দিঘল মেঘের দেশে-পঁচিশ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাকিব দেখল, ছেলেটার বাবা ডেরেক স্টুয়ার্ট যথার্থই ভদ্রলোক। এমনিতে নিউজিল্যান্ডের মানুষ পৃথিবীতে খুব ভদ্র জাতি হিসেবে পরিচিত। এখানকার মানুষ কাউকে খুব কঠিন করে কথা বলেন না। কঠিন কথাটাও বেশ সহজ করে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া তারা কারও সঙ্গে সহজে কোনো রূঢ় আচরণ করে কষ্ট দিতে চান না। তবে সত্য কথাটা বলতে তারা দ্বিধা করেন না। সত্য ও সৎ পথে চলাটাই তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য।

আসার আগে অবশ্য ওরা তিনজন বেশ টেনশনেই ছিলেন। টেনশনে থাকাটাই স্বাভাবিক। আজমল হোসেনের মনে কতটা সৎ চিন্তা ছিল, সেটা অন্য কথা। আপাতদৃষ্টিতে তিনি বেশ বড় ধরনের অপরাধ করেছেন। অন্তত নিউজিল্যান্ডের আইনে। চাইল্ড অ্যাবিউজ। সঙ্গে সেক্সুয়াল অ্যাসাল্ট। এই দুটোর ব্যাপারেই নিউজিল্যান্ডের আইন খুব কঠিন। আজ যদি তারা ছেলেটার বাবার মাধ্যমে কোনো সমাধান বের করতে না পারে, তাহলে আজমল হোসেনের কপালে যে কী ভোগান্তি আছে!

ডেরেক স্টুয়ার্টের বাসাটা দোতলা। তবে বেশ পুরোনো মডেলের। নিচতলায় আর কোনো রুম আছে কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। একপাশে গাড়ির গ্যারেজ। গ্যারেজের পাশ দিয়েই একটা সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। দোতলায় উঠতেই লাউঞ্জ।

ডেরেক স্টুয়ার্ট প্রথমে তাদের তিনজনকে দেখে একটু ভ্রু কুঁচকালেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, সাইদ আহমেদ একাই আসবেন। অবশ্য তিনি হাসি হাসি চেহারা করে বলেন, আসুন, ভেতরে আসুন।

তারা এখন লাউঞ্জে বসে আছে। ডেরেক স্টুয়ার্ট তাদের বসিয়ে দিয়েই কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলতে ভেতরে চলে গেছেন।

রাকিব সাইদ আহমেদ ও জাহিদের দিকে তাকিয়ে জানালা গলে বাইরে তাকাল। বাড়িটার আশপাশে বেশ বড় বড় গাছ। বাইরে গ্রীষ্মের উষ্ণতা থাকলেও বাসার ভেতরটা বেশ শীতল। মনে হচ্ছে লাউঞ্জের কোনো কোণা থেকে এসির বাতাস আসছে। কিন্তু রাকিব পুরো লাউঞ্জে চোখ বুলিয়েও কোথাও কোনো এসির অস্তিত্ব পেল না।

ডেরেক স্টুয়ার্টের লাউঞ্জটা অবশ্য ছিমছাম ও গোছালো। একপাশে পঁয়ষট্টি ইঞ্চির একটা বড় এলইডি টিভি। লাউঞ্জের একপাশে একটা অ্যাকুরিয়ামও আছে। লাল ও বেগুনি মাছগুলো লেজ নাচিয়ে সাঁতার কাটছে।

একটু পর ডেরেক স্টুয়ার্ট ফিরে এলেন। পাশের একটা সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ, কী যেন বলতে চেয়েছিলেন?

সাইদ আহমেদ বললেন, জি মানে, আমি সাইদ আহমেদ। আমিই আপনার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি।

ডেরেক স্টুয়ার্ট জিজ্ঞেস করলেন, আর তারা?

সাইদ আহমেদ পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এ রাকিব। মিস্টার আজমল হোসেনের কলেজের ছাত্র। আর সে জাহিদ। মিস্টার আজমল হোসেনের সরাসরি ছাত্র।

ডেরেক স্টুয়ার্ট বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, সরাসরি ছাত্র আর কলেজের ছাত্রের মধ্যে পার্থক্যটা কী?

সাইদ আহমেদ বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন, সরাসরি ছাত্র মানে, জাহিদ সায়েন্সের ছাত্র ছিল। মিস্টার আজমল হোসেন কলেজে সায়েন্স পড়াতেন। কেমিস্ট্রি। আর রাকিব সেই কলেজে আর্টসের ছাত্র ছিল। মিস্টার আজমল হোসেনের সরাসরি ছাত্র ছিল না।

ডেরেক স্টুয়ার্ট মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ও, মিস্টার আজমল হোসেন তাহলে কলেজে পড়াতেন? কোথায়, এখানকার কোনো কলেজে?

: না, বাংলাদেশে।

: এখানে তিনি কী করেন?

: অরচার্ডে কাজ করেন।

: ও, আচ্ছা। এখানে কি তিনি স্কুল বা কলেজে চেষ্টা করেননি?

: না। সেটা অন্য একটা কাহিনি। তিনি এখানে উচ্চশিক্ষার জন্য এসেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা করতে পারেননি। টাকাপয়সার সমস্যায় পড়ে যান। তাই অরচার্ডে কাজ শুরু করেন। আর তার বয়সও তো হয়েছে।

: এই বয়সে মিস্টার আজমল হোসেন এমন একটা কাজ করলেন? তিনি কী মানসিক রোগী? এ দেশে বা অস্ট্রেলিয়ায় কিছু বৃদ্ধ মানসিক রোগীরা ছোট বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এ কাজটা করে থাকে। এটা নাকি নিঃসঙ্গতা থেকে হয়। এ জন্য এ ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের আইন খুব কঠিন।

: তা জানি। এ জন্যই তো আপনার কাছে এসেছি।

: আমার কাছে কেন? তিনি এখন পুলিশ কাস্টডিতে। ব্যাপারটা এখন পুলিশ দেখছে। আপনাদেরকে কি ওখানে যাওয়া উচিত নয়?

: হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলছেন। আমরা পুলিশ স্টেশনেই গিয়েছিলাম। পুলিশ অফিসার বললেন, মিস্টার আজমল হোসেনকে ছাড়িয়ে নেওয়ার দুটো উপায় আছে। এক, ল ইয়ার ধরা। দুই, আপনার মাধ্যমে অভিযোগটা তুলে নেওয়া।

: মিস্টার আজমল হোসেন অন্যায় করেছেন। অপরাধ করেছেন। গতকাল আমার ছেলের সঙ্গে করেছেন। আগামীকাল অন্যের ছেলের সঙ্গে করবেন। এ ধরনের বিকৃত মানসিক রোগীদের শাস্তি হওয়া উচিত, তাই না?

: হ্যাঁ, কিন্তু মিস্টার আজমল হোসেন মানসিক রোগী নন।

: তাহলে তিনি কী?

: তিনি আমাদের কমিউনিটিতে বেশ সম্মানী মানুষ। নিরীহ ও ভদ্রলোক। কিন্তু গতকাল একটা মিস আণ্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছে।

: আপনি বারবার একই কথা বলছেন। সেই ফোনেও বলেছেন, ব্যাপারটা মিস আণ্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে।

: হ্যাঁ, আপনি মনে কিছু না করলে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, ব্যাপারটা মিস আণ্ডারস্ট্যান্ডিং।

: কীভাবে গ্যারান্টি দিচ্ছেন? আপনি কি সেখানে ছিলেন?

: না, আমি সেখানে ছিলাম না।

: তাহলে আপনি কীভাবে বলছেন?

: আমি মিস্টার আজমল হোসেনকে দীর্ঘদিন ধরে চিনি বলে।

: আপনি কী এমন কোনো প্রমাণ দিতে পারবেন যে মিস্টার আজমল হোসেনের ব্যাপারটা মিস আণ্ডারস্ট্যান্ডিং?

সাইদ আহমেদ আজমল হোসেনের ছেলের আট বছর বয়সী ছবিটা ফ্রেমসহ ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, প্লিজ!

ডেরেক স্টুয়ার্ট ছবি নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী?

: এটা একটা আট বছর বয়সী ছেলের ছবি।

: কার ছেলে?

: মিস্টার আজমল হোসেনের ছেলে।

: ও, তাই!

সাইদ আহমেদ বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন, জি, এটা মিস্টার আজমল হোসেনের ছেলের ছবি। ছেলেটা বাংলাদেশে। অনেক দূরে। তাই মিস্টার আজমল হোসেন কোনো বাচ্চা ছেলে দেখলে নিজের ছেলে ভেবে আদর করতে চান। এটা-সেটা দিতে চান। আপনার ছেলের সঙ্গে গতকাল মনে হয় সেটাই করতে চেয়েছিলেন। এ জন্যই আমি বারবার বলছি, ওটা একটা মিস আণ্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল।

পরিবেশটা এক মুহূর্তের মধ্যে পরিবর্তন হয়ে গেল। সবার মধ্যে একধরনের স্তব্ধতা নামল। ভদ্রলোক এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আজমল হোসেনের ছেলের ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। সাইদ আহমেদ চুপ। জাহিদও চুপচাপ। রাকিব বুঝতে পারল, একটা ইতিবাচক কিছু হবে। সে মনে মনে সাইদ আহমেদের প্রশংসা করল। তিনি বুদ্ধি করে ছবিটা না আনলে হয়তো এত তাড়াতাড়ি এমন একটা পরিবেশের সৃষ্টি হতো না। এমনিতে নিউজিল্যান্ডের মানুষগুলো এত সহজ সরল যে, যেটা বিশ্বাস করে, সেটা মনেপ্রাণেই বিশ্বাস করে। ওদের বিশ্বাসকে সহজে পরিবর্তন করা যায় না।

ডেরেক স্টুয়ার্ট ছবিটা সাইদ আহমেদের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, মিস্টার আজমল হোসেন তার ছেলেটাকে কেন নিউজিল্যান্ড নিয়ে আসেন না?

সাইদ আহমেদ বললেন, মিস্টার আজমল হোসেনের ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত ঝামেলা আছে বলে তিনি নিয়ে আসতে পারছেন না।

: ও, আচ্ছা। তা আমি এখন আপনাদের জন্য কী করতে পারি?

: আপনি যদি আপনার অভিযোগ তুলে নেন, তাহলে আমরা হেস্টিংস পুলিশ স্টেশন থেকে আজমল হোসেনকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারি।

: সেটা তো একজন ক্রিমিনাল ল ইয়ার ধরেও নিয়ে যেতে পারেন।

: ক্রিমিনাল ল ইয়ার যে ধরব সেই টাকা পাব কোথায়? সেই টাকাপয়সা আজমল হোসেনের কাছে থাকতে হবে তো। তিনি বিভিন্ন অরচার্ডে কাজ করেন। বয়স বেশি হয়েছে বলে প্রতিটা সিজনে তার অর্ধেক সময়েই কাজ থাকে না। এ ছাড়া তিনি খুব ভুলো মনের। বাংলাদেশে তিনি কলেজে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন তো, এ জন্য।

ডেরেক স্টুয়ার্ট একটু সময় নিয়ে কী ভেবে বললেন, ওয়েল, আমি আপনার কথা বিশ্বাস করলাম। আমি তো পাবলিক সেক্টরেই কাজ করি। হেস্টিংস সিটি কাউন্সিলে আছি। বিল্ডিং ইন্সপেক্টর হিসেবে। নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে আমার কাজ করতে হয়। কিন্তু! ¾

সাইদ আহমেদ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু কী?

ডেরেক স্টুয়ার্ট বললেন, না, থাক ওসব কথা। এখন আমি আপনাদের কী উপকার করতে পারি।

সাইদ আহমেদ বললেন, আপনাকে হেস্টিংস পুলিশ স্টেশনে একটা ফোন দিলেই হবে। আমরা আপাতত মিস্টার আজমল হোসেনকে বাসায় নিয়ে যেতে পারি। আগামীকাল না হয় কাগজপত্রের ঝামেলাগুলো সারব।

ডেরেক স্টুয়ার্ট বললেন, হুম, আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনারা যান। আমি আমার ফ্যামিলি ল ইয়ারের সঙ্গে কথা বলে নেই।

সাইদ আহমেদ বললেন, প্লিজ, আপনি আমাদের এই উপকারটুকু করেন। আমরা সারা জীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।

এরই মধ্যে ছেলে ভেতর থেকে এল। ছেলেটা তার বাবার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল।

ওরা সবাই ছেলেটার দিকে তাকাল। ছেলেটা সত্যি খুব সুন্দর। চোখে হ্যারি পটার মার্কা একটা চশমা। সোনালি চুল। বড় বড় চোখ। রাকিব ভাবল, আজমল স্যার যে ছেলেটেক আদর করে কাছে টেনেছেন, ভুল করেননি। এমন ছেলেকে দেখলে কার না নিজের ছেলের কথা মনে পড়বে?

ডেরেক স্টুয়ার্ট বললেন, এ-ই আমার ছেলে।

সবাই ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল, হ্যালো। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1560051