আবদুল খালেক একাডেমি

আবদুল খালেক একাডেমির বারান্দায়
আবদুল খালেক একাডেমির বারান্দায়

স্কুল দেখা নয় কেবল, প্রকৃতির কাছে যাওয়া। প্রিয়ভূমির স্পর্শ নয় শুধু, প্রাণের মানুষদের দেখা। আবদুল খালেক একাডেমি সম্পর্কে বলতে গেলে এমন কথাগুলো অনিবার্যভাবে চলে আসে। ইচ্ছে করলেও এড়ানো সম্ভব হয় না।

শ্রাবণের বৃষ্টি নামে। কখনো থামে, কখনো নামে। লাকি হালদার উল্কার প্রিয়স্থানও এই একাডেমি। বললেন, তাতে কী, এরই মধ্যে যেতে হবে। ইচ্ছে প্রবল থাকলে কোনো বাধাই বাধা নয়। তা ছাড়া, বৃষ্টিতো প্রকৃতিকে সৌন্দর্য দান করে। অন্য কথায় এটা প্রকৃতিরই অংশ। সুতরাং অনির্বাণ যাত্রা আমাদের। আমরা চললাম।

জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় বারবার ফিরেছেন বাংলার প্রকৃতির কাছে। আর কোনো কবির কবিতায় এমন করে বাংলাদেশ কিংবা তার লতা গুল্ম, গাছগাছালি, ফুল, পাখি আসেনি। আমরা সেদিন মুকসুদপুরের পূর্বা-দুর্বা ছায়ানীড় থেকে বেরোই। জীবনানন্দের গ্রাম কমলাপুর দিয়েই ছুটছি।...শিরীষের ডাল, অশ্বত্থের চূড়া, অর্জুনের বন, বিজন ঘাস, শ্রাবণের আকাশ পার হয়ে যাচ্ছি। কলমির ঘ্রাণ, গঙ্গাফড়িং, চড়ুই, দোয়েল...সব সব নিয়ে চলছি।

শহীদ মিনারের সামনে
শহীদ মিনারের সামনে

পৌঁছে যাই সরাসরি স্কুলে। বৃষ্টি পথে নামে না। নামে স্কুলে, স্কুল মাঠে। প্রথম দৃশ্যটি এ ক্ষেত্রে বড়ই প্রাঞ্জল। মাঠে ফুটবলের ঈশ্বরেরা খেলছে। বল নিয়ে দৌড়াচ্ছে। বাণিজ্য ভবন, বিজ্ঞান ভবন থেকে শোরগোল হচ্ছে। গোলে রাজীব...গোলে। বল চলে যায় আজিজুলের পায়ে। সে বল নিয়ে প্রতিপক্ষের দিকে ছুটতে যাওয়ার পথে অন্য একজন কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। পাসিং করে নিজের দলের কারও পায়ে সেই বল যায়। হ্যাঁ, কিরণ..সে এগিয়ে যায় গোলের দিকে। গোল...গোল...আবার শোরগোল ওঠে। না, গোল হয় না। বল ধরে ফেলে সাগর। রক্ষণ ভাগ থেকে সাব্বির এগিয়ে দেয় বল। সে বল আরেক গোলবার পর্যন্ত যায়। তবে গোলের চেষ্টা ব্যর্থ হয় এ যাত্রায়।

বৃষ্টি নামে। এক পাশে টিউবওয়েল। ছেলেরা এখান থেকে জল তুলছে। বৃষ্টি বলছে, দুষ্টু বন্ধুরা তোমরা আর কতটুকু জল তুলবে। আমার জলে গা ধোও। বাণিজ্য ভবনে টিনের শেড। ঝম ঝম করে বৃষ্টি আসে। টিনে পড়ে বৃষ্টির এ শব্দ আলাদা শিহরণ আনে মনে। ছেলেরা গা ধুয়ে নেয়। টিউবওয়েল বুঝি রাগ করে। বলে, আমার আদর কেবল গ্রীষ্মে! বৃষ্টি মুখ টিপে হাসে। অঝোর ধারা তার। সঙ্গে বাতাস। ছেলেরা আনন্দ করে। ভিজে মনের মতো। আমি আমার শৈশবকে ছুঁয়ে ফেলি।

ফুটবলের ঈশ্বরেরা
ফুটবলের ঈশ্বরেরা

বৃষ্টি থামে, আবার নামে। এইভাবে আবার থামে, আবার নামে। আমরাও অবস্থান বদল করি। মূল ভবনে যাই। টিফিনের সময়। শিক্ষকেরা আজ করছেন সচল গল্প। অতিথির সামনে বসে থাকা যায় না। তাই সবাই দৌড়ান, সবাই ব্যস্ত। তাঁদের সঙ্গে আলাপ হয়। প্রাণের কথায় আমরা আগের সময়টিকে আবিষ্কার করি। খুব বেশি পার্থক্য ধরা পড়ে না। এখনকার সঙ্গে মেলাতে। তার কারণ আমরা বাড়িতে এলেই এখানে ঢুঁ মারি। কখনো কখনো আত্মীয়দের নিয়ে আসি।

এর আগে এসেছিলেন আমার মামণি। অঞ্জু হালদার। স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেই কাটালেন দীর্ঘ সময়। অবসর নিয়ে এখন সময় কাটান নাতি-নাতনিদের সঙ্গে। ওই সময় বলেছিলেন, কী সুন্দর জায়গাটি! গাছপালা ঘেরা পরিবেশ। ছেলেমেয়েরা প্রকৃতির কাছ থেকেই শিখে যায় অনেক কিছু। ঠিকই তাই। এই তরুলতা লতাগুল্মের সঙ্গে জীবনকে জড়িয়ে নিতে পারলে দেশ ভালোবাসাও চাঙা হয়ে ওঠে।

এ প্রমাণতো চোখের সামনে দেখি আমরা। ছেলেরা পাশ করে, আবার সময় পেলে ঘুরে যায় এই ক্যাম্পাস। প্রিয় অঙ্গন বলেই তারা বারে বারে ফিরে আসে।

ওরা আনন্দের দূত
ওরা আনন্দের দূত

এই দিন মনে পড়ছিল আরেকজনের কথা। খুব বেশি করেই তার মুখখানি ভেসে আসছিল। গুরুদাস সরকার। মূলত এই স্কুল গড়ার পেছনে তারও ছিল অবদান। এই স্কুলের প্রতি আগ্রহী করার জন্য অভিভাবকদের মধ্যে তিনিও কাজ করেছেন। এখানে আগে গার্লস স্কুল গড়ার চিন্তা করেছিলাম আমরা। উপজেলাসংলগ্ন বেদখল বিশাল একটি জায়গা ছিল আমাদের অন্য এক আত্মীয়ের। সে জমির ন্যায্য মূল্য দিতে চেয়েছিলাম আমরা। সে দরবারেও তিনি শক্তিশালী ভূমিকা নিয়েছিলেন। যা হোক, শেষ পর্যন্ত সে প্রকল্প আমাদের সফল হয়নি। তবে দুই বছর আগে খালেক একাডেমির এক অনুষ্ঠানে তার প্রার্থনা ছিল, এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা যেন মানুষের মতো মানুষ হতে পারে।

বিজ্ঞান ভবনের ভেতরে যাই। পাঠাগার দেখতে চাই। বারান্দায় ঘুরি আমরা। ছাদে ফাটল ধরেছে। এর সংস্কারের কথা জোরেশোরে তুলে ধরা হয়। উপেন্দ্র বিজ্ঞান ভবন। এর সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক আমার। এ সম্পর্কে মন্তব্য ফাইল মেলে ধরেন প্রধান শিক্ষক। সেখানে লিখি যা বলতে চাই। রক্তের ঋণ শোধ করা যায় না। এ স্কুল নিয়েও আছে আমার ভাবনা। সুতরাং দায়িত্ব পালনে বিচ্যুত হব না। তাদের গরজ বেশি। কিন্তু যে তার কলজেটা দিয়ে রেখেছে, তাকে কী দ্বিতীয়বার শপথ পড়াতে হয়! হয় না, তবে সময় বদলেছে। মানুষ তার ভেতরকার মানুষটির কথাও শোনে না। কাজেই, এ পরীক্ষায় পরীক্ষার্থী যে আগেই উত্তীর্ণ, সে বার্তা তাকে কে দেবে!

বারান্দায় যাই, ছাত্রীরা দল ধরে আসে। কথা বলি ওদের লেখাপড়া নিয়ে। অবয়বে মেধা জাজ্বল্যমান। শুনি কতটুকু দূরে তাদের বাড়ি। কতটা সময়ই বা হাঁটতে হয়! না, খুব বেশি দূরে নয়। পাখির কলতানে গাছের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে তারা চলে আসে। সামনের দিকে তাকাই। একদিকে কলাগাছের সারি। তারই পাশ দিয়ে পাটখেত। উত্তর দিকে উঠে গেছে সরু পথ, মিলেছে মূল রাস্তার সঙ্গে। এই পথও এক সময় চলার মতো ছিল না। এসবই আবাদি জমির অংশ। এদের জন্য আলাদাভাবে কিছু জায়গা কিনে সংযোগ পথটি করা। এখন ওরা সহজেই স্কুলে যাওয়া আসা করে।

স্কুলে গেলে শহীদ মিনারে না গিয়ে পারি না। পূর্ব-দক্ষিণ কোণে মাঠের শিক্ষক মিলনায়তন ঘেঁষে এই চত্বর। মা তার গুলিবিদ্ধ সন্তান নিয়ে দাঁড়ানো। লোহার রড আর ইট-কংক্রিট দিয়ে বানানো। শহীদ মিনারের গল্প। আমি মনে করার চেষ্টা করি পেছনের ঘটনাটি। ভাষার ভালোবাসায় মায়ের সন্তানেরা সেদিন রাজপথে নেমে এসেছিল। ক্ষমতার লোকেরা সহ্য করেনি। তারা গুলি চালায়। ’৫২ পেরিয়ে ধাপে ধাপে ’৬২, ’৬৯। শেষতক একাত্তর। চূড়ান্ত পর্বে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয়। মনে মনে বলি, এ আমাদের গৌরবের মাইল ফলক।

শিক্ষক মিলনায়তন
শিক্ষক মিলনায়তন

নিচে সবুজ ঘাস। পাশে ঝুঁকে পড়েছে গাছের ডাল। মেহগনি, জাম, জামরুল সবই আছে সেখানে। সবুজ দিয়ে ঘেরা চারপাশ। ফড়িং, কীটপতঙ্গ আবিষ্কার করি। এক ধরনের বুনো গন্ধ পাগল করে দেয়। কী চমৎকার অনুভূতি! বৃষ্টি ভেজা ঘাসের গন্ধ নিয়ে ফিরি। আবার আলাপ। চা, মিষ্টি আসে টেবিলে।

এরপর গেলাম স্কুলের পরিচালনা পরিষদের সভাপতির বাড়িতে। ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে তার। ঢাকায় একটি হাসপাতাল থেকে ফিরে এলেন। এবার বীরত্বের গল্প! সাংবাদিক ছড়াকার ফয়েজ আহমদ একবার চীনে কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে গিয়েছিলেন পাসপোর্ট ছাড়াই। ভিসারতো প্রশ্নই ওঠে না। এ সম্মেলনে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক কমরেডরা তাকে সহযোগিতা করেছিলেন। লুৎফর রহমানকে কে সহযোগিতা করেছেন! তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র না নিয়েই চলে এসেছেন। আমরা তার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনলাম। বললেন, বয়স তো কম হলো না। সমবয়সী অনেকেই বিদায় নিয়েছেন। না, শিক্ষকেরা কিংবা আমরা কেউই তাঁকে বিদায় দিতে চাই না। প্রচলিত নিয়মের বাইরে কিছু করার সাহস কয় জনেরই বা আছে! বললাম, স্কুলের কাজে এমন বীরের প্রয়োজন।

শিক্ষক মিলনায়তন
শিক্ষক মিলনায়তন

সুস্বাদু আম এল। বোধকরি, তার নিজের বাগানের। আরও আরও গল্প হলো। প্রকৃতির মধ্য দিয়ে আমরা পা বাড়ালাম পথের দিকে। বৃষ্টি ঝরছে। শিক্ষক-শিক্ষিকা মিলে আমরা বহরে পনেরোজন হব। ছাতা আছে সবার হাতে। তারপরও আমরা ভিজে কিংবা না ভিজে ছুটি। চলি গ্রাম আর তার প্রকৃতির মধ্য দিয়ে। । জীবন্ত হয়ে উঠি, পেছনে ফেলা শৈশব আর কৈশোর খুঁজি। আর হয়তো তালাশ করি জীবনানন্দের সেই বেতফলের মতো ম্লান চোখের মেয়েটিকে। জানি না, জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে কোথায় সে চলে গেছে! মূল রাস্তায় এসে অন্যেরা যায় তাদের গন্তব্যে আর আমরা চলি নিসর্গের ঠিকানায়। সে নাম চাঁদহাট গ্রাম, পুণ্যভূমি আমার।
...

নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত। ইমেইল: <[email protected]>