জানালায় আসে না কেউ-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জজ কোর্টের দিঘিটা ছিল বিশাল। বর্ষায় সেই দিঘিকে সমুদ্র মনে হতো। যদিও তখনো সমুদ্র দেখিনি আমি। সেই দিঘির পাড়ে শহীদ মিনার। আর ছিল বেশ কিছু নারকেল গাছ। পৈতৃকসূত্রে নয়, গায়ের জোরে সেই নারকেল গাছের মালিক আমরা পাঁচজন—কামাল, সোহেল, জুয়েল,গিয়াস আর আমি।

টানা এক বছর দিঘির পাড়ের সব ডাব খাবার পর গাছ অভিশাপ দিল। কামালের হাত ভাঙল গাছ থেকে পড়ে। জুয়েল তার বাপের হাতে ধরা খেল সিগারেটসহ! আমার দুর্দশার কথা না বলি। সব কথা বলতে হয় না। কিছু কথা মাটির ব্যাংকেই জমা থাক। শুধু এটুকু বলি, আমরা নারকেল গাছের মালিকানা ছাড়লাম। তার সঙ্গে পার্কের দারোয়ান দুই রাকাত শোকরানা নামাজ পড়ল। মোনাজাত দিল দুই হাত তুলে—"হে পরওয়ারদিগার, হে মালিক, তুমি শয়তানের দলকে আর নারকেল গাছমুখী করো না। তাদের হাত থেকে কচি কচি ডাবগুলো রক্ষা পাক। ডাবগুলো নারকেল হোক, আমি একাই খাব!’

নারকেলের গাছের মায়া ভুলে আমার দৌড় তখন জজ কোর্টের দিকে। লোহার গেট পেরোলে কচিকাঁচার মেলা। টাউন হলের মোড় থেকেই বুঝি শোনা যেত হারমোনিয়ামের সুর আর তবলার তাল। সেখানে শুধু কচি না, বুড়োরাও যেতেন। কেউ গান শিখত। কেউ নাচ। আর একদল ছবি আঁকত। আমি নাচ দেখতাম। ছোট মেয়েদের নাচ দেখে ভাবতাম এরা কবে বড় হবে! বড় মেয়েদের নাচ দেখার গোপন ইচ্ছা আমাকে বারবার কচিকাঁচার আসরে নিয়ে যেত। দুই টাকার বাদাম কিনে চার ঘণ্টা বসে থাকার রেকর্ড একমাত্র আমারই ছিল হয়তো।

তারপর কোনো এক সন্ধ্যায় শহীদ মিনারের মঞ্চে বাতি জ্বলল। একদল মানুষ এসে জমা হলো। কোঁকড়া চুলের কালো মতন ছেলেটা খুব ভালো ডায়ালগ দিল। কাঁদল। হাসল। আমি অবাক হয়ে তার অভিনয় দেখলাম। মনে মনে নিজেকে তার জায়গায় বসালাম। একবার, দুবার, বহুবার। নাটক শেষে জানলাম তার নাম পলাশ। জানলাম সে নায়ক। জানলাম নাটকের নাম—‘ফলাফল নিম্নচাপ’।

দলের নাম লক্ষ্মীনারায়ণপুর থিয়েটার। দলনেতার নাম ফরিদ উদ্দিন। আমার বন্ধু সোহেল ফরিদ ভাইকে চিনত। একদিন নিয়ে গেল তার কাছে। আমি বললাম অভিনয় করতে চাই। তিনি বললেন, এক কপি ছবি আর ফরম জমা দিতে। ফি ৮০ টাকা। ফরম ফ্রি। ছবি আর ৮০ টাকার চিন্তায় আমার তখন ঘুম হারাম। অগত্যা আম্মার ব্যাগ থেকে বিসমিল্লাহ বলে এক শ টাকা সরাই। টাকা চুরির অপরাধে আমার কী রকম রিমান্ড হয় সেই সহজ কথাটা বলা যাবে না। সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় কী বলা সহজ!

শুধু এটুকু বলব, আমি নাটক ছাড়িনি। লক্ষ্মীনারায়ণপুর থিয়েটারের আমি তখন গর্বিত সদস্য। দলের সবচেয়ে দস্যু ছেলে। সোহেলের জন্য, শুধু সোহেলের জন্যই আমার থিয়েটারওয়ালা হওয়া। আমার স্বপ্ন পূরণ ওর হাত দিয়ে।

সোহেল আমার বন্ধু ছিল।এখন অনেক দূরে। মেলা দূরে। বহু দূরে। আট নম্বর ব্রিজের নিচে সেদিন নিয়ন আলো টলমল করছিল। কিছু সুখী মানুষ সে আলোয় ডুবে ছিল। কিছু প্রেমিক মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে চুরি করেছিল প্রেমিকার কাপা কাপা লাজুক ঠোঁট! আমি কেবল কেঁদেছিলাম। আট নম্বর ব্রিজের নিয়ন আলোর নিচে বসে আমি কেঁদেছিলাম পুরো একটা সন্ধ্যা। রাস্তায় রিকশার টুংটাং শব্দ, ফকিরের সুর করা গান, আর কিছু অবাধ্য কাকের কর্কশ ডাক আমার কান্নার সঙ্গে মিলেমিশে অচিন এক ভায়োলিন হয়ে বেজেছিল। আমার কান্নাটা ছিল সোহেলের জন্য। কারণ সোহেলের মারা যাওয়ার খবরটা সেদিনই পাই।

বড় মসজিদের ইমাম সাহেব চোখে সুরমা পরতেন কিনা মনে নেই। কিন্তু সাজ্জাদ পরত। শুক্রবার হলে সুরমা আর আতরে মাখামাখি সাজ্জাদ বড় মসজিদে যেত। সঙ্গে আমি। নামাজ শেষে হুজুরের লম্বা মোনাজাত। সেই মোনাজাত শেষ করে আরও কিছু লম্বা সময় বসে থাকতাম আমরা। কারণ মিলাদ। মিলাদ পড়লে সওয়াব আর জিলাপি দুটোই মেলে। এটা সাজ্জাদের কথা। আমি চিন্তায় পড়ে যেতাম। সন্দেহ হতো। ইমান নিয়ে টানাটানি। সওয়াব না জিলাপি, কোনটার জন্য শুক্রবার হলেই সাজ্জাদের বড় মসজিদে ছোটা।

সাজ্জাদ আমার বন্ধু। চেহারা সুন্দর। কথা বলে সুন্দর। কয়েকটা পার্টটাইম প্রেমও করে। বর্ষা নামের তার সাবেক প্রেমিকার বাসায় গিয়ে চাবিস্কুট খাবার বদলে ঝাড়ু পেটা খেতে হয়েছিল তাকে! প্রেমিকদের চামড়া নাকি গন্ডারের হতে হয়। আমার ধারণা সাজ্জাদের চামড়া লোহার। ১০০ ভাগ আফ্রিকান খনি থেকে তৈরি লোহা!

মাইজদী শহরের সবাই তার মামা। সোনাপুর থেকে চৌমুহনী যতবার সাজ্জাদের সঙ্গে গেছি পথে এক শ জন মামার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে সে। ওর সঙ্গে রাস্তায় বের হওয়া মানেই মামা ডাক শোনা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাজ্জাদের বন্ধু হলে কখনো লিখতেন না, ‘আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা, আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা...।’
তিনি লিখতেন, ‘মামু আমার মামু ওগো, মামু ভুবন-ভরা...!’

মামু কাশেম ভালো মানুষ। মাথায় হাতে গোনা ৫০টা চুল তার। সাদা কোটে তিন কালারের বোতাম। ফ্যাশন নাকি অভাবে, কী জানি! মামুর গালের দিকে তাকালেই আমার কানে বাজত শাহ আবদুল করিমের গান, ‘বসন্ত বাতাসে সইগো-বসন্ত বাতাসে, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে সইগো-বসন্ত বাতাসে...।’
কাশেম মামুর গাল ভরা বসন্তের দাগ ছিল বলেই আমার এই গান যন্ত্রণা।

সেদিন বসন্ত ছিল না। শুক্রবার ছিল। সেদিন সুরমা আতর মেখে সাজ্জাদ আর আমি বড় মসজিদে যাইনি। গিয়েছি শাওন কমিউনিটি সেন্টারে। মামু কাশেম গলা না, নাক সমান খাওয়াল আমাদের। ফেরার পথে সুগন্ধা বাসে বসে সাজ্জাদ মিষ্টি পান চিবায় আর ঝিমায়। আমি বলি, কার বিয়ে খেলাম! তোর কাশেম মামুর আত্মীয়?
সাজ্জাদ হাসে। সুগন্ধা সুপারের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। মানুষ খোঁজে। কারও গায়ে পানের ফিক ফেলে! গালিটা কান পর্যন্ত না আসতেই বাসটা চলে যায় শব্দ করে।

আমি আবার বলি, বিয়েটা কার খেলাম? কাশেম মামুর আত্মীয়?

সাজ্জাদ চোখ বন্ধ করে বলে, কাশেম মামু কমিউনিটি সেন্টারের দারোয়ান। যত দিন এই পোস্ট মামুর থাকবে তত দিন আমরা অতিথি। রাজভোগ খাবারের সম্মানিত অতিথি!

বিয়ে, জন্মদিন, সুন্নতে খতনা যা কিছুই হোক না কেন, পরবর্তী দুই বছর মাইজদী শহরের প্রতিটা প্রোগ্রামে সাজ্জাদ আর আমি ছিলাম সম্মানিত অতিথি হয়ে। সবগুলো কমিউনিটি সেন্টারই দখলে ছিল আমাদের। মামা কাশেমের গুনে নয় সাহসের গুনে। অসংখ্য জামাইয়ের দুই পাশে দুই হাত ধরে আমরা দুজন হাসিমুখে বিয়ের গেটে ঢুকেছি। ফিতা কেটে তুলে নিয়েছি টেবিলে রাখা টাকা। জামাইয়ের প্লেট থেকে তুলে নিয়ে খেয়েছি আস্ত মুরগি। বউয়ের পাশে বসে কাটা চামচ দিয়ে সাবাড় করেছি কেজি কেজি মিষ্টি।

২০০১ ও ২০০২ সালের মাইজদী শহরের প্রতিটা বিয়ের ভিডিওতে আমাদের পাওয়া যাবে। সেই লাজুক বউগুলো হয়তো এখন চাচি, খালা, নানি। জামাইগুলো হয়তো কেউ কেউ স্বর্গে। বউয়ের অতি আদরে নয় অত্যাচারে! আর যারা সুখে আছেন, বিকেল হলে জলপাই আচার মেখে ঝাল মুড়ির বাটি হাতে বসেন। তারাও মাঝে মাঝে স্মৃতিচারী হন। কোনো কোনো মরা রোদের বিকেলে পুরোনো অ্যালবাম নিয়ে বসে যায় পুরো পরিবার। অথবা মুগ্ধ হয়ে দেখে সেই ভিডিওগুলো।

আজকের দিনে সেই বউটা চিন্তিত হন আমাদের দেখে। বিয়ের অ্যালবাম অথবা ভিডিওতে তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ দুটো ছেলেকে দেখে। ছেলে দুটোকে কোনোভাবেই চিনতে না পেরে তারা হয়তো অস্বস্তিতে ভোগেন। তাদের দুপুরের ঘুম নষ্ট হয়।

বাইরে তখন কোকিল ডাকে। মরার কোকিল তাদের ঘুমাতে দেয় না। বেবি নাজনীন ঠিকই ঘুমান। একটা ট্রেন পুরো শহর কাঁপিয়ে চলে যায় দিগন্তের দিকে। একটা অন্ধ ভিখিরি বটতলায় বসে গান গায় বেসুরো সুরে—আল্লার কাছে সবই আছে একটা জিনিস নাই, নাইরে মিথ্যা নাই, আমার আল্লা নবীজির নাম!

একটা কিশোরী কাপা কাপা হাতে গোপনে লিখে চলে প্রথম ভালোবাসার চিঠি—‘প্রিয় রাজপুত্র, আমি তোমার ঘোড়ার পিঠে চড়ে পালিয়ে যেতে চাই ভালোবাসার শহরে!’

একটা আমি তখন জানালার পাশে বসে স্নো পড়া দেখি। আমেরিকার উইলমিংটনে বসে। ব্লাডিমেরির গ্লাস হাতে জনি ক্যাশ তখন গেয়ে চলে-

You are my sunshine, my only sunshine
You make me happy when skies are gray
You'll never know dear, how much I love you
Please don't take my sunshine awa!

আর একটা সাজ্জাদ তার অতি আদরের কন্যাকে শোনায় ঠাকুর মার ঝুলি । ব্যাঙ রাজপুত্তুরের গল্প। ইতালির কোনো এক শহরে বসে! (চলবে)

হিমু আকরাম: নাট্যকার ও পরিচালক, নর্থ ক্যারোলাইনা, যুক্তরাষ্ট্র। ইমেইল: < [email protected]>