কথাটা সিরিয়াসলি নিচ্ছেন। আমি জাস্ট কথার কথা বললাম।

রিনেই ভাবি হেসে বললেন, আমিও কথার কথাই বলছি। কিন্তু কথা কী রাকিব, পুতুল যদি এ মুহূর্তে বিয়ে করে সেটেল্ড হতো, আমার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হতো না! তুমি তো দেখলেই। তিনটার সময় পুতুলের উপদ্রবে তোমারও তো ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। পুতুল কী অবস্থায় ট্যাক্সি করে বাসায় ফিরেছে? নাইট ক্লাবিং করার একটা সীমা আছে। সে অতিরিক্ত করছে। ট্যাক্সি ভাড়া দেওয়ার পয়সা পর্যন্ত তার ছিল না। অথচ গতকালই সে সপ্তাহের বেতন পেয়েছে।

রাকিব কিছু বলল না। চেহারা বিষণ্ন করে মাথা ঝাঁকাল শুধু। ছেলেমেয়েদের এই কাহিনি নিউজিল্যান্ডের অনেক ঘরে ঘরেই আছে। হোক তা ইউরোপিয়ান সাদা, আদিবাসী মাউরি, চাইনিজ, জাপানিজ, আফ্রিকান, আরব দেশগুলো, কিংবা ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার। বাবা-মারা তা মেনে নেন। মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। রঙিন স্বপ্নের মোহে বিদেশ এসেছে। এসব তো মেনে নিতেই হবে। ভিন্ন সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েরা ভিন্ন আবহে বড় হবেই!

কিন্তু এ মুহূর্তে রাকিবের রিনেই ভাবিকে ছাপিয়ে হাসানুজ্জামান হাসানের চেহারাটা ভেসে উঠল। কী অন্যায় কাজটাই না তিনি করে গেছেন। এগারো বছরের পুতুল ও চার-পাঁচ বছরের কোহিনূরকে রেখে, মনেপ্রাণে বাঙালি হওয়ার জন্য সাধনা করা স্ত্রীকে ফেলে তিনি কীভাবে পালিয়ে গেলেন? কেন পালালেন? আজ রিনেই ভাবি দুটো মেয়েকে নিয়ে কী হিমশিম খাচ্ছেন! প্রায় নয়-সাড়ে নয় বছর ধরে একা মেয়ে দুটোকে টেনে বড় করছেন। মেয়ে দুটো পিতৃহীন বড় হচ্ছে। এর দায়ভার কী একদিন হাসানুজ্জামান হাসানের ওপর পড়বে না?

রাকিব নিজে নিজে মাথা ঝাঁকাল। ভাবল, অবশ্যই পড়বে। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1558932 ¾