নীল কুমুদিনীর নৃত্য-তিন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাকিব দেখল, তার কানের কাছে কেউ একজন হাতুড়ি পেটা করছে। কিন্তু কে হাতুড়ি পেটা করছে, সে দেখতে পারছে না। কেনই বা হাতুড়ি পেটা করছে সেটাও সে বুঝতে পারছে না। এক সময় একটা হাতুড়ির আঘাত তার ডান কানে এসে লাগল। সে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে চিৎকার করে উঠল। ঠিক তখনই তার ঘুমটা ভেঙে গেল।

ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর সে থতমত খেয়ে ডান কানে হাত দিল। ডান কানে হাত চেপে ধরে সে বুঝল, কানটা ঠিকই আছে। কানের কাছে কোনো হাতুড়ি পেটাও হচ্ছে না। বরং বাসার ফোনটা বাজছে, টোয়ৎ টোয়ৎ, টোয়ৎ টোয়ৎ, টোয়ৎ টোয়ৎ।

রাকিব উপুড় হয়ে ঝুঁকে বেড সাইড টেবিলের ওপর থেকে কর্ডলেসটা নিল। আস্তে করে বলল, হ্যালো।

ওপাশ থেকে মার গলা ভেসে এল, বাবা আঁখি, আমি। তোমার মা।

রাকিব একহাতে চোখ কচলে নরম গলায় বলল, জি, বলুন।

: সরি, আমি জানি তোমাদের ওখানে সকাল।

রাকিব ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল, এত সকাল নয়। প্রায় আটটা বাজে।

: কী, ঘুমাচ্ছিলে?

: জি, আসলে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে তো। তাই সকালটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। এ ছাড়া, আজ শনিবার। অফিস নেই তো, তাই।

: সরি বাবা, তোমার ঘুমটা ভেঙে দিলাম।

: অসুবিধা নেই। আমি এমনিতেই উঠে যেতাম।

: আমি তোমার মোবাইলে প্রথমে চেষ্টা করেছি।

: আমি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মোবাইল সাইলেন্ট করে রাখি।

: আসলে কী বাবা, আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। তোমাকে নিয়ে। তাই সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিলাম।

রাকিবের ইচ্ছে হলো না তার মার দুঃস্বপ্নটা শুনতে। সে নিজেও কিছুক্ষণ আগে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্ন সব সময় স্বপ্নই। হোক তা ভালো স্বপ্ন বা খারাপ স্বপ্ন। এ ছাড়া, মা প্রায়ই তাকে ফোন দেওয়ার জন্য একটা না একটা বাহানা খোঁজেন। রাকিব তা স্পষ্ট বুঝতে পেরেও মাকে তা বুঝতে দিল না। ফোনের এপাশ থেকে অনেকটা নির্মোহ ও নিস্তব্ধে মায়ের কথা শোনে।

রাকিবের মা বললেন, দুঃস্বপ্ন দেখার পরই আমার ঘুমটা ভেঙে যায়। এখানে এখন মাঝরাত। আমার মনে হয়, রাতে দুঃস্বপ্নের কথা বলা ঠিক না।

রাকিব আস্তে করে বলল, জি।

: তুমি ভালো আছ তো, বাবা?

: জি, আপনি ভালো আছেন?

: মায়েরা বুড়ো হলে কি ভালো থাকে। তার ওপর দুই ছেলে দূরে দূরে আছে।

রাকিব কিছু না বলে চুপ হয়ে গেল। কেন জানি সে আজও তার মাকে প্রাণ খুলে মা ডাকতে পারে না। টেলিফোনে কথা হলে ভাব বাচ্যেই কথাগুলো সেরে নেয়। খুব কালেভদ্রে মা ডাকে।

রাকিবকে চুপ হয়ে যেতে দেখে রাকিবের মা প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের ওখানে বুঝি এখনো বৃষ্টি হচ্ছে?

রাকিব জিজ্ঞেস করল, আপনি কীভাবে বুঝলেন?

: ওই যে, তুমি একটু আগে বললে না, বৃষ্টি হচ্ছে বলে সকালটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না?

: ও, আচ্ছা। রাকিব ফোনের এপাশে হেসে ফেলল। তবে নিঃশব্দ হাসি।

মাও ওপাশে মনে হয় হাসলেন। বললেন, দুবাইতে বৃষ্টি হয় খুব কম। কিন্তু খুব ধুলার ঝড় হয়।

রাকিব বলল, জি, আমি জানি।

: তুমি একবার দুবাই ঘুরে যাও না, প্লিজ। আমি নয়নকে বলি তোমাকে নিউজিল্যান্ড থেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে?

: এখন না, পরে যাব।

: নয়ন আগামী মাসে আসবে বলেছে।

: এবার নয়ন একা যাক। পরেরবার তার সঙ্গে যাব।

: হ্যাঁ, খুব ভালো হবে। প্রয়োজনে আমরা দুবাই থেকে বাংলাদেশ যাব।

: বাংলাদেশ যাব কিনা জানি না। তবে একবার দুবাই ঘুরে আসব।

: বাংলাদেশ কেন যাবে না, বাবা?

: বাংলাদেশ শুধু শুধু কেন যাব?

: বাবা, নয়নের জন্য বাংলাদেশে পাত্রী দেখছি। আমি চাই তুমিও...।

মা কী বলতে চাচ্ছেন বুঝতে পেরেও রাকিব জিজ্ঞেস করল, আমি কী?

: থাক বাবা, ও কথা পরে বলব। তুমি আরেকটু রেস্ট নাও। আমিও একটু ঘুমাই। এখানে রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেছে।

রাকিব বলল, জি।

: বাবা, আমি আবার তোমাদের ওখানকার সময় বিকেলে ফোন দেব। তুমি ভালো থেকো বাবা।

: জি, আচ্ছা।

ওপাশে মা ফোন রেখে দেওয়ার পর রাকিব কর্ডলেসটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। মা বেশ কিছুদিন ফোন দেননি। বেশ অসুস্থ ছিলেন। রাকিব নিজ থেকে দু-তিনবার ফোন দিয়েছে। তার ফোন পেয়ে মা কী যে খুশি হয়েছেন।

রাকিব বুঝতে পারে, মার ভেতর সেই পুরোনো অপরাধবোধটা এখনো কাজ করে। রাকিব মনে মনে ভাবে তার সঙ্গে টেলিফোনে মা যেভাবে কথা বলেন, নয়নের সঙ্গে নিশ্চয়ই ওভাবে কথা বলেন না? মা হিসেবে রাকিবের ওপর খুব একটা অধিকারবোধ খাটাতে পারেন না। কোনো কথা জোর দিয়ে বলতে গিয়েও থেমে যান। কী একটা সংকোচ বোধও মার ভেতর কাজ করে। মা ও ছেলের যে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক, এই ছয়-সাত মাসেও তাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। অথচ তিনি তো তার জন্মদাত্রী মা। মাঝখানের উনিশ বছরের সময়ের ব্যবধানটা ঘুচতে হয়তো আরেকটু সময় লাগবে।

গতরাতে হাফ-ব্রাদার নয়নও অস্ট্রেলিয়া থেকে ফোন দিয়েছিল। রাকিব অবশ্য নয়নের সঙ্গে বেশ খোলামেলাই আলাপ করে। নয়নের একটা জিনিস রাকিবের ভালো লাগে, সেও তার মতো টেলিফোনে কম কথা বলার মানুষ। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা কথাও বলে না।

রাকিব শরীরের আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে সময়টা দেখল। যদিও তার রুমে একটা দেয়াল ঘড়ি আছে। সকাল প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। তার রুমের জানালার পর্দা আধাআধি সরিয়ে রাখা। জানালার কাচ গলে রাকিব দেখল, বাইরে এখনো টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টিটা গত রাত থেকে শুরু হয়েছে। গতরাতে সে হ্যামিল্টন ডাউন টাউন প্লাজার ইভেন্ট সিনেমা হলের লেট নাইট শোতে জুরাসিক ওয়ার্ল্ড-টু দেখতে গিয়েছিল। এর আগে রাকিব দুবার উদ্যোগ নিয়েও দেখতে যেতে পারেনি। ইভেন্ট সিনেমা হলে যেতে যেতে বা হলে বসে রাকিব যে নদীর কথা ভাবেনি, তা নয়। বরং বেশ শূন্যতা অনুভব করেছে। হেস্টিংস-নেপিয়ার থেকে আসার পর নদী একটা বারও তাকে ফোন দেয়নি। রাকিব নিজেও দু-একবার ফোন দিতে গিয়ে কী ভেবে থেমে গেছে। কাউকে নিজ থেকে ফোন দেওয়ার ব্যাপারে তার এত অনীহা কেন, সে নিজেও তা বোঝে না। নদী নিশ্চয়ই খুব রাগ করে আছে? আজ তো শনিবার। আজ একটিবার ফোন দিলেও তো পারে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে কী? সে নিজে গাড়ি নিয়ে গিয়ে নদীকে শেয়ারউড পার্ক থেকে নিয়ে আসবে।

রাকিব বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে আরেকবার শরীরের আড়মোড়া ভাঙল। জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে পর্দাটা পুরোপুরি সরিয়ে দিল। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হলেও প্রকৃতিতে একধরনের ধূসর ফরসা আলো। আকাশও তেমন কালি নয়। ম্যাপল ও ওক গাছের পাতায় বাতাসের হালকা ঝাপটা দিচ্ছে। দুটো শালিক পাশাপাশি বসে ভিজছে। কয়েকটা চড়ুই বৃষ্টির মধ্যেই এ ডাল থেকে ও ডালে উড়ছে। কাছে কোথাও একটা পাখি ডাকছে—চিরিক-চিরিক, চিরিক-চিরিক।

রাকিব জানালার পাট খানিকটা খুলে দিল। বাতাসের একটা ছোট্ট ঝাপটা তার মুখে এসে লাগল। বাতাসের ঝাপটাটা ঠিক শীতল নয়, আবার উষ্ণও নয়। নিউজিল্যান্ডে গ্রীষ্মের বৃষ্টি।

রাকিব ভাবল, এমন বৃষ্টির দিনে এক কাপ কফি নিয়ে জানালার পাশে বা ব্যালকনিতে দাঁড়ালে কী অনুভূতিরই না সৃষ্টি হবে!

ভাবতে ভাবতেই রাকিব বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। খুব তাড়াতাড়ি বাথরুম সেরে তোয়ালে মুখ মুছতে মুছতে বেডরুমে না ঢুকে সরাসরি কিচেনে চলে এল। হট ওয়াটার জগে পানি নিয়ে সুইচ অন করে দিল। আপাতত নাশতা করবে না। রাকিব ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে খালি পেটে ব্ল্যাক কফি খাওয়ার অনুভূতিটুকু নেবে। গ্রীষ্মের এই বৃষ্টির সকালে ধোঁয়া ওঠা ব্ল্যাক কফি, আহা!

হট ওয়াটার জগে পানির বলক উঠে এখন শিস দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। রাকিব একটা কফি কাপে এক চামচ ইনস্ট্যান্ট কফি নিল। আজ কোনো চিনি নিল না। রাকিব মাঝেমধ্যে ব্ল্যাক কফিতে এক-দুই চামচ চিনি খায়। মাঝেমধ্যে চিনি ছাড়া শুধুই ব্ল্যাক কফি খায়। তার যে ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে, তা নয়। কিন্তু তারপরও সে চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি খায়। আজও রাকিব তাই করল। হট ওয়াটার জগ থেকে পানি ঢেলে অযথাই কফির কাপে চামচের ঝড় তুলল। তারপর কফি কাপ নিয়ে ব্যালকনিতে না গিয়ে একটা জানালার পাশে দাঁড়াল। রাকিব কফির কাপে চুমুক দিয়ে নদীর কথা ভাবল। আহা, আজ যদি নদী বাসায় আসত! আজ এই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির দিনে নদীকে নিয়ে খিচুড়ি ও মুরগির মাংস ঝুল ঝুল রান্না করে খেত! কিন্তু এই বৃষ্টির দিনে নদী কী আসবে?

নিউজিল্যান্ডে এসে রাকিব ভালোই রান্নাবান্না শিখেছে। না শিখে উপায়ও ছিল না। হেস্টিংসে যাওয়ার পর সে যখন হাসানুজ্জামান হাসানের বাসায় ওঠে, একদিন হাসানুজ্জামান হাসান রান্না ঘরে ডেকে নিয়ে বললেন, রাকিব, রান্নাটা শিখে নাও। তোমাকে কিন্তু এখানে কেউ রান্না করে খাওয়াবে না। এ দেশি বিয়ে করলে তো কথাই নেই। রান্নাটা চিরস্থায়ীভাবে তোমার ঘাড়ে চাপবে। বাঙালি কোনো মেয়েকে বিয়ে করলেও কিন্তু এই রান্নাবান্না থেকে নিস্তার পাবে না।

নিউজিল্যান্ডে একটা সুবিধা। এখানে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বা ফিজি থেকে বেশ উন্নতমানের গুঁড়ো মসলা আসে। রসুন পেস্ট, আদা পেস্ট সব পাওয়া যায়। এমন কী ধনিয়াপাতার পেস্টও পাওয়া যায়। শুধু পরিমাণ মতো দিলেই হয়। হাসানুজ্জামান হাসান রান্নাবান্নার একটা সহজ পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। প্রতি এক কেজি গরু বা মুরগির মাংসে এক চামচ করে আদা-রসুন পেস্ট ও গুঁড়ো মসলা। দুই কেজি মাংসে দুই চামচ করে আদা-রসুন পেস্ট ও গুঁড়ো মসলা। এই সহজ হিসাবটা কষে রাকিব গত দশ-সাড়ে দশ বছরে ভালোই রান্নাবান্না শিখেছে। তবে রাকিব ভুনা খিচুড়ি রান্না করা শিখেছে রিনেই ভাবির কাছ থেকে। যদিও রিনেই ভাবি ভুনা খিচুড়ি রান্নাটা হাসানুজ্জামান হাসানের কাছ থেকেই শিখেছিলেন।

এমেন্ডা রাকিবের ভুনা খিচুড়ি রান্না খুব পছন্দ করত। কোনো বৃষ্টির দিনে বিকেলে কাজ থেকে বাসায় ফিরে এমেন্ডা রাকিবকে ভুনা খিচুড়ি রান্না করার জন্য অনুরোধ করত। তারপর দুটো প্লেটে খিচুড়ি ও ডিম ভাজি নিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে ওরা শর্ট ল্যান্ড স্ট্রিট সিরিজটা দেখত।

রাকিব কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সেই মধুর স্মৃতিগুলো নিয়ে ভাবল, আহা, কী দিন ছিল...! জীবন তাদের কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে এসেছে। হাসানুজ্জামান হাসান পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে। রিনেই ভাবি দুটো মেয়ে নিয়ে এক রকম জীবনটা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমেন্ডা নতুন স্বপ্ন নিয়ে মেলবোর্নে যাচ্ছে। আর সে নিজে?

রাকিব মাথা ঝাঁকাল। সে-ও আছে এক রকম। সে জীবনটাকে জলহীন কাদামাখা মাছের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নদী এসে হঠাৎ করে যা একটু ঝোড়ো বাতাসের ঝাপটা দিয়ে গেছে।

রাকিবের হঠাৎ মনে হলো, ইস, নদী যদি এখন এসে বাসাটা হইহই করে মাতিয়ে তুলত। নদী এলে সে অবশ্যই ভুনা খিচুড়ি রান্না করত। তারপর বিকেলে ওয়াইকাটো নদীর তীরে হাঁটতে যেত। গত তিন-চার সপ্তাহের কোনো শনিবারেই তারা ওয়াইকাটো নদীর তীরে হাঁটতে যায়নি। অথচ গত কয়েক মাস নদীকে নিয়ে প্রতি শনিবারে ওয়াইকাটো নদীর তীরে হাঁটা তার নিয়মমাফিক হয়ে উঠেছিল।

রাকিব জানালা গলে আবার বাইরে তাকাল। বাইরে এখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির শব্দের চেয়ে গাছপাতার জলের শব্দই বেশি।

রাকিব নদীকে ফোন দেওয়ার কথা ভাবল। ঠিক তখনই তার মোবাইলটা বেজে উঠল। মোবাইলটা তার বেডরুমের বেড সাইড টেবিলের ওপর। রাকিব ভাবল, নদী ফোন দেয়নি তো? এ মুহূর্তে নদী ফোন দিলে সে খুব খুশিই হবে।

রাকিব কফির কাপটা হাতে নিয়েই বেডরুমে গিয়ে ঢুকল। কিন্তু মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল, তার ছোট ফুফু ফোন দিয়েছেন। রাকিব বিরক্ত হতে গিয়ে হলো না। তার সত্যি এ মুহূর্তে কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল।

রাকিব আস্তে করে বলল, হ্যালো।

ফোনের ওপাশে ছোট ফুপুর চিরায়ত অভিযোগ। বললেন, তুই আর জীবনে মানুষ হলি না।

রাকিব একটু নরম গলায় বলল, কেন, কী হয়েছে?

: কী করিসনি তুই?

: আহা, বলবে তো।

: তোর কি ফোন দিতে মন চায় না?

: কাকে ছোট ফুফু?

: তুই আসলেই একটা গাধা।

: জি, আমি গাধাই। এখন বলো, কেন গাধা ডাকছ?

: গাধা এ জন্য ডাকছি...এক মাসের ওপরে হয়ে গেল তোর কোনো ফোন নেই?

: তুমিও তো ফোন দেওনি?

: আমি যে কী সমস্যার মধ্যে আছি। মাঝখানে আবার অসুখ-বিসুখ গেল।

: কার অসুখ-বিসুখ?

: কার আবার, আমার।

: তোমার কি সব সময়ই অসুখ-বিসুখ লেগে থাকে?

: এটা আবার তুই কী বললি?

: না, মানে তুমি যখনই ফোন দাও তখনই অসুখের কথা বলো।

ছোট ফুফু ফোনের ওপাশে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তুই না আসলেই একটা গাধা। এ জন্যই তোর এত অধঃপতন।

রাকিব বলল, আমার অধঃপতন নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না ছোট ফুফু। তুমি কি আর কিছু বলবে? আমি এখনো নাশতা করিনি। আমি নাশতা করব।

: তুই কি ফোন রেখে দিতে চাচ্ছিস?

: জি, ছোট ফুফু।

ছোট ফুফু ফোনের ওপাশে অযথাই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। গলা চড়া করে বললেন, তোর এত বড় সাহস, তোর খুব বাড় বেড়েছে!

রাকিব কথা না বাড়িয়ে হুট করেই লাইন কেটে দিল। কিন্তু লাইন কেটে দিয়েই তার ভেতর একধরনের অস্বস্তি এসে ভিড় করল। সে কী কাজটা ঠিক করেছে? অবশ্য সে এমনটা বহুবারই করেছে। ছোট ফুফু পরে আবার ফোন দিয়ে নরম গলায় কথা বলেছেন। সেও ছোট ফুফুকে মানিয়ে দিয়েছে।

কফির কাপের কফি তখনো শেষ হয়নি। যদিও কফিটা প্রায় ঠান্ডা হয়ে গেছে। তারপরও রাকিব বেডরুম থেকে বের হতে হতে ঠান্ডা কফির কাপে চুমুক দিল। ব্ল্যাক কফি ঠান্ডা হলেও তার কাছে খারাপ লাগে না।

মোবাইলটা আবার বেজে উঠল। এবার মোবাইলটা রাকিবের হাতেই। সে দেখল, ছোট ফুফু আবার ফোন দিয়েছেন।

রাকিব মনে মনে একটু হাসল। সে জানত, ছোট ফুফু আবার ফোন দিবেনই। এ রকমটা তিনি বহুবার করেছেন। খানিকক্ষণ পরই বেশ নরম সুরে কথা বলেছেন।

আজ অবশ্য তিনি খুব একটা নরম সুরে কথা শুরু করলেন না। রাকিব হ্যালো বলতেই তিনি জোর গলায় বললেন, দেখ রাকিব, ফোনের লাইন কাটবি না। খবরদার বলছি।

রাকিব বলল, জি, ছোট ফুফু। তোমার আজ কী হয়েছে বলো তো?

: তোকে বলে লাভ আছে? তুই তো একটা গাধা!

: আচ্ছা, ঠিক আছে আমি একটা গাধা। এবার বলো, হয়েছেটা কী?

: আমার গজব হয়েছে।

: গজব! ওটা কেন?

: আর বলিস না, ওরে নিয়ে আর পারলাম না। বলা নেই-কওয়া নেই একটা গার্লফ্রেন্ড ধরে ফেলেছে। যার জন্য আমি আমার সারাটা জীবন শেষ করলাম!

: কে, ছোট ফুপা?

: তোর মাথা। এই বুড়াটা আবার গার্লফ্রেন্ড পাবে কোথায় থেকে? তার ভুঁড়ি দেখে মেয়েরা এক শ হাত দূর দিয়ে দৌড়াবে। বাংলাদেশে ট্রাকের পেছনে লেখা থাকে না, এক শ হাত দূরে থাকুন? এখানকার মেয়েরাও তাদের পাছার পেছনে লিখে রাখবে, জনাব, এক শ হাত দূরে থাকুন। হি–হি হি–হি...! আমি দেখে তার সঙ্গে সংসার করছি।

ছোট ফুফুর হাসি শুনে রাকিবও হাসল। বলল, তোমার কথাবার্তার মান নিচে নেমে যাচ্ছে ছোট ফুফু।

ছোট ফুফু হাসি ধরে রেখেই জিজ্ঞেস করলেন, সেটা কেমন?

: তুমি অশালীন কথাবার্তা বলছ।

: এটা অশালীন কথাবার্তা? দেখ, আমাকে ভাষা শিখাবি না।

: আচ্ছা, ঠিক আছে। তা না হয় না-ই করলাম। কিন্তু নিজের স্বামীকে নিয়ে এভাবে কেউ বলে?

: সংসার তো আমি করছি। আমি জানি মানুষটা কী চিজ!

: সংসার তুমি করছ না। বেসিকেলি ছোট ফুপা উল্টো তোমার সঙ্গে সংসার করছে। তুমি খুব লাকি একটা মহিলা। আচ্ছা বাদ দাও, গার্লফ্রেন্ড যে নিয়েছে সেই পাত্রটা কে?

: আমার পুত্রধন।

: কী বলো?

: হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার পুত্রধন।

: তার তো মনে হয় বিশ বছর হয়নি?

: কী বলিস? একুশ পেরিয়ে যাচ্ছে। এবার ইউনিভার্সিটিতে থার্ড ইয়ার ফাইনাল দেবে না?

: সে তো গার্লফ্রেন্ড ধরতেই পারে। অস্ট্রেলিয়াতে জন্ম। একুশ বছর হয়ে গেছে।

: তুই যা বলিস না! অস্ট্রেলিয়াতে মনে হয় আর কারও ছেলেমেয়ের জন্ম হয় না?

: তা হয়। তবে সে গার্লফ্রেন্ড নিতেই পারে। সে তো ম্যাচিউর হয়েছে।

: তা নিতে পারে। কিন্তু আমার কী ইচ্ছে ছিল জানিস, ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। বাংলাদেশ থেকে খুব সুন্দরী একটা মেয়ে বিয়ে করে নিয়ে আসব। কিন্তু না, সে কোথাকার এক কালি-পেতনি ধরল!

: আফ্রিকান নিগ্রো নাকি সোমালিয়ান? তোমাদের ওখানে তো অনেক সোমালিয়ান রিফিউজি হয়ে এসেছে।

: আরে, না, না।

: বাঙালি মেয়ে?

: হ্যাঁ, আমাদের সাবার্বেই থাকে। এক স্ট্রিট পরে বাসা। রোকন সাহেবের মেয়ে।

: কোন রোকন সাহেব?

: তুই আমাদের বাসায় দেখেছিস। তোর দুলাভাইয়ের সঙ্গে বেশ ওঠাবসা।

: ওই যে, খুব কালো করে যে ভদ্রলোক, তার গোঁফ আছে, তাই না?

: হ্যাঁ, হ্যাঁ, উনিই।

: তার মেয়ে? আমি কি মেয়েটাকে দেখেছি?

: মনে হয় না। আমাদের বাসায় খুব একটা আসে না। কিন্তু কেমনে যে আমার পুত্রধনের সঙ্গে প্রেম করে ফেলল!

: মেয়ের নাম কী?

: মেয়ের নাম দিয়ে তোর কাজ কী?

: ওমা, ছোট ফুফু, তুমি কী যে বলো না! আমার ছোট ভাই, একটা মাত্র ফুপাতো ভাই। সে গার্লফ্রেন্ড নিয়েছে। বিয়ে করবে। অথচ মেয়ের নাম জানব না?

: ফাজলামি করছিস?

: মোটেও না। আমি সিরিয়াস।

: রাকিব, তোর আজকাল কী হয়েছে বলত?

: আমার আবার কী হবে? হয়েছে তো আপনার পুত্রধনের। আমার পেয়ারা ফুপাতো ভাইয়ের।

: হয়েছে। আর বলতে হবে না। আচ্ছা, তুই তো এক সময় এত কথা বলতি না? এক শ টা প্রশ্ন করলে একটা জবাব দিতি। ভেড়া ছিলি।

রাকিব হাসল। একটু শব্দ করেই হাসল। ভাবল, ছোট ফুফু তো ঠিকই বলেছেন। আসলেই তার আজকাল অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে। সে কথা বলার মানুষ খোঁজে।

ছোট ফুফু নিজ থেকেই বললেন, মেয়েটার নাম হৃদি।

: হৃদি, দারুণ নামতো! ভালো নামটা কী?

: ভালো নাম দিয়ে কাজ কী?

: ছোট ফুফু, তুমি না! যার ডাক নামটা এত সুন্দর, ভালো নামটা যে আরও কত সুন্দর হবে!

: তুই খুব বেশি কথা বলছিস।

: তা না হয় বলছি। বলো না, মেয়েটার ভালো নামটা কী?

: দেখ রাকিব, আমাকে রাগাবি না।

: আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু একটা কথা বলি। ছোট ফুফু, তোমার কিন্তু এখনই মেয়েটাকে নিয়ে ঈর্ষা শুরু হয়ে গেছে।

: আমার ঈর্ষা শুরু হবে কেন? সে কি সতিন হবে?

: হতেও পারে।

: কী যা তা বলছিস?

: ছোট ফুফু, অনেক সময় ছেলের বউ সতিনের চেয়েও কঠিন হয়ে ওঠে।

: তা অবশ্য ঠিক বলেছিস।

: ছোট ফুপার খবর কী?

: তোর ছোট ফুপার কোন খবর?

: ছেলের বউ দেখে কেমন খুশি?

: এই, ধ্যাত। আমার ছেলে কী বিয়ে করেছে নাকি? তুই ছেলের বউ-ছেলের বউ করছিস?

: আচ্ছা ঠিক আছে। ছেলের বউ আর বলব না। এবার বলো, তোমার ছেলের গার্লফ্রেন্ড দেখে ছোট ফুপার কী প্রতিক্রিয়া?

: তার কথা বলে লাভ আছে? মেয়েটা সামনে এলে মা ডাক বাদে অন্য কিছু ডাকে না। মেয়েটার যে একটা নাম আছে, ওটা মনে হয় সে ভুলে গেছে।

রাকিব হাসল। বলল, তাহলে তো ভালোই।

ছোট ফুফু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আর ভালো! যেমনতর বাপ তেমনতর ছেলে!

: তবুও তো বাঙালি মেয়ে।

: বাঙালি মেয়ে মানে?

: ছোট ফুফু, তোমার নিজের ভাগ্যকে তুমি নিজে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার। ছেলে ঘরে আছে, একটা বাঙালি মেয়েকে পছন্দ করছে। নয়তো এসব দেশের ছেলেমেয়েরা আঠারো না পেরোতেই যেভাবে ঘর ছাড়া হয়। ভিনদেশি মেয়ে নিয়ে চলে যায়!

: হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিকই বলেছিস। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>