জানালায় আসে না কেউ-তিন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আবদুল কাদের একটা মিষ্টি মুখে দিয়ে তিন মিনিট চোখ বন্ধ করে থাকেন। আয়েশ করে মুখ নাড়েন। তার সামনে প্লেট ভরা মিষ্টি। ওজন প্রায় হাফ কেজি। সংখ্যায় এগারোটি। সুধীর বাবুর দোকান মিষ্টির জন্য সেরা। উদয় সাধুর হাট মিষ্টির জন্য বিখ্যাত। আর সুধীর বাবু সেই হাটের মহান কারিগর। মিষ্টির কারিগর।

আমার ধারণা বাপ্পি লাহিড়ী সুধীর বাবুর দোকানের মিষ্টি খেয়েছেন। খেয়ে বড় ভাই আবদুল কাদেরের মতো তিন মিনিট চোখ বন্ধ করে ছিলেন। তারপর মিউজিক করেছেন অমর প্রেম ছবির বিখ্যাত সেই গান—‘মিষ্টি মেয়ে গো মনে রেখ,/ মিষ্টি ছেলেগো মনে রেখ।’ বাপ্পি লাহিড়ীর গানটা হিট হয়েছে আমাদের সুধীর বাবুর দোকানের মিষ্টি খেয়ে। সুধীর বাবু এক মহান মিষ্টি কারিগরের নাম! বাপ্পি লাহিড়ীর গানের ক্যারিয়ার গড়ে দিয়েও তিনি নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন। মহান ব্যক্তিদের জীবন বুঝি এমনই হয়!

আমি গভীর আগ্রহে আরেকজন মহান ব্যক্তির মিষ্টি খাওয়া দেখি। আমরা একই সঙ্গে পড়লেও তাকে ভাই ডাকতে হয়। ম্যাট্রিকে দুই বার ফেল করে তিনিও মহান উপাধি পেয়েছেন। একই ক্লাসে পড়েও বড় ভাই হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন! এখন তৃতীয় ও শেষ বারের মতো ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি তার।

প্রতি হাটবারে আবদুল কাদের ভাইয়ের সঙ্গে আমার গোপন মিটিং হয়। প্রতি মিটিংয়ে আমার আধা কেজি মিষ্টি জলে যায় আর কুমিরে খায়। কুমির আবদুল কাদের ভাই নিজেই। মিটিংয়ের প্রথম ৩৩ মিনিট আমি কোনো কথা বলি না। চুপ করে বসে থাকি। শোক সভায় এক মিনিট নীরবতা পালন করার নিয়ম। আর আমি বিনা শোকে ৩৩ মিনিট নীরব থাকি।

বড় ভাই আবদুল কাদের প্রতিটা মিষ্টি মুখে দিয়ে তিন মিনিট চোখ বন্ধ করে রাখেন। আরামে। আধা কেজিতে এগারো পিস মিষ্টি হয়। তিন মিনিট করে এগারোটা খেতে আবদুল কাদের তেত্রিশ মিনিট সময় নেন। আমি সেই তেত্রিশ মিনিট নীরবে বসে থাকি। পকেটে হাত দিয়ে দেখি টাকাটা ঠিকমতো আছে কিনা। কুমিরের মিষ্টির দাম তো আমাকেই দিতে হবে!

দোকানের পেছনে মজা পুকুর। সেখানে আধমরা নারকেল গাছ। মরি মরি করেও মরে না। বাঁকা হওয়া নারকেল ডাল জল ছুঁই ছুঁই। সেই জলে এক শালিকের ছায়া দেখি। এক শালিকের দুঃখে আমিও দুঃখিত হই। জোড়া শালিক দেখার অপেক্ষা মেটার আগেই একলা শালিকটা পালায়। শালিকও থাকে না আমার হয়ে। থাকে শুধু নির্মলেন্দু গুণ আর কবিতা ‘ওইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্ফনি; ওই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল তুমিই থাকনি!’

বাজারের গলিতে হকার নুরুল্লাহ ঠিকই থাকে। হেঁটে যায় এ মাথা ও মাথা। হাত মাইকের শব্দ আসে কানে, ‘চোরার ঘরে চোরা তেইল্লা চোরা, জায়গায় খাইয়া জায়গায় ব্রেক, কাইত হইয়া খায় চিইত হইয়া মরে, লাফাইয়া খায় দাফাইয়া মরে। ময়নার মার ঘুম নাই, সখিনার মার খ্যাতা নাই!’

ময়নার মার ঘুম আর সখিনার মার খ্যাতা নিয়ে আমি চিন্তিত না। তবুও দোয়া করি। তারা ঘুম আর খ্যাতা ফিরে পাক! বারেলাহির কাছে দুই হাত তুলি, ‘হে বারেলাহি, হে করুণাময়। তুমি ময়নার মার চোখে ঘুম দাও। এমন ঘুম দাও যেন ময়নার বাপে পিটিয়েও সেই ঘুম ভাঙাতে না পারে! আর সখিনার মার খ্যাতা ঠিকঠাক থাকুক। কাশ ফুল তো ফুটেছে। শীত এল বলে।’

আমার চিন্তা হয় শুধুই কাদের ভাইকে নিয়ে। তেত্রিশ মিনিট চোখ বন্ধ রাখার পর তিনি নিজেই ঘুমিয়ে পড়েন কিনা! কারণ কাদের ভাইয়ের কাছেই আমার প্রাণভোমরা। তিনি সেটা লুকিয়ে রেখেছেন রূপকথার গল্পের সেই একচোখা দৈত্যের মতো। গভীর সাগরের নিচে, পাতাল পুরিতে ছোট্ট এক ঝিনুকের খোলে।

সেই প্রাণভোমরার নাম ‘চিঠি’। আমার পাওয়া প্রথম ভালোবাসার চিঠি। যে চিঠিতে শাখি নামের মেয়েটি ভয়ংকর বাজে হাতের লেখায় লিখেছে অসাধারণ এক প্রেমের উপাখ্যান। কবিতার মতো করে সেই সব চুপচাপ কোনো দুপুরবেলার গল্প—‘খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড় একা লাগে...!’

আমি ভেবে খুশি হই, আমার জন্যই শাখির একা লাগে! আমার ভেতরে তখন এক শ পুঁটি লাফায়, শিমুলের ফল শব্দ করে ফেটে মেঘের মতন ওড়ে, কোটি কোটি শোল মাছের পোনা লেজ নাড়িয়ে ছুটে বেড়ায়।

আমি তখন প্রেমিক। আমি মেল গিবসনের সেই ব্রেভ হার্ট। প্রেমিকার জন্য উন্মাতাল এক যোদ্ধা! বুক পকেটে ভালোবাসার চিঠি নিয়ে আমি চৈত্রের পোড়া রোদে হেঁটে বেড়াই। নিজে নিজেই পুড়ি। স্কুলে যাই না। তখন ঝিমঝিম লাগে। সুখ সুখ লাগে ৷ একা একা লাগে! অকারণে দুঃখ বিলাসী হই। প্রেমের চিঠির উত্তরে আমার লিখতে ইচ্ছা করে ব্যথার কথা। তিন টাকার ইকোনো বলপেনে তাই লিখি—

‘একদিন ঘুম ভাঙা সকালে খুব মেঘ ডাকবে, ঝড় বইবে!
একদিন ঘুমহীন রাতে আমার জন্য বুকের খুব গহিনে কান্না জমবে তোমার!
সেই মেঘ বাদলের দিনে,
সেই কান্না কান্না দিনে,
সেই শূন্য শূন্য দিনে,
আমিও অভিমানী হব। অকারণ অভিমান!
অভিমানী মানুষটা আর ফিরে আসবে না, অভিমানীরা কখনো ফিরে আসে না শীতের পাখির মতো...!’

অভিমানীরা শীতের পাখির মতো ফিরে না এলেও আমি বারবার ফিরে আসি। প্রতি হাটবারে। কাদের ভাইয়ের কাছে। আধা কেজি মিষ্টি কিনে দিয়ে অনুনয়-বিনয় করি চিঠিটা ফেরত দেওয়ার জন্য।

বইয়ের ভাঁজ থেকে শাখির চিঠিটা চুরি করে নিয়ে কাদের ভাই এখন কোকাফ শহরের জিন। সপ্তাহে আধ কেজি করে মিষ্টি খান, চিঠিটা আর ফেরত দেন না!

ফয়সল বারী চৌধুরীর হাতে মাছ মার্কা ছুরি চক চক করে। তিনি গভীর মনোযোগে কাচা আম কাটেন সেই ছুরি দিয়ে। বাবু ভাই কাচের গ্লাসে সেভেন আপ ঢালেন। আড় চোখে আমাকে দেখেন। আবদুল কাদের ভাই মিষ্টি খাওয়া শেষ করে পলিথিনের ব্যাগ চিবান। ব্যাগে মিষ্টির শিরা ছিল তাই! ফখরুল ভাই উদাস মনে গাঁজা টানেন। ধোয়া ছাড়েন নাক দিয়ে। তার চোখ লাল। এটার নাম নাকি সুখ টান।

আমি কোনো সুখ পাই না। চারজন গুন্ডার মাঝখানে বসে বসে দোয়া ইউনূস পড়ি! ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালেমিন।’ মাছের পেটে থাকা ইউনূস নবী সমুদ্রের গভীর জলেও বেঁচে ছিলেন—দোয়া ইউনূস পড়ে। আমি জলের গভীরে নই জলের ওপরে বসা।

ছাদে কোনো রেলিং নেই। নিচে পুকুর। মাছ মার্কা চাকু মেরে এরা আমাকে পুকুরেই ফেলে দেয় কিনা কে জানে! আমার তখন নিজেকে গোবিন্দ মনে হয়। আমি একটা শালিক খুঁজি। যদি থাকে আশপাশে। তবে আমায় সাহস জোগাবে—গোবিন্দকে মেরেছে তার মালিক, গোবিন্দ কাঁদছে রাস্তায়, গোবিন্দর পাশে একটা শালিক, গোবিন্দকে সাহস জোগায়!

আমাকে খবর পাঠান কাদের ভাই। চিঠি ফেরত দেওয়ার কথা বলেন। আমিও আধ কেজি মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাঁটা ধরি। চিঠিটা ফেরত পেলে দশজন ফকির খাওয়ানোর মানত করি! মনে মনে ভাবি ফকির আর মিষ্টির পেছনে এক হাজার টাকা যাবে, যাক। কিন্তু চিঠিটা দুলাল স্যারের হাতে গেলে পিঠের চামড়া যাবে, সঙ্গে ইজ্জতও!

চিঠি নিয়ে ফেরার পথে একটা সবুজ কলম কেনার কথা চিন্তা করি। সবুজ কালিতে সব ব্যথার গল্প লিখব বলে! শাখি সেই চিঠি পড়ে কাঁদলে কাঁদুক। লাভ তো ওরই হবে। শুনেছি কাঁদলে চোখ পরিষ্কার হয়। ধুলাবালি থাকে না! ওর চোখ পরিষ্কার করার জন্য আমি মনে মনে সাদা কাগজের বুকে সবুজ কালিতে লিখি—‘আমার একা লাগে, তোর জন্য একা লাগে। নীল মলাটের খাতাটা একা, একা কলমটাও। আমার বুকজুড়ে তোর অল্প অল্প স্মৃতি-তাও একা! খয়েরি মাফলার, রোদ চশমা, লাল বোতামের শার্ট-সব কিছু একা। আমার একা লাগে, ভীষণ একা লাগে। রাতগুলো, ভোরগুলো, দুপুরগুলো, আমার সময়গুলো তোর জন্যই একা লাগে!’

কিন্তু ছাদে এসে আর একা লাগে না। দেখি চারজন মিলে মোবাইল কোট বসিয়েছেন। আসামি হিমু, সাক্ষী কাদের ভাই, বিচারক বাবু ভাই। সাজা কার্যকর করবেন ফয়সল বারী চৌধুরী। শাখির আরেকজন প্রেমিক!

বিচার কাজ শুরু করেন বাবু ভাই। যাহা বলিব সত্য বলিবর ঢংয়ে।

: তুমি শাখিকে চিঠি লিখেছ?

: না।

: তাকে ভালোবাসো?

: না (চাকুর দিকে তাকিয়ে)

: শাখি তোমাকে ভালোবাসে?

: হ্যাঁ।

: তুমি তাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাবে?

: ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর। কথাটা বলে আমি জিভে কামড় দিই।

ফয়সল বারী চৌধুরী একটা গ্লাস ভাঙেন। কাদের ভাই আফসোস করেন। সেভেন আপটা না খেয়েই গ্লাস ভাঙার জন্য। আমের আঁটি আমার দিকে ছুড়ে মারেন ফয়সল বারী। আমি ক্যাচ ধরি। অতবড় বিপদের মাঝেও বুক ফুলে ওঠে। ক্রিকেট খেললে নিশ্চয়ই ভালো করতাম। আমের আঁটি ক্যাচ ধরার চেয়ে ক্রিকেট বল ধরা অনেক সহজ তাই!

ফয়সাল বারী হুংকার দেন—তুই শাখি কে নিয়ে পালাবি?

আমি নিজেকে সামলাই। বলি, না। পালাব না!

ফয়সল বারী চৌধুরী নায়ক মান্নার মতো বুক চাপড়ান। তারপর বলেন, শাখি শুধু আমার।

: জি আপনার, অবশ্যই আপনার।

: আজ থেকে শাখি তোর বোন!

: অবশ্যই বোন। আমার আপন বোন। ছোটবেলায় মেলায় হারিয়ে যাওয়া বোন।

ফয়সল বারী আবারও গ্লাস ভাঙেন। কাদের ভাই সেটা দেখে আবারও আফসোস করেন। এই গ্লাসটাও সেভেন আপ ভরা ছিল তাই! ফখরুল ভাই কিছুই দেখেন না। তার মন মজে থাকে সুখ টানে। গাঁজায়। কিন্তু আমি দেখি।

আমি তখন শাকিব খান আর আমিন খানকে দেখি। মাঝখানে শাবনূর। পর্দায় করুন গান—বিধি তুমি বলে দাও আমি কার, দুটি মানুষ একটি মনের দাবিদার।’

আমিও ভাবি, শাখি কার? বিধি বলে দিলেই তো হয়। বিধি বলে না কিছুই। বলেন ফয়সাল বারী চৌধুরী। শাখি শুধুই তার, তার ও তার!

বিচার শেষে আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে লেখা, শাখিকে কোনো চিঠি লিখলে অথবা তার কাছ থেকে কোনো চিঠি গ্রহণ করলে আমাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে! যা কিনা মৃত্যুর চেয়েও কঠিন।

মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে! তাই দ্রুত কাগজে সই করি বাঁচার ইচ্ছায়।

কাদের ভাই তাকে ভুল না বুঝতে অনুরোধ করেন। হৃদয়টা বড় করতে বলেন। আসমানের মতো।

আমি বলি, হৃদয় আমার আসমানের মতোই বড় আছে! গুণ দা শিখিয়েছেন—‘প্রিয়জন চলে গেলে মানুষই ব্যথিত হয়, আকাশ নির্বিকার, আকাশ কখনো নয়। তোমরা মানুষ, তাই সহজেই দুঃখ পাও, হে ঈশ্বর, আমাকে আকাশ করে দাও।’

আবদুল কাদের ভাই আমার পিঠ চাপড়ান আর বলেন, মাশ আল্লাহ তোমার ছন্দটা ভালো হইছে। দোয়া করি জীবনে নাম করো। অনেক ছন্দ লিখ!

আবদুল কাদের ভাইয়ের দোয়া নিয়ে আমি ছাদ থেকে নামি। তারপর হোসেন লাইব্রেরিতে যাই। সবুজ রঙের কলম কিনি।

ছন্দ লিখতে নয়, চিঠি লিখতে। আমি লিখতে থাকি, শাখির জন্য গোপন দীর্ঘশ্বাস। সে কী জানে, ঝাপসা চোখে দূরের ছুটে যাওয়া দিগন্ত দেখতে কেমন! গোধূলির রক্তিম আলোয় কেমন লাগে পাহাড়ের ছোটাছুটি। ভৈরবের বুক চিরে যে ব্রিজটা চলে গেছে আড়াআড়ি, কতক্ষণ সময় লাগে ওটা পেরোতে। শাখি কী জানে, কোন বনটা পেরোতে গেলে হাজারটা ঝিঁঝি ডাকে?

না জানে না। শাখি কিছুই জানে না। সে অথবা তারা কেবলই কৈশোরের চড়ুই পাখি। আমার ইচ্ছা করে সেখানে ফিরে যাই। আরও একবার স্কুলের ঘণ্টা বাজুক। আমি ক্লান্ত, আমার কেবলই ধূসর সেই চড়ুই পাখিদের সঙ্গে উড়ে বেড়াতে ইচ্ছে করে! (চলবে)

হিমু আকরাম: নাট্যকার ও পরিচালক, হাইপয়েন্ট স্ট্রিট, নর্থ ক্যারোলাইনা, যুক্তরাষ্ট্র।

ধারাবাহিক এ লেখার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন:

জানালায় আসে না কেউ-দুই
জানালায় আসে না কেউ