নীল প্রজাপতির চোখে রাবির সমাবর্তন

লেখিকা
লেখিকা

অনুভূতিটা একান্তই ব্যক্তিগত। তবুও শেয়ার করতে পারলে হয়তো কিছুটা ভালো লাগবে ভেবেই আবার কলম ধরলাম হাতে। তখন ২০০৯ সাল। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট স্টাডিজের নবাগত শিক্ষার্থী। আমার স্বপ্নের নীল প্রজাপতির সূচনাটাও তখন থেকেই। ক্যাম্পাস জীবনে সবুজে ঘেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমে পড়েছি প্রতিক্ষণ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ মায়ায় বাধা পড়েছে মন। নীরব নিবিড় অনন্য ভালোবাসার নাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।

আমার ছাত্রজীবনের অন্যতম শস্যক্ষেত্র এটি। সময়ের হাত ধরে আমার মনের নীল প্রজাপতিটাও বড় হতে থাকে। আমার শিক্ষাজীবন শেষ হয় ২০১৪ সালে। নিয়তির হাত ধরে বিদায় নিয়ে আসি হৃদয়জুড়ে থাকা প্রিয় সেই ক্যাম্পাস থেকে। আমি বিদায় নিলে কী হবে, আমার সেই নীল প্রজাপতিটাকে রেখে আসি সেই প্রিয় চত্বরে! তার ডানায় ভর করে একদিনের জন্য হলেও ফিরব সবার মাঝে আনন্দ চিত্তে—এই কামনাই ছিল অন্তরে। কিন্তু সেই নীল প্রজাপতির ডানায় ফেরা হলো না আমার খুব ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও। আমার নীল প্রজাপতির ডানায় রাঙানো হলো না। কালো আর লাল রঙের আভা নীল প্রজাপতিটা হলো আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের প্রতীক। কালো আর লাল রং হলো আমার শিক্ষাজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ পাওয়া সমাবর্তনের গাউনের রং। যার কোনো রঙে রাঙাতে পারলাম না নিজেকে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দশম সমাবর্তনের লোগো
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দশম সমাবর্তনের লোগো

অথচ বিগত নয় বছর ধরে স্বপ্ন বুনে গেছি। ভেবেছি একদিন আমারও সমাবর্তন আসবে। সেদিন নীল রঙের ড্রেস পরব। তার সঙ্গে থাকবে সেই কাঙ্ক্ষিত কালো গাউন, টুপি আর লাল স্কার্ফ। হাতে থাকবে জীবনের অন্যতম অর্জন ডিগ্রির সনদটা। সহপাঠীদের সঙ্গে থাকবে সেই বহুল পরিচিত ভঙ্গির ছবি। আর থাকবে স্মৃতির মণিকোঠায় বহু যত্নে রাখা ছাত্রজীবনের অন্যতম অর্জন। কিন্তু এখন সব বিলীন হয়ে গেছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর (২০১৮) সুদূর এই টোকিওতে বসে নীরব দৃষ্টিতে অনলাইনের বদৌলতে ফেসবুকে অবলোকন করেছি আমার নীল প্রজাপতির নিঃশেষ হয়ে যাওয়া আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দশম সমাবর্তন। দেখেছি সহপাঠীদের আনন্দ উল্লাস।

মনের অজান্তেই কেঁদেছি। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। অনেক ক্যালকুলেশন করে বোঝার চেষ্টা করেছি ভুলটা কোথায় ছিল। ভুলটা কী আমার স্বপ্ন বোনায়, নিয়তির নাকি অনিয়মের। উত্তর জানা। কিন্তু বলতে মানা। যা হোক, আমি নিরুপায় হয়ে ভেবেই নিলাম আমার নসিবে ছিল না! হা-হা-হা...!

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দশম সমাবর্তনে লেখিকার সহপাঠীরা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দশম সমাবর্তনে লেখিকার সহপাঠীরা

আমি টোকিওর একটি ইউনিভার্সিটিতে জাপান সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে গত বছর এসেছি। তার আগে পার হয়ে গেছে প্রায় চার বছর। তখন সমাবর্তন হয়নি, এমনকি ২০১৬ বা ২০১৭ সালেও হয়নি। কিন্তু আমার নীল প্রজাপতির প্রস্তুতিটা ঠিকই ছিল তখন। আর এমন সময় হলো যখন আমার নতুন শিক্ষাজীবনের সেমিস্টার ফাইনাল। সুতরাং নিয়তি আর নসিবে ছিল না ভেবেই নীল প্রজাপতিটাকে বোঝানোর অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছি। জানি না কখনো বোঝানো যাবে কিনা।

এ লেখা যেদিন লিখছি, সেদিন বর্তমান ছাত্রজীবনের প্রথম বর্ষের রেজাল্ট হাতে পেলাম। আলহামদুলিল্লাহ এক্সিলেন্ট গ্রেড পেয়ে সেকেন্ড ইয়ার শুরু করছি। তবুও নীল প্রজাপতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের সেই ব্যথাটা ভুলতে পারছে না। কিছু বিষয় হয়তো এমনি অপ্রাপ্তিতেই রয়ে যায়। হয়তো সময়ই নীরব সাক্ষী হয়ে রয়। কিন্তু আমি জানি স্বপ্ন থেমে থাকে না। স্বপ্ন আর জীবনযুদ্ধ চলমান।

জীবনসঙ্গীর সঙ্গে লেখিকা
জীবনসঙ্গীর সঙ্গে লেখিকা

নীল প্রজাপতি...প্লিজ কথা শোনো। পাল্টাও তোমার রং। মহান রাব্বুল আলামিন সহায় থাকলে এবার তোমার ডানায় বাধবে সবুজের রঙিন আভা। প্রতীক্ষা নতুন স্বপ্নের আর নতুন প্রত্যয়ের। এবার পালা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাস ছেড়ে নীল প্রশান্ত সাগরীয় জাপানিজ ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে নিজের স্বাক্ষর রেখে যাওয়ার। ইনশা আল্লাহ, মহান রব্বুল আলামিন সহায় হবেন। আমিন।

মোছা. নাজিরা আক্তার রিতু: গবেষক, টোকিও ইউনিভার্সিটি অব মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, মিনাতো, টোকিও, জাপান।