শিক্ষা, শিক্ষক ও একটি জাতির গল্প-চার

ছবি প্রথম আলো
ছবি প্রথম আলো

বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সঙ্গেই বলে দেওয়া আছে এখানে যে জ্ঞান বিতরণ করা হবে তা হতে হবে বিশ্বমানের। কারণ এ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের নিজেকে প্রমাণের লড়াইটা কেবল দেশের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না থেকে বিস্তার লাভ করবে সারা বিশ্বে। লড়াই যখন একই উপজেলায় থাকে, তখন একটি উপজেলা থেকে আমাদের সময় বড়জোর ১০ জন বৃত্তি পেত। তাদের ধরে নেওয়া হতো ওই উপজেলার ওই ব্যাচের শ্রেষ্ঠ মেধাবী। এই বৃত্তিপ্রাপ্ত মেধাবীদের মধ্যে হয়তো ২৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে (তখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বেশি ছিল না), ৫০ শতাংশ জেলা পর্যায়ের সরকারি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়ার সুযোগ পেতেন। বাকি ২৫ শতাংশ হয়তো এইচএসসির পর পড়াশোনা বাদ দিতেন কিংবা আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য উপজেলা পর্যায়ের ডিগ্রি কিংবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স কোর্সে ভর্তি হতেন। অবশ্য অর্থ থাকলে অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হতেন। এর মধ্যে একটা বড় অংশ বৃত্তিপ্রাপ্ত না হয়েও ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেতেন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (স্নাতক পর্যায়ের) ভর্তি পরীক্ষাটি হলো বিগত চার বছর (নবম থেকে দ্বাদশ) শ্রেণির বইয়ে পঠিত বিষয়গুলোর জ্ঞানের ভিত্তি (বেসিক) মূল্যায়নের এক সুন্দর ছাঁকনি। এই ছাঁকনি দিয়ে সহজেই বেসিকে গন্ডগোল থাকা ভালো ফলাফল কিংবা খারাপ ফলাফলধারীরাও বাতিল হয়ে যেতেন। এত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় নামক এক মহাজ্ঞানের কারখানাতে প্রবেশ করানো হয়।

এই মহাজ্ঞানের কারখানাতে একটি গ্রামের ছেলে প্রথমেই যে ধাক্কাটি খান তা হলো লেকচার থেকে শুরু করে সব ইংরেজিতে পড়তে হয়। অথচ অনেকের কাছেই ইংরেজি ছিল এক ভয়াবহ আজাবের নাম। মজার বিষয় হলো এই ধাক্কা সামলাতে তাকে ক্লাসরুমে কিংবা বাইরে কোনো ধরনের সাহায্য করতে আমরা দেখি না। অধিকন্তু, এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে নানাভাবে অপমান অপদস্থ করতে একটুও পিছপা হন না অনেক শিক্ষক মহোদয়! ফলে গ্রামের শিক্ষার্থীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল হাল ছেড়ে দেয় আরেক দল দাঁত কামড়ে বলে দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের কী জ্ঞান আছে যা আমি জানতে পারব না!

প্রথমোক্ত দলের অনেকেই ফেল করে, ভর্তি বাতিল হয় কিংবা বহু কষ্টে একটা সার্টিফিকেট নিয়ে ছোটখাটো কোনো চাকরি করেই জীবনের সকল স্বাদ আহ্লাদ পূরণ করার আরেক সংগ্রামে নেমে পড়েন। আর দ্বিতীয় দল তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যান। অন্তত নিজেদের প্রমাণ করতে যে, আমার খারাপ ফলাফলের পেছনে আমার চেয়ে আমাকে যারা পথ প্রদর্শন করেছেন তাদের অবদান অনেক বেশি। এর প্রমাণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্রের কথা বলতে চাই। যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব খারাপ ফলাফল করেও যুক্তরাষ্ট্রে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী হিসেবে এখন কর্মরত আছেন। তার তুলনা দেওয়া যেতে পারে। শুধু তিনিই নন, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদাহরণ টানলে আরও হাজারো ব্যক্তিকে নিয়ে আসা যাবে।

এ সকল উদাহরণগুলো আমাদের সিস্টেমের দুর্বলতার দিকে আঙুল তুলে, এই আঙুল ভেঙে কিংবা মচকে দিতেই পারেন। কিন্তু এই মচকানোর মাধ্যমে প্রমাণ করা যাবে না যে, সিস্টেমের ফাঁক গলে অনেক শিক্ষকতায় অনিচ্ছুক ব্যক্তি শিক্ষক হিসেবে ঢুকে পড়ছেন! ফলে শিক্ষার তিন স্তরে জমে থাকা জঞ্জাল মুক্ত হওয়া তো দূরে থাক অনেক ক্ষেত্রে নিত্য নতুন জঞ্জাল যুক্ত হতেও দেখা যায় প্রতিনিয়ত! ফলাফল আবু বকরদের লাশগুলোর চেয়ে বড় কোনো প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে কি?

উন্নত দেশ জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্লাস নেওয়া, নিজে কিছু ক্লাস পরিচালনা করা এবং লেকচার তৈরির সুযোগ আমার হয়েছিল। জাপানে আমার পিএইচডির সুপারভাইজার ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে তিনবার তিনটি দুই ঘণ্টার ক্লাস নিতেন। ওই দুই ঘণ্টার ক্লাসে পড়ানোর জন্য তিনি ক্লাসের এক সপ্তাহ আগে ওই বিষয়ের সর্বাধিক নতুন বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে নিজের লেকচার তৈরি করতেন। এরপরে ওই লেকচার আমাদের কাছে স্লাইডের মাধ্যমে প্রদর্শন করে আরও কিছু অন্তর্ভুক্তি কিংবা কোনো ব্যাখ্যা কঠিন হয়ে গেল কিনা তা জানতে চাইতেন। আমাদের কোনো কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে ওই স্লাইডে আরও সহজ কিছু উদাহরণ যুক্ত করেই তবে তিনি ওসাকা যেতেন। এটা যে বছরে তিনবার করতেন তা নয়। তিনি হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসগুলোও এভাবে নিত্যনতুনভাবে তথ্য সম্পন্ন করেই পরিচালনা করতেন। আমি একবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, একই টপিকে প্রতিবছর আলাদা চিত্র দিয়ে বোঝাতে হবে কেন? উত্তরে তিনি বললেন, ‘কোনো শিক্ষার্থী যদি এই কোর্সে আগের বছর ফেল করে পুনরাবৃত্তি করে তাহলে তার কাছে যেন আমার লেকচার বোরিং না হয়ে যায়!’ আর আমাদের কোনো শিক্ষার্থী কিছু না বুঝলে প্রশ্ন করলেই অনেক ক্ষেত্রে যা হয়, তা ভুক্তভোগী মাত্র সবারই জানার কথা!

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তুলনামূলক নতুন ও খুব আনকোরা একটি বিষয় (এ বছর রসায়নের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত একটি টপিক) পড়াতেন। এই দুই প্রজন্মের এবং দুই দেশের দুজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের একটি বিষয় কিন্তু একেবারেই মিল ছিল। তা হলো শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে সহজ ইলাস্ট্রেশন ব্যবহার করে নিজেদের লেকচারকে সর্বোচ্চ প্রাণবন্ত করে ফুটিয়ে তোলা। টেনিউর ট্রাকের অধ্যাপকেরা যেহেতু ফান্ডিং নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকেন, সেহেতু মাঝে মাঝেই ওই ফিল্ডের সবচেয়ে নতুন পেপারটি খুঁজে তার মূল বিষয়গুলো খুঁজে দিতে হতো। একটি ক্লাসের অন্তত এক সপ্তাহ আগেই তিনি ফাইনাল করে ফেলতেন ওই ক্লাসে কী পড়াবেন। সে অনুযায়ী চলত ঘষামাজা ও নিত্যনতুন উদ্ভাবনী টেকনিক।

এই দুই উদাহরণের সঙ্গে আমার একজন ছাত্রের (বর্তমানে সে এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র) দেওয়া একটি বক্তব্য তুলে ধরব। তুলনা করার দায়িত্ব সম্মানিত পাঠকদের। আমার এই ছাত্র আমার উৎসাহে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। একদিন সে বলল, অনেক স্যার কী যে পড়ান তা বুঝতে বুঝতেই ১০টার মতো লেকচার চলে যায়। এ পর্যন্ত একজনও বললেন না, এই টপিক করে কী লাভ হবে। কেউ কেউ তো বোর্ড পূর্ণ করে লিখেই জিজ্ঞেস করে কী বুঝলা? আমরা যদি সব বুঝেই যেতাম তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে বাসাতে বসে গ্র্যাজুয়েশন করলেই হতো, তাই নয় কি স্যার!

উত্তর দিতে পারিনি। উত্তর জানা নেই তা নয়, তবে ওকে আমি আশাহত করতে চাইনি। বলেছি যে কয়জন ভালো ভাবে ক্লাস নেন তাদের থেকে শিখে নেবে আর এমন করেই আমরাও পড়াশোনা করে এসেছি। সুতরাং তোমাকেও পারতে হবে। এর চেয়ে ভালো কিছু বলতে পারিনি। কারণ ছাত্র হিসেবে দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করেছি। কিন্তু ওর এই কথাগুলোকে ডিফেন্ড করার মতো নৈতিক সমর্থন আমি কোনো অবস্থাতেই মনে করতে পারছিলাম না।

সবাই কি এমন? উত্তরটা হবে ‘না’। তবে এমনের সংখ্যাই এখন বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানেই তাকে জ্ঞানের সংশ্লেষণ করে সহজীকরণ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস অনেকেই চোথা কিংবা সেই ১৯৬০ সালের বইয়ের জ্ঞান বিতরণ করেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন। বিশ্বমানের জ্ঞান বা প্রক্রিয়া তো নির্বাসনে চলার উপক্রম। আর গবেষণার বিষয় নাই বা তুললাম। তাদের মধ্যে যারা আবার একটু চেষ্টা করেন, তাদের বসার রুম থেকে চেয়ার সব নিয়েই চলে নির্দয় রাজনৈতিক খেলা। মরার ওপর খরার ঘা নিয়ে তো এই মান্যদের নীতির নীতি ভ্রষ্টতা রয়েছেই, যা অনেককে নিজের দায়িত্বের ন্যূনতম না পালন করে তাকে সমাজে সবচেয়ে পূজনীয় ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করার এক পরশপাথর হয়ে জাতির বুকে জগদ্দল পাথরের মতো জাপটে বসে আছে। যার ভারে জাতি আজ নিশ্বাস নিতে নাভিশ্বাস উঠিয়েও কুল পাচ্ছে না। তাহলে কি এই সব সমস্যাই রয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতে? এর সহজ কোনো সমাধান কি আমরা পেতে পারি? হয়তো পারি, কী পারি তা দেখব শেষ পর্বে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের এই বাধাগুলো অতিক্রমের উপায় হিসেবে আপনার কোনো পরিকল্পনা থাকলে জানান নিচের ইমেইলে। সবাই মিলেই খুঁজব এই মহামারির সহজ সমাধানগুলো আগামী পর্বে। অপেক্ষা করব এ লেখা প্রকাশের সময় থেকে দুই সপ্তাহ।
...

শেখ মাহাতাবউদ্দিন: প্রাক্তন শিক্ষক, সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, ঢাকা ও পোষ্টডক্টরাল গবেষক, হেনরি ফোর্ড হসপিটাল, মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1559739