ব্যর্থতার সফলতা

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

জীবনের মোড় কখন বাঁক নেবে আমরা কখনো কেউ জানি না। প্রতিনিয়ত চেষ্টাই মানুষকে নিয়ে যেতে পারে এক অন্য উচ্চতায়। মূল কথায় আসি। আজকে এ বাস্তব কাহিনির মূল চরিত্র উচ্চমাধ্যমিকের ফল বিপর্যয় উতরিয়ে সাফল্য পাওয়া দুজন।

শাকিল ও মারুফ দুই বন্ধু স্কুলজীবনের বন্ধু। তাদের বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের সিডিএতে। মাধ্যমিক পাস করেছে চট্টগ্রামের স্বনামধন্য স্কুল কলেজিয়েট থেকে। পাসের সাল ২০০১। ফলাফল তেমন একটা খারাপ না। ওই সময় চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে গোল্ডেন জিপিএ প্রাপ্ত কেউ ছিল না। তারপর ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে দুই বন্ধু ভর্তি হলো চট্টগ্রামের আলাদা দুটি কলেজে। পার্থক্য রাস্তার এ পাড় ও পাড়। মারুফ চট্টগ্রাম কলেজে আর শাকিল হাজি মুহাম্মদ মহসিন কলেজে।

জীবনের সেই সোনালি সময়গুলো তাদের কেটেছে বাঁধভাঙা যৌবনের উত্তালতায়। দুই বন্ধু সমসাময়িক দুই কলেজের নামকরা বন্ধুভিত্তিক দুই গ্রুপের কর্ণধার। মারুফের আল-হারাম মোটো ছিল: A Jihad for proxy আর শাকিলের লেজি বয়েজ। কলেজে ফাঁকি দিয়ে দলবেঁধে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে ফুটবল খেলা, আলমাসে মেঘলা দিনে সিনেমা দেখা অথবা বন্ধুর মনের কোণে দোলা দেওয়া প্রেয়সীর ল্যান্ড ফোনে অবান্তর কথা বলা, নয়তো সহপাঠী মেয়ের বাসায় ফোন করে নালিশের বার্তা পৌঁছানোর কাজ। এভাবে স্বপ্নের মতো কাটছিল দিন। শেষ সময়ে টেস্ট পরীক্ষার পর তারা মত্ত হলো টেবিল টেনিস খেলার পাগলপড়া নেশায়। বাসার ছাদের ওপর বসানো হলো টেবিল আর চলতে লাগল শেষদিন পর্যন্ত বলে বলে সন্ধ্যা অবধি খেলা। আরও ছিল এক সপ্তাহের প্রমোদ ভ্রমণ (কক্সবাজার-টেকনাফ-বান্দরবান) পরীক্ষার আগে মন চাঙা করার জন্য। প্রমোদ ভ্রমণে গাড়ি ছিল সঙ্গে। পড়ার মাঝে হারিয়ে যাওয়ার আগে যেন জীবনের শেষ উল্লাস।

২০০৩ সালের কোনো এক মাসের ১৩ তারিখে এইচএসসির ফলাফল দেওয়া হলো। তখন ফলাফলের জন্য শিক্ষা বোর্ডে কেউ পরিচিত থাকলে বা কলেজে ভালো সংযোগ থাকলে ফলাফল আগেই জানা যেত। সবাই দলবদ্ধভাবে গেল কলেজে, কিন্তু ফিরল একাকী সবাই নির্জনে।

মারুফের কাছের বন্ধুরা সবাই কলেজে একই সেকশনে ক্রমিক নম্বরের ক্রমিক ধারাতে ভর্তি হয়েছিল। তাদের ফলাফলের অধঃপতন ৪.২ থেকে শেষতক ফেল পর্যন্ত হয়েছিল।
ফলাফলের পর যা হওয়ার হলো। দুজন বাদে কেউ সরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারল না। জীবনের সবচেয়ে কঠিন ট্র্যাজেডি তারপর শুরু।

শাকিলের বাবা মধ্যবিত্ত। তারপরও ছোট ছেলের বায়না মেটাতে শাকিলকে ভর্তি করাল চট্টগ্রামের আইইঊবিতে টেলিকমে। আর মারুফ ভর্তি হলো নর্থ সাউথের কম্পিউটার প্রকৌশল বিদ্যায়। মারুফের নেশা ছিল ভিএলএসআই ও আরএফ নিয়ে। শাকিলের মোবাইল নেটওয়ার্ক নিয়ে।

শাকিল ব্যাচেলর শেষ করে আমরা নেটওয়ার্ক নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কিছুদিন চাকরি করে পাড়ি জমায় সুইডেনের লিংসপিংয়ে। তারপর সেখান থেকে মাস্টার্স করে। আর তার উত্তরণের গল্প সেখান থেকেই। শাকিল ইন্টারন শুরু করে বেলজিয়ামের এরিকসন কোম্পানিতে যারা মোবাইল সেবায় বিশ্বসেরা ছিল। তারপর জার্মানিতে কিছুদিন ৫জি নিয়ে কাজ করে যোগদান করে ফ্রান্সের ইন্টেলের এক শাখাতে। এরপর ওখান থেকে ডেনমার্কের ইন্টেলে। তারপর তার মনে বাসনা জাগল অটো মোটিভ ডোমেনে কিছুদিন কাজ করবে। বিএমডব্লিউর ক্যামেরা বেইসড চালকবিহীন গাড়ির প্রজেক্টে কাজ করল কিছুদিন। এরপর আবার ফিরে গেল নিজের পুরান কর্ম পরিধিতে। যুক্ত হলো আরেক নামকরা সেমিকন্ডাক্টর প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ইনফিনিয়নের অস্ট্রিয়াতে। এখন অবধি সেখানেই কর্মরত সে।

এর মাঝে শাকিল সহায় হয়েছে অনেক মানুষের চাকরি প্রদানের নিয়ামক হয়ে। যারা প্রবাসে থাকেন তারা নিমগ্ন থাকেন কোনো এক দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে থেকে যেতে কিন্তু শাকিল আজও কর্ম নিয়ে ঘুরে বেড়ায় গ্লোবাল সিটিজেন হয়ে। আত্মবিশ্বাস ও সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য শাকিল আজকে এই অবস্থানে।

আর মারুফ, সেও আছে এক অন্য উচ্চতায়। আমেরিকা পাড়ি জমায় ব্যাচেলর পড়ার পর। মারুফের এক চাচার মতে (There is no country like America)। সে অল্প দিনে মাস্টার্স ও পিএইচডি শেষ করে যুক্ত হয় অধ্যাপনায়। বর্তমানে কর্মরত University of Missouri-Kannas Cityতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। তার অধীনে কর্মরত আছে সর্বমোট পাঁচজন পিএইচডিধারী। তাদের মধ্যে বাংলাদেশিও আছেন। মারুফ ঘুরে বেড়ান তার পাবলিকেশনের কাজে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।

আজকের মারুফ ও শাকিল সেদিন উচ্চমাধ্যমিকের (তখনকার বিচারে তাদের দুজনের ফলাফল ছিল খুব খারাপ) ঘূর্ণিজালে পড়ার পরও দুজন কিন্তু কাজ ও আত্মচেষ্টায় জীবনের এ প্রান্তে এসে এক অনন্য ঘূর্ণি দিয়েছেন।

এ বছর এইচএসসিতে যারা খারাপ ফলাফল করেছ তাদের বলব কেন তোমরা হেরে যাবে। ইংরেজিতে কথা আছে late better than never. তোমাদের যেকোনো সহযোগিতায় পাবে মারুফ ও শাকিলকে। তারা দুজন হতে পারেন তোমার বা তোমাদের জীবনের কোনো এক উপকার বা পরামর্শের মাধ্যম। তাদের দুজনের ফেসবুক লিংক;
শাকিল: <facebook.com/garahman> ও মারুফ: <facebook.com/maruf.vai>।
...

হোসাইন মোহাম্মদ তালিবুল ইসলাম: মিউনিখ, জার্মানি।