এত কাছে, তবু যায়নি ছোঁয়া!

এশিয়া কাপ ফাইনালে দুবাই স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে লেখক (সর্ব ডানে)
এশিয়া কাপ ফাইনালে দুবাই স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে লেখক (সর্ব ডানে)

পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়টা যখন শুধু সময়ের ব্যাপার, আমি তখন কাজে ব্যস্ত। আমি আমার কর্মস্থলে রাতের শিফটে কাজ করছিলাম।

বাংলাদেশের এশিয়া কাপ ফাইনাল নিশ্চিত। অনলাইনে ঢুঁ মারলাম টিকিট কিনতে। এত কাছে এশিয়া কাপ জয়ের মিশনে নামবে প্রিয় মাতৃভূমি আর আমি দেখব না, তা কী করে হয়!

কিন্তু হতাশই হতে হলো। সব টিকিট শেষ। বাকি আছে শুধু হসপিটালি বক্স। সেই টিকিট তো আমাদের নাগালের বাইরে। টিকিট শেষ হওয়ার প্রধান কারণ ভারতের ফাইনাল নিশ্চিত হয়েছিল আগেই। বেশির ভাগ টিকিট তারাই কিনে রেখেছিল। অন্যদিকে আফগানিস্থানকে হারিয়ে পাকিস্তানিরা ভেবেছিল তারাও ফাইনালিস্ট। তারা ভেবেছিল পাকিস্তান দল বাংলাদেশকে তো হেসেখেলেই উড়িয়ে দেবে। তাই টিকিটের বাকি অংশ পাকিস্তানিরা কিনে নিয়েছিল।

বন্ধু হাসান ভাই লেগে ছিলেন ফেসবুকে সেই সব পাকিস্তানিদের খোঁজে, যারা টিকিট কিনে বসেছিল ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল দেখার আশায়! অনেককে পাওয়া যাচ্ছিল, কিন্তু এদের বিশ্বাস করা কঠিন। এক টিকিট কয়েক বেচা দিতে পারে! অবশেষে যাচাই বাছাই করে একজনকে কিঞ্চিৎ বিশ্বাস করা গেল। পাঁচটা টিকিট পাওয়া গেল। অবশ্য নির্ধারিত দামের চেয়ে সামান্য কিছু বেশি দিতে হয়েছিল। এই শঙ্কাযুক্ত সোনার হরিণ তবুও তো পেলাম। শঙ্কাযুক্ত এ জন্য বলছি, ই-টিকিটের ফটোকপি দিয়েও আমাদের আগে যেকেউ প্রবেশ করতে পারবেন।

বৃহস্পতিবার সারা রাত কাজ করে বাসায় ফিরেছি সকাল আটটায়। মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমিয়ে উঠে গেলাম। একটু আগেই যেতে হবে স্টেডিয়ামে। কারণ শঙ্কাযুক্ত টিকিট। প্যাকেট করে নেওয়া হলো দুপুরের খাবার। পথে আদায় করলাম জুমার নামাজ।

স্টেডিয়ামের বাইরে গাড়ি রেখে গাড়ির ভেতরেই সারলাম খাবার। ওখান থেকে হাঁটা দূরত্ব বিশ মিনিট। পেইড পার্কিংয়ে আবার ৫০ দিরহাম গুনতে হয়। তাই কিছুটা দূরে গাড়ি রেখে হেঁটেই রওনা হলাম আমরা।

এশিয়া কাপ ফাইনালে দুবাই স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে পতাকা হাতে লেখক
এশিয়া কাপ ফাইনালে দুবাই স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে পতাকা হাতে লেখক

স্টেডিয়ামের গেট খোলা হয়ে গেছে ততক্ষণে। পথে দেখলাম পাকিস্তানি আর কিছু বাংলাদেশি ভাইয়েরা পতাকা বিক্রি করছেন। একটা নিলাম আমরা। সেই পতাকা নিয়ে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। খেলা শুরু হলো। স্টেডিয়াম পরিপূর্ণ। ভারতীয় সমর্থকই বেশি। বাংলাদেশিরা অনেকেই টিকিট না পাওয়ায় আসেননি। আবার কেউ এসে ফিরে গেছেন।

টসে হেরে ব্যাটে নেমে দারুণ খেলতে থাকে বাংলাদেশ। গ্যালারি জুড়ে চিৎকার আর উল্লাস—বাংলাদেশ, বাংলাদেশ! চুপচাপ শুনে যাচ্ছে ভারতীয়রা। মিরাজের আউটে নড়েচড়ে বসল তারা। গ্যালারিতে তখন জয় হিন্দ, জয় হিন্দ চিৎতার শুরু হলো। কখনো বাংলাদেশ, কখনো ভারত, গ্যালারি সব সময় উল্লসিতই ছিল। বাজছিল হিন্দি গানের পাশাপাশি বাংলা গানও—বেশ বেশ বেশ, শাবাশ বাংলাদেশ। গলা মেলাচ্ছিলাম আমরা। আর নাচের কথা কী বলব, কোমর না দোলানো কাউকে পাওয়া যাবে না মনে হয়, কী বাংলাদেশি, কী ভারতীয় সবাই নেচেছেন!

বাংলাদেশের উড়ন্ত সূচনা ছিল। মাঝপথে আবার খেই হারিয়ে ফেলা সেই চেনা ব্যাধি! ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল যখন ঠিক তখনই লিটনের বিতর্কিত আউট! উত্তপ্ত গ্যালারি, প্রতিবাদ চলছিল উচ্চ স্বরে। অনেকেই চোখ বেঁধে প্রতিবাদ করেছিল।

অনেক বড় স্কোরের আশা জাগিয়েও বাংলাদেশকে থেমে যেতে হলো ২২২ রানে। ভারতের জন্য এটা মামুলি স্কোরই বটে। কিন্তু আমরা যেদিন লড়ি সেদিন স্কোর কোনো ফ্যাক্টরই না।

অসাধারণ বল করেছেন রুবেল, মোস্তাফিজ ও মাশরাফিরা।

খেলার মাঝপথে আমি একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম: আমরা শেষ বলেও আশ রাখি, তোমরা এগিয়ে চলো মাশরাফি...।

আমার এই স্ট্যাটাস তারা দেখবেন না, তবুও নিজেকে নিজের সাহস জোগানোর জন্য লেখা। শেষ বল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল ম্যাচ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হেরেই যেতে হলো। লড়াই করেছি ঠিকই, জেতা হলো না।

দিন শেষে পৃথিবী শুধু বিজয়ীকে মনে রাখে! হেরে যাওয়াদের ভুলে যায়, ভুলে যায় ব্যবধান, হারার কারণ। সব ভুলে যায়, সব।

খুব কাছ থেকে দেখে আসা ট্রফিটা মাশরাফির হাত দিয়ে নিজে ছুঁয়ে দেব, এই প্রত্যয় নিয়ে গিয়েছিলাম স্টেডিয়ামে। ফিরে এলাম সাগর দেখেও পানি না ছুঁয়ে আসার মতো অনুভূতি সঙ্গে করে! অথবা এত কাছে, তবুও যায়নি ছোঁয়া!

মোহাম্মদ জাহেদুল আলম: জুলেখা হাসপাতাল, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত।